ভাষাভিত্তিক বিভাগে পড়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ শিক্ষার্থীরা
হারুন ইসলাম
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:২৮
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) শিক্ষার্থীদের আড্ডা।
বিশেষায়িত কর্মক্ষেত্র না থাকা, চাকরির বাজারের সঙ্গে পঠিত বিষয়ের সংযোগহীনতাসহ নানা কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভাষাভিত্তিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে।
ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, সংস্কৃত এবং পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা বলছেন, স্নাতকোত্তর শেষ করেও প্রত্যাশিত চাকরি না পাওয়ায় তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। পারিবারিক চাপ, চাকরির পরীক্ষার জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতির মতো বিষয়গুলো তাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার বা চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচারের মতো বিভাগগুলোতে কিছুটা সুযোগ থাকলেও উর্দু, ফারসি, সংস্কৃত বা পালির মতো ঐতিহ্যবাহী ভাষা বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীরা বৃত্তি বা দেশের ভেতরে বিশেষায়িত কর্মক্ষেত্রের তেমন কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না বলে জানান।
এই হতাশার চিত্র শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের প্রধান তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে এই চারটি বিভাগে বর্তমানে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছেন। তাদের পাঠদানে নিয়োজিত আছেন মাত্র ১০৮ জন শিক্ষক। প্রতি বছর এই বিভাগগুলোতে নতুন করে ৬১১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও স্নাতকোত্তর শেষে এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য গত একশ বছরেও বিশেষায়িত কোনো কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়নি।
সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই চারটি বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য পঠিত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বিশেষায়িত চাকরির বাজার নেই বললেই চলে। ফলে বিসিএস এবং অন্যান্য সরকারি বেসরকারি সাধারণ চাকরিই তাদের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়, যার জন্য তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করে দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি নিতে হয়।
পরিসংখ্যানে হতাশার চিত্র
দেশের তিনটি প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চারটি বিভাগের বর্তমান চিত্র বেশ উদ্বেগজনক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগে যথাক্রমে ৩৫০ ও ২০০ শিক্ষার্থী রয়েছেন। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ৩৭৫, ২৭০ ও ২৫০ জন।
একইভাবে, তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৩০০, ২৫৫ ও ৩৫০। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বৌদ্ধ শিক্ষা বিভাগে পড়ছেন যথাক্রমে ২৫০ ও ৪২৫ জন শিক্ষার্থী। বিপুল সংখ্যক এই শিক্ষার্থীর বিপরীতে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন মাত্র ১০৮ জন। এর মধ্যে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগে ২৬ জন; ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ২৫ জন; সংস্কৃত বিভাগে ৩৫ জন এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বৌদ্ধ শিক্ষা বিভাগে ২১ জন শিক্ষক রয়েছেন।
শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যথাক্রমে ১০০ ও ৯০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হতো। ফারসি ও উর্দু বিভাগে ভর্তি হতেন যথাক্রমে ১০০ ও ১১০ জন। তবে বিষয়গুলোর চাহিদা ও কর্মক্ষেত্রের অভাব উপলব্ধি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে আসন সংখ্যা কমিয়েছে। বর্তমানে সংস্কৃত বিভাগে ৬০, পালি বিভাগে ৫০, ফারসি বিভাগে ৭৫ ও উর্দু বিভাগে ৭০ জন করে শিক্ষার্থী নেওয়া হচ্ছে।
রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে প্রতি বছর যথাক্রমে ৫৬ ও ৭০টি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে ৪০টি আসন রয়েছে। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগে যথাক্রমে ৫৫ ও ৫০টি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগে ৪০টি আসন রয়েছে।
ভাষার বিভাগে ভাষাই শেখেন না শিক্ষার্থীরা
শিক্ষার্থীরা বলছেন, চাকরির বাজারে তাদের পঠিত বিষয়ের কোনো মূল্যায়ন না থাকা হতাশার সবচেয়ে বড় কারণ। তবে এর চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, বিভাগগুলো ভাষাভিত্তিক হলেও শিক্ষার্থীরাই সংশ্লিষ্ট ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠছেন না।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, উর্দু, ফারসি, সংস্কৃত বা পালি ভাষার সাহিত্য ও ইতিহাস তারা শ্রেণিকক্ষে মূলত বাংলা ভাষায় অধ্যয়ন করেন। ফলে সংশ্লিষ্ট ভাষায় কথা বলা, লেখা বা গবেষণার দক্ষতা তাদের তৈরি হচ্ছে না। এমনকি, এসব বিভাগের শিক্ষকদের একটি বড় অংশেরও সংশ্লিষ্ট ভাষার দক্ষতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা ফারসি সাহিত্য পড়ছি, কিন্তু বাংলায়। ইরান বা আফগানিস্তানের কোনো মানুষের সঙ্গে আমরা ফারসিতে কথা বলতে পারব না। এই ডিগ্রি নিয়ে আমি কীভাবে নিজেকে ফারসি ভাষার গ্র্যাজুয়েট দাবি করব? চাকরির বাজারে এর কোনো মূল্য থাকবে না, এটিই স্বাভাবিক।”
‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ মোহ
জেনেশুনেও শিক্ষার্থীরা কেন এমন বিষয়ে ভর্তি হচ্ছেন? এর পেছনে কাজ করছে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের প্রতি মোহ। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক শিক্ষার্থী অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও, শুধু ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’ এই পরিচয় পেতে তুলনামূলক কম চাহিদার এই বিষয়গুলোতে ভর্তি হন।
সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণাও এর জন্য দায়ী। এমন একটি ধারণা হলো- “বিষয় কোনো ব্যাপার নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিষয় হলেই হলো। চাকরি অনেকাংশে নিশ্চিত।”
অনেক শিক্ষার্থী এই প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে শুধু একটি সনদের আশায় এসব বিভাগে ভর্তি হন। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে বিসিএস বা অন্য কোনো সরকারি চাকরি। ফলে পঠিত বিষয়ের প্রতি তাদের যেমন আগ্রহ তৈরি হয় না, তেমনি বিভাগও তাদের বিশেষায়িত কোনো দক্ষতা দিতে পারে না। শেষ পর্যন্ত উভয় সংকটে পড়ে তাদের শিক্ষাজীবন কাটে হতাশায়।
শতবর্ষী বিভাগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বছর ১৯২১ সাল থেকেই এসব বিভাগের যাত্রা শুরু। সে সময় ‘সংস্কৃত স্টাডিজ এবং সংস্কৃত ও বাংলা’ নামে একটি বিভাগ ছিল, যা ১৯৩১ সালে ‘সংস্কৃত ও বাংলা’ নাম ধারণ করে। ১৯৩৭ সালে বাংলা ও সংস্কৃত পৃথক দুটি বিভাগে পরিণত হয়। সে সময় বর্তমানের সংস্কৃত বিভাগের নাম ছিল ‘সংস্কৃত ও পালি বিভাগ’। ২০০৭ সালে এই বিভাগটি আবারও ভেঙে ‘সংস্কৃত’ এবং ‘পালি ও বৌদ্ধ শিক্ষা’ নামে দুটি পৃথক বিভাগ চালু হয়।
একইভাবে, ১৯২১ সালে ‘ফারসি ভাষা ও সাহিত্য ও উর্দু’ নামে যাত্রা শুরু করা বিভাগে ফারসিতে স্নাতকোত্তর এবং উর্দু সাবসিডিয়ারি হিসেবে পড়ানো হতো। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উর্দুতে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কোর্স শুরু হয়। ২০০৭ সাল থেকে ‘ফারসি ভাষা ও সাহিত্য’ এবং ‘উর্দু’ দুটি পৃথক বিভাগে পরিণত হয়।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে এসব বিভাগের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। কিন্তু কালের পরিবর্তনে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এসব বিষয়ের ব্যবহারিক চাহিদা কমে গেছে। যার ফলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হতাশা।
বিশেষজ্ঞ মতামত
এই সংকট শুধু এই চারটি বিভাগের নয়, বরং এটি দেশের উচ্চশিক্ষা ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি সামগ্রিক সমস্যা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “এ চারটি বিভাগের মতো আরও অসংখ্য বিভাগ রয়েছে, যার বিশেষায়িত কোনো কর্মক্ষেত্র নেই।”
তিনি লোকপ্রশাসন বিভাগের উদাহরণ দিয়ে বলেন, “অতগুলো গ্র্যাজুয়েট কি দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য দরকার আছে? তাছাড়া শুধু ওই বিভাগ থেকেই কি প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া হয়? সুতরাং আমাদের দেশে বিশেষায়নের ভিত্তিতে নিয়োগ পদ্ধতি চালু নেই। এটি সামগ্রিক সমস্যা।”
তবে এই চারটি বিভাগের প্রাসঙ্গিকতা ফিরিয়ে আনার উপায়ও বাতলে দেন তিনি। অধ্যাপক সালাম বলেন, “এগুলো অধিকাংশ ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক। ফলে সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষী রাষ্ট্রের (যেমন ইরানের সঙ্গে ফারসি, ভারতের সঙ্গে সংস্কৃত, শ্রীলঙ্কা বা থাইল্যান্ডের সঙ্গে পালি) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা যেতে পারে।
তবে এর পেছনের মূল সংকট তুলে ধরে তিনি বলেন, “কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এসব বিষয়ের শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট ভাষায় কথা বলতে পারে না। আরও দুঃখজনক হলো তারা সবাই সংশ্লিষ্ট সাহিত্য অধ্যয়ন করে বাংলা ভাষায়।”
তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষার্থীদের ভাষায় পারদর্শী করে তুলতে পারে, তবেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর, উচ্চশিক্ষায় বৃত্তির ব্যবস্থা এবং একাডেমিক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোয় শিক্ষার্থী সংখ্যা ‘যৌক্তিকীকরণ’ বা কমিয়ে আনার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
