বিবাহবিচ্ছেদে মুসলিম নারীর অধিকার

মুসলিম আইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদ। মুসলিম পুরুষ তার স্ত্রীকে বৈধ কারণে তালাক দিতে পারেন। তবে একজন মুসলিম নারী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারেন কি না, সে সম্পর্কে অনেক সময় ধোঁয়াশা দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনে কতগুলো শর্ত পূরণ হলে একজন নারীও তালাক দিতে পারেন। মুসলিম সমাজে নারীকে কিছু ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয় আছে। তার ওপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত হয় কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তালাক সম্পন্ন হবে। 

কাবিন নামার ১৮ নম্বর কলামের মাধ্যমে স্ত্রীকে তালাকের যে ক্ষমতা প্রদান করা হয় তা ‘তালাক-ই-তৌফিজ’ নামে পরিচিত। এ ক্ষমতাবলে বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ৭ ধারা অনুসরণ করে তালাকপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। এখানে স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দেওয়ার পর বা বিবাহ ছিন্ন করার পর তালাক রেজিস্ট্রেশন করবেন। এরপর তালাকের নোটিশের এক কপি পৌর/সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যানকে পাঠাবেন এবং এক কপি স্বামীর ঠিকানায় পাঠাবেন। পৌর/সিটি করপোরেশনের কাছে নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন অতিবাহিত হলে তালাক কার্যকর হবে। স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের সম্মতিতে যে তালাক হয় তাকে বলে খুলা তালাক। এখানে স্ত্রী তালাকের প্রস্তাব দেবে এবং স্বামী তা গ্রহণ করবে। দুই পক্ষই এখানে সংসার ছিন্ন করার ব্যাপারে সম্মত থাকবেন। এ ধরনের তালাকের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকেই কাজী অফিসে উপস্থিত হয়ে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়।

মুবারত হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে উভয় পক্ষ বিচ্ছেদের জন্য সম্মত থাকবেন। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে বিষয়টি হচ্ছে এ রকম যে, উভয় পক্ষ এখানে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তালাকের সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। অনেকে মনে করেন যে, মুবারতের ক্ষেত্রে পক্ষগণ একে অপরকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। তবে এ ধারণা সঠিক নয়। একজন মুসলিম নারী যদি তালাক-ই-তৌফিজ, খুলা বা মুবারতের মাধ্যমে তালাক দিতে না পারেন, তাহলে আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯-এর ২ ধারা অনুসারে, কতগুলো বিষয় আছে যা প্রমাণ করতে পারলে একজন নারী আদালত থেকে বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি পাওয়ার অধিকারী হবেন। 

স্বামী যদি নিষ্ঠুর আচরণ করেন তাহলে এ মর্মে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করা যাবে। এখানে নিষ্ঠুর আচরণ বলতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকে বোঝায়। নারীর সম্পত্তি জোরপূর্বক হস্তান্তর করা, সম্পত্তি ভোগে বাধা দেওয়া, অনৈতিক জীবনযাপনে বাধ্য করা, ধর্মকর্ম পালনে বাধা প্রদান, আইনগত অধিকার প্রয়োগে বাধা- এসবই নিষ্ঠুর আচরণের আওতাভুক্ত। এই নিষ্ঠুর আচরণের কারণে স্ত্রী গৃহত্যাগ করলে স্বামী দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলা করলেও ডিক্রি পাবেন না। অনেক সময় এ রকম কঠিন অবস্থা দেখা যায় যে, বিয়ের পর স্বামী নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তখন এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। আইন অনুযায়ী, স্বামীর যদি চার বছর যাবৎ কোনো খোঁজখবর না পাওয়া যায়, তাহলে স্ত্রী বিচ্ছেদের জন্য আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। তবে আদালত ডিক্রি প্রদান করলে তা ছয় মাসের আগে কার্যকর হবে না। তা ছাড়া স্বামীর যদি সাত বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ড হয় তাহলেও স্ত্রী বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। 

আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো স্বামী যদি ভরণপোষণ না দেয়। ভরণপোষণ পাওয়া প্রতিটি বিবাহিত নারীর আইনি অধিকার। ভরণপোষণ যদি দুই বছর যাবৎ না দেওয়া হয়, তাহলে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন। আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন, একজন স্ত্রী তালাক প্রদান করলে তার দেনমোহরের অধিকার খর্ব হয়। আসলে বিষয়টি তা নয়। তালাক স্বামী বা স্ত্রী যেই দিয়ে থাকুন না কেন দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। তালাকের সঙ্গে দেনমোহরের সম্পর্ক নেই। এটা স্ত্রীর আইনি অধিকার। তালাক না হলেও দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়। ইসলামিক ও রাষ্ট্রীয় আইন উভয়ই মুসলিম নারীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা দিয়েছে। তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়টি যদিও আপাতদৃষ্টিতে সন্তোষজনক নয়, তার পরও পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে অনেক সময় এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh