ব্যাংকের ‘১৭৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ’: দুদক কর্মকর্তার ‘দুর্বল’ তদন্ত ফেরত
নজরুল ইসলাম
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:৪৫
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
জালিয়াতি করে এবি ব্যাংক থেকে ঋণ তুলে ১৭৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করার চার বছরেও তদন্ত শেষ করতে পারছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্ত কর্মকর্তা একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন, কিন্তু সেটি কমিশনের কাছে মনঃপুত হয়নি।
২০২১ সালে দুদকের উপসহকারী পরিচালক (বর্তমানে সহকারী পরিচালক) আবুল কালাম আজাদ মামলাটি করেন। পরে সেটির তদন্ত করেন উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়ার পর কমিশন আইনি মতামতের জন্য সেটি আইন অনুবিভাগে পাঠায়। আইন অনুবিভাগ মতামতও দেয়। তবে কমিশন সেই প্রতিবেদন ফিরিয়ে দেয়।
এরপর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজকে নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি শিগগির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। তবে আগের তদন্তের দুর্বলতার বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাননি।
প্রতিবেদনটি কেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে—এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করে দুদকের কেউ মন্তব্য করতে চাননি। তবে আইন অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউ আসামির তালিকা থেকে বাদ পড়লে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সাক্ষীর তথ্য তদন্ত প্রতিবেদনে না থাকলে কমিশন সে প্রতিবেদন গ্রহণ করে না। কারণ আদালতে বিচার শুরু হলে অভিযোগ প্রমাণে অসুবিধা হয়। এতে ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা বাদ পড়ে যায়। একই অপরাধে কেউ শাস্তি পায়, আর কেউ বাইরে ঘুরে বেড়ায়।”
তদন্তে ঘাটতি কেন—এই প্রশ্নে সৈয়দ নজরুল ইসলামের বক্তব্য জানতে পারেনি দেশকাল নিউজ ডটকম। তিনি শিক্ষা ছুটি নিয়ে চীনে আছেন।
আইন অনুবিভাগ তদন্তে কী ঘাটতি পেয়েছে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে দুদকের মহাপরিচালক (আইন) শাহানাজ সুলতানার মোবাইলফোন নম্বরে কল করলে বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া প্রশ্নেরও জবাব আসেনি।
কাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
মামলায় বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এবি ব্যাংকের ঢাকার কাকরাইল শাখা থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের নামে ছয়টি জাল ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে ১৬৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই অবৈধ সাতটি ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে তোলা হয় আরও ১০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১৭৬ কোটি ১৮ লাখ টাকার ঋণ আর ফেরত আসেনি।
মামলায় বলা হয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তারা এসব জাল ওয়ার্ক অর্ডার তৈরি এবং সেগুলোকে বৈধ দেখিয়ে ব্যবহার করে টাকাগুলো আত্মসাৎ করেছেন।
মামলার আসামিরা হলেন— এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী এরশাদ আলী; এবি ব্যাংক কাকরাইল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক এ বি এম আব্দুস সাত্তার; সাবেক রিলেশনশিপ ম্যানেজার আবদুর রহিম ও আনিসুর রহমান; ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল ইসলাম; অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট রুহুল আমিন; প্রধান কার্যালয়ের হেড অব সিআরএম ওয়াসিকা আফরোজী; সাবেক এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মুফতি মুস্তাফিজুর রহমান; সাবেক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট সালমা আক্তার; অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ এমারত হোসেন ফকির; সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার তৌহিদুল ইসলাম; সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শামীম এ মোরশেদ; ভাইস প্রেসিডেন্ট খন্দকার রাশেদ আনোয়ার; অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সিরাজুল ইসলাম; সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মাহফুজ-উল-ইসলাম; উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান চৌধুরী এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহমেদ।
মামলায় বলা হয়েছে, এরশাদ আলীর ঋণের আবেদন পেয়ে কাকরাইল শাখার তখনকার কর্মকর্তারা ওয়ার্ক অর্ডার যাচাই–বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়ার সুপারিশসহ ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনে (সিআরএম) পাঠান।
ক্রেডিট কমিটির প্রধান মসিউর রহমান চৌধুরী, সদস্য মোহাম্মদ মাহফুজ-উল-ইসলাম ও সাবেক এমডি শামীম আহমেদ রেকর্ডপত্র যাচাই–বাছাই ছাড়াই ১৬৬ কোটি ১৮ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন দেন।
দুদক বলছে, এরশাদ আলী ২০১৭–২০১৮ সালে সাতটি ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে বাকি ১০ কোটি টাকা নেন। এর মধ্যে চারটিতে ১২ শতাংশ এবং তিনটিতে ১০ শতাংশ মার্জিন রেখে এরশাদ ব্রাদার্সের অনুকূলে এবি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই শাখা থেকে ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়া হয়।
এরশাদ ব্রাদার্স ১০ শতাংশ মার্জিনে টাকা তুললেও ১২ বা ১০ শতাংশ নগদ মার্জিন না থাকার বিষয়ে কাকরাইল শাখা কোনো অভিযোগ তোলে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শহিদুল জাহিদ সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “ঋণ অনুমোদন নীতিমালা অনুসরণ করলে এমন হতো না। অনুমোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো একটি পক্ষ অসৎ উদ্দেশ্যে নীতিমালা মানেনি। তারপরও পরের ধাপে থাকা কর্মকর্তারাও যাচাই–বাছাই করতে পারতেন। কিন্তু সেখানেও ব্যত্যয় হয়েছে।”
এ বিষয়ে জানতে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও সৈয়দ মিজানুর রহমানের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো প্রশ্নেরও জবাব আসেনি।
