ওয়ারিশ সনদ জালিয়াতি ও আইনি প্রতিকার

কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিকানা কারা পাবেন সেটা নিয়ে আইনি বিধিবিধান আছে। সাধারণত মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে জমানো টাকা, কোম্পানির শেয়ার, ডিবেঞ্চার, অস্থাবর সম্পত্তি, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি বৈধ ওয়ারিশরা টাকা উত্তোলন বা অন্য বিষয়গুলো (কোম্পানির শেয়ার, ডিবেঞ্চার, অস্থাবর সম্পত্তি (গাড়ি), সঞ্চয়পত্র) নিজেদের নামে রেজিস্ট্রিভুক্ত কিংবা মালিকানার অংশ নির্ধারণ করতে চাইলে প্রয়োজন হয় সাকসেশন সার্টিফিকেট। 

সাকসেশন আইন ১৯২৫-এর ৩৭০-৩৮৯ ধারায় সাকসেশন সার্টিফিকেটের বিধান বলা আছে। মৃত ব্যক্তি যদি মুসলিম হন তাহলে মুসলিম আইন অনুযায়ী, যারা ওয়ারিশ হওয়ার যোগ্য তারা উত্তরাধিকার সনদের জন্য আবেদন করতে পারবেন বা অন্য ধর্মের হলে সেই ধর্মের পারিবারিক আইন অনুযায়ী আবেদন করতে পারবেন। স্থাবর সম্পত্তি যেমন- জমিজমার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, তেমনভাবেই অন্যান্য সম্পত্তির হিস্যা বা অংশ অনুযায়ী সব ওয়ারিশপ্রাপ্ত হবেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মৃত ব্যক্তির বৃদ্ধ মা-বাবা জীবিত থাকতে স্ত্রী-সন্তানরা বৃদ্ধ মা-বাবাকে বাদ দিয়ে; ভাইয়েরা বোনদের বাদ দিয়ে বা একাধিক স্ত্রী থাকলে একে অপরকে বাদ দিয়ে আদালত থেকে উত্তরাধিকার সনদ হাসিল করেন, যা আইনত ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে ঘৃণিত অপরাধ। 

কোনো ওয়ারিশকে বাদ দিয়ে উত্তরাধিকার সনদ হাসিল করলে সংক্ষুব্ধ বা বঞ্চিত ওয়ারিশরা ইস্যুকৃত সনদ বাতিল চেয়ে আদালতে আবেদন করতে পারেন। কোনো সম্পত্তি বাদ পড়ে থাকলে পরবর্তী সময়ে সাকসেশন সার্টিফিকেট বর্ধিতকরণের জন্য আবেদন করা যায়। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি ওয়ারিশ সনদ জালিয়াতি করে, যেমন- আমিন মিয়া (ছদ্মনাম) কাউন্সিলর স্বাক্ষরিত দুটি ওয়ারিশ সনদপত্রের ফটোকপি সত্যায়িত করতে আসেন। জমির ও মোহাম্মদ আলীর (মৃত) ওয়ারিশের নাম উল্লিখিত দুটি ওয়ারিশ সনদের ফটোকপি কাউন্সিলরের সামনে উপস্থাপন করলে কাউন্সিলর আসামিকে ওয়ারিশ সনদে স্বাক্ষর তার নয় বলে চ্যালেঞ্জ করেন। কিন্তু আমিন মিয়াও পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে কাউন্সিলর ওয়ারিশ সনদের বালাম বই পরীক্ষা করেন। বালাম বইয়ে দেখা যায়, সেই তারিখে কোনো ওয়ারিশ সনদই ইস্যু করা হয়নি। 

এক পর্যায়ে আমিন মিয়া স্বীকার করেন আসামিরা ওই ওয়ারিশ সনদ দুটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের প্যাড, সিল, স্বাক্ষর নকল করে তৈরি করেছেন। বেড়িবাঁধের ভূমি অধিগ্রহণের সরকারি টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে এই কাজ করেছে বলে স্বীকার করেন আসামিরা। ওই দিন জাল ও মূল সনদ দুটি কাউন্সিলর অফিসে জমা দিয়ে তা বিনষ্ট করার কথা থাকলেও আমিন মিয়া তা জমা দেননি। এ ঘটনায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের সচিব থানায় একটি জিডি ও লিখিতভাবে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে জানান। 

এমন ঘটনা আমাদের দেশে অনেক ঘটে থাকে। আর ওয়ারিশ সনদ জালিয়াতি হলে আইনে এর প্রতিকারও রয়েছে। দণ্ডবিধির ১৯৭ ও ১৯৮ ধারায় অপরাধ সংঘটিত হলে দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারা মোতাবেক (মিথ্যা দলিল আদালতে ব্যবহার করা হলে) সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হয়। বিচারিকপ্রক্রিয়া ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বা সাক্ষ্য বিকৃত করলে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী তিন বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। যদি জন্ম নিবন্ধন অথবা মৃত্যু নিবন্ধন সম্পর্কিত হয় সে ক্ষেত্রে যারা মিথ্যা তথ্য দেবেন তারা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ এর ২১(২) ধারা মোতাবেক সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দণ্ডিত হতে পারেন। যিনি সনদ ইস্যু করবেন তার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ এর ২১(৩) ধারা মোতাবেক সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। 

ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারের অধিকার কেউ হরণ করতে পারে না বা এই অধিকার তামাদিও হয় না। কেউ কারো দ্বারা অধিকার বঞ্চিত হলে আইনের মাধ্যমে এর প্রতিকার পেতে পারেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh