চোখের অশ্রুতে লেখা নন-এমপিও শিক্ষকদের বেদনার কাব্য

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ এমন কিছু কালাকানুনে পিঞ্জরাবদ্ধ, সেগুলো না তারা নিজেরা ছিন্ন করতে পারেন আর না তাদের কর্তৃপক্ষ এসব কালাকানুন দূর করার মানসিকতা পোষণ করেন। কালাকানুনের মধ্যে প্রধানতম হলো পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনুপাতপ্রথা। 

শিক্ষকতার বয়স ৮ বছর পূর্ণ হলেই সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু ৫:১ অনুপাতপ্রথার কারণে ৮ বছর কেন ৩০ বছরেও আর সহকারী অধ্যাপক হওয়া হয়ে ওঠে না। অবস্থা এমন যে, প্রভাষক থেকে শুরু আর প্রভাষক হিসেবেই সমাপ্তি। কিন্তু যেসব কলেজ নতুন, শিক্ষক কম সেসব কলেজের প্রভাষকগণ ৮ বছরেই সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। 

বর্তমান পদোন্নতি নীতিতে অনুপাতপ্রথা বহাল রেখেই আইন হয়েছে, অধ্যক্ষ হতে গেলে সহকারী অধ্যাপক পদে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ফলে নতুন কলেজের প্রভাষকগণ, প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক আবার সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যক্ষ হচ্ছেন। কিন্তু অনুপাত প্রথার কারণে অধ্যক্ষের শিক্ষক প্রভাষক পদেই থেকে যাচ্ছেন আজীবন। অর্থাত্ ছাত্র অধ্যক্ষ আর শিক্ষক প্রভাষক! এই পদোন্নতির অনুপাতপ্রথা বাংলাদেশের অন্য কোনো চাকরির ক্ষেত্রে নেই।

আবার বেসরকারি শিক্ষকগণ উৎসবভাতা পান ২৫ শতাংশ, যা অযৌক্তিক। ঢাকা শহরের দুই রুমের বাসা ভাড়া ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, অথচ সরকার থেকে বাড়িভাড়া দেওয়া হয় ১০০০ টাকা! বেসরকারি কলেজের শিক্ষকগণ সরকারি কলেজের শিক্ষকের মতো সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হতে পারেন না। সরকারি কলেজের শিক্ষকগণ এমফিল বা পিএইচডি করলে ইনক্রিমেন্ট পান, অথচ বেসরকারি কলেজের শিক্ষকগণ ইনক্রিমেন্ট পান না। 

শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা ভবন, ব্যানবেইস, এনটিআরসিএ-তে সরকারি কলেজের শিক্ষকগণ বিভিন্ন পদে নিয়োগ পান। কিন্তু বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের সে সুযোগ নেই। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের বদলির সুযোগ রাখা হয়নি। সরকারি কলেজের শিক্ষকগণ বেতন পান ১ তারিখে আর বেসরকারি কলেজের শিক্ষকগণ বেতন পান ১৩/১৪ তারিখে। বেসরকারি স্কুল-কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ পেনশন পান না। এই শিক্ষকগণ জ্ঞানের আলো জ্বেলেছেন অসংখ্য জনের, আজ তাদের খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। 

আর নন-এমপিও শিক্ষকদের কষ্টের কথা কলমের কালি দিয়ে লেখা যাবে না। চোখের অশ্রু দিয়ে লিখতে হবে তাদের ব্যথা-বেদনার কাব্য। আবার বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্সের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণও এমপিওভুক্ত হতে পারেন না। আর যারা এনটিআরসিএ-র নিবন্ধনপ্রাপ্ত তাদের অবস্থা আরো করুণ। শিক্ষকতার জন্য সনদপ্রাপ্ত কিন্তু নিয়োগ পান না। এনটিআরসিএ-র অদ্ভুত জটিল নিয়ম-কানুনের কারণে তাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয় না।

যেসব স্কুল-কলেজ অনেক পুরনো—৬০ থেকে ১০০ বছর বয়স অর্থাত্ স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত, সেসব স্কুল-কলেজ সরকারি হয় না। অথচ ৪/৫ বছর বয়সী স্কুল-কলেজও সরকারি হচ্ছে। যারা আজ সরকারি পর্যায়ে নীতিনির্ধারক আছেন, তাঁদের মধ্যে খুব কমই আছেন যাঁরা শিক্ষা গ্রহণের কোনো না কোনো স্তরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেননি। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বৈষম্য আর কালাকানুন দূর হয় না। বেসরকারি কলেজের এসব সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হলো শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা। শিক্ষকসমাজ আশা করে এই মুজিববর্ষে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ হবে।

মো. কামরুজ্জামান
প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, টিঅ্যান্ডটি কলেজ, ঢাকা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //