প্রাইমারি স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ কত দূর?

মানুষকে পাশবিকতা থেকে বের করে তার আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন এনে তাকে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলাই শিক্ষার দাবি। অর্থ উপার্জন কিংবা বিশেষ কোনো কাজের যোগ্য করে গড়ে তোলাই শুধু শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়, বরং এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীকে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘শিক্ষার বিষয়টি শুধু পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া কিংবা সার্টিফিকেট অর্জন করা নয়।...মানবিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম—সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত।’

একটি সফল শিক্ষাব্যবস্থার জন্য শিক্ষার দুটি দিকের সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। একটি হলো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা, আরেকটি হলো নৈতিক শিক্ষা। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী হবে আর নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে সে মূল্যবোধসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে। একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের ছাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পারদর্শী হবে, আবার মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবেও গড়ে উঠবে। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পাশাপাশি হবে মানবিক মানুষ। তার মধ্যে তৈরি হবে মনুষ্যত্ব বোধ।

আর মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে হলে প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষা। সিলেবাসটি এমনভাবে প্রণয়ন করা দরকার যে একজন গণিত, ইংরেজি কিংবা সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষার পাশাপাশি মূল্যবোধের এ ধর্মীয় শিক্ষাও প্রদান করা হবে। তখনই সে শিক্ষাব্যবস্থা হবে সফল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এক সমাবেশে সত্যি বলেছিলেন, ‘ধর্মীয় শিক্ষা সংযুক্ত করা হলেই একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ হয়।’ (যুগান্তর : ৪ নভেম্বর, ২০১৮)

আজকের শিশুই আগামীর বাংলাদেশ। তাকে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে মূল্যবোধসম্পন্ন করে ‘সোনার মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে আগামীর বাংলাদেশ হবে মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবাজমুক্ত বাংলাদেশ। মূল্যবোধের শিক্ষার এ প্রয়োজন পূরণে দেশের সব শিশুকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্ম শিক্ষার এ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সরকার সারা দেশে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।’ (প্রথম আলো : ২১ জানুয়ারি, ২০১০)

সে ঘোষণার ১০ বছর হতে চললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে স্কুলে একজনও মুসলমান শিক্ষক নেই, তাই হিন্দু শিক্ষকরা নিচ্ছেন ‘ইসলাম শিক্ষা’ ক্লাস! গণমাধ্যমে এসেছে, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্ম পড়াচ্ছেন হিন্দু শিক্ষক। কোথাও তো বছরের পর বছর ধরে ‘ইসলাম শিক্ষা’ পাঠদান ব্যাহত। সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির বারুগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১২ বছর ধরে ‘ইসলাম শিক্ষা’ ক্লাস নিচ্ছেন হিন্দু শিক্ষক। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান গুরুত্ব পেলেও ইসলাম শিক্ষা উপেক্ষিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষাকে আমরা যতই উপেক্ষা করছি, ততই বাড়ছে মাদকাসক্তি। আর এর নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি পড়ছে দেশের সব সেক্টরে।

ধর্মীয় শিক্ষা না থাকায় দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে মাদক গ্রাস করে নিলেও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকাসক্তির হার প্রায় শূন্যের কোটায়। মাদরাসা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক মাদকাসক্তির এ চিত্র থেকেই প্রমাণিত, প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা না পাওয়ার কারণেই শিক্ষার্থীরা বিপথে যাচ্ছে। মক্তবগুলো হারিয়ে গেছে আর আমাদের কিশোর ও যুবক শ্রেণিকে গ্রাস করেছে মাদক।

মূল্যবোধের শিক্ষার এ সংকট দূর করতে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের সে ঘোষণা দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। সে শিক্ষক শিশুদের কোমল হূদয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ তৈরি করবেন, মাদক ও জঙ্গিবাদসহ সব অপরাধের ব্যাপারে ঘৃণা তৈরি করতে সচেষ্ট হবেন। বিদ্যালয়েই শেখাবেন নামাজ, জানাজা, শুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত। পাশাপাশি সত্য কথা বলা, পরোপকার করা, বড়দের সম্মান ও শ্রদ্ধা করার মানসিকতা তৈরি করে দেবেন। এ ছাত্রটি বড় হয়ে সত্যবাদী হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিলে বাড়তি কোনো অর্থের প্রয়োজন হবে না। কেননা প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক আছে, ইসলাম শিক্ষার জন্য ক্লাসও নির্ধারিত থাকে; কিন্তু তা পড়ানোর জন্য ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক নেই। ফলে শিশুরা মানসম্মত ধর্মীয় শিক্ষক পায় না। যেহেতু ক্লাস আছে আর কেউ না কেউ তা পড়াচ্ছেন, তাই শিক্ষক নিয়োগের সময় নির্ধারিত পাঁচজনের একজনকে দাওরায়ে হাদিস বা কামিল পাস নিয়োগ দিলেই হয়। যেমন—সম্প্রতি বিদ্যালয়গুলোতে ২০ শতাংশ বিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে ক্রীড়া ও সংস্কৃতির শিক্ষক নিয়োগের।

তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সে ঘোষণা কার্যকর হলে এটি হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

লেখক: যুবায়ের আহমাদ
কলামিস্ট, গবেষক ও খতিব।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //