‘বে’ উপসর্গের যাঁতাকলে পিষ্ট এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারিরা

ছাত্রজীবনে বাংলা ব্যাকরণ পড়তে গিয়ে উপসর্গের সাথে প্রথম পরিচিতি। যেসব বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ধাতু এবং শব্দের পূর্বে বসে সাধিত শব্দের অর্থের পরিবর্তন, সম্প্রসারণ কিংবা সংকোচন ঘটায় তাদেরকে বলা হয় উপসর্গ। এদের কোনটি ইতিবাচক আবার কোনটি নেতিবাচক শব্দের উদ্ভব ঘটায়। যেমন- ফারসি ভাষা থেকে আগত ‘বে’ উপসর্গটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। বেহায়া, বেশরম, বেআক্কেল, বেগতিক, বেসরকারি ইত্যাদি শব্দগুলো নেতিবাচক রূপ পরিগ্রহ করেছে ‘বে’ উপসর্গের কারণে। ছাত্রজীবনে রপ্ত করা ‘বে’ উপসর্গটি যে পেশাগত জীবনে বঞ্চনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা আদৌ ভাবিনি। আমার মতো পাঁচ লক্ষাধিক এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারি এখন ‘বে’ উপসর্গের যাঁতাকলে পিষ্ট এবং বঞ্চনার শিকার।

ছাত্রজীবনে শিক্ষককে আদর্শ ও মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে অন্তরে লালন করেছি। সমাজে তাদের সম্মান বিরল তা নিজ চোখে দেখে মনে মনে সংকল্প এঁটেছি বড় হয়ে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেব। তাই সকল লোভ লালসাকে পেছনে ফেলে সরকারি লোভনীয় চাকরির সকল যোগ্যতাকে ছাপিয়ে শিক্ষকতার ন্যায় মহান ব্রতে আত্ননিয়োগ করি। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, শিক্ষকতা পেশার সে মর্যাদা আজ আর নেই, বলা যায় একেবারেই তলানীতে। এ পেশায় ২৬ বছর অতিক্রান্ত করেছি, অনেক দেখেছি, বুঝেছি। শিক্ষকরা আজ নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। শিক্ষার্থী কিংবা সরকারি আমলা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এমনকি স্থানীয় হোমরা চোমরা কর্তৃক শিক্ষককে অপমান অপদস্ত করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। তাছাড়া শিক্ষকদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গরিমসি খুবই বেদনাদায়ক।

সরকারি বেসরকারি শিক্ষকদের প্রাপ্য সুবিধাদির মধ্যে বৈষম্য আকাশ-পাতাল। আমি বেসরকারি শিক্ষক হলেও সরকারি বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি এমপিওভূক্ত এবং বেতনের নামে লজ্জাস্কর অনুদানপ্রাপ্ত। আমার রাইফেল আছে গুলি নাই। আমি জাতীয় বেতন স্কেলের ৭ম গ্রেডের অন্তর্ভূক্ত হলেও আমার নিম্ন গ্রেডের কর্মকর্তা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। আমার চাকরি স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির মর্জির উপর নির্ভর করে। পান থেকে চুন খসলেই চাকরিচ্যুতি। তাই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করেও শুধুমাত্র বেসরকারি উপাধির কারণে আমরা আজ নিগৃহিত। কিন্ত আমার বড় পরিচয় আমি শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর। আমি বেসরকারি শিক্ষক এ নহে মোর অপরাধ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। শিক্ষায় অবকাঠামোগত প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো চরম বৈষম্যমূলক, গতানুগতিক নানা ধারায় বিভাজিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো আরো অনেক আগেই মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ হতো। বর্তমান সরকার হাজার হাজার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে। মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়েও কিছুকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছে। কিন্তু একসাথে জাতীয়করণ না করার কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক তথা পুরো দেশবাসী।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনে অবৈতনিক শিক্ষার কথা তথা জাতীয়করণের কথা উল্লেখ থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়াও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ২৫% ঈদ বোনাস দীর্ঘ ১৭ বছরেও পরিবর্তন হয়নি। অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকগণ দীর্ঘ ২৮ বছরেও এমপিওভুক্ত হতে না পেরে চরম অর্থসংকটে দিনযাপন করছেন। এছাড়াও এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারি এবং সরকারি শিক্ষক-কর্মচারিদের মধ্যে বেতন বৈষম্য আকাশ ছোঁয়া।

এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী শুধুমাত্র মূল বেতনের শতভাগ বেতন প্রদান করা হয়। তাছাড়া বাড়ীবাড়া নির্ধারিত ১০০০ টাকা, চিকিৎসাভাতা নির্ধারিত ৫০০ টাকা, উৎসব বোনাস শিক্ষক ২৫%; কর্মচারি ৫০%। ১২,৫০০ টাকা এবং ১৬,০০০ টাকা স্কেলে নিয়োগকৃত সহকারি শিক্ষকদের পরবর্তী বেতন স্কেল নির্ধারণ নাই, সরাসরি প্রমোশন নাই এবং বদলিও নাই। প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ২৯,০০০ টাকা (৭ম গ্রেড), বিভাগীয় ভাতাদি নাই। এককালীন সামান্য অবসর ভাতার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু মাসিক পেনশন নাই।

অভিভাবকগণকে তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য অনিয়ন্ত্রিত ও ব্যাপক ব্যয় করতে হয়। শিক্ষকের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা নেই। অপরদিকে সরকারি শিক্ষকদের ২০১৫ এর জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী সকল সুযোগসুবিধাসহ বেতন প্রদান করা হয়।

স্কেল ভিত্তিক পূর্ণ বাড়িভাড়া প্রদান করা হয়, চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা, উৎসব বোনাস স্কেল ভিত্তিক প্রদান করা হয়, পরবর্তী স্কেল নির্ধারণকৃত ও চলমান আছে, ধারাবাহিক প্রমোশন আছে ও বদলির ব্যবস্থা চলমান, প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ৩৫,৫০০ টাকা (৬ষ্ঠ গ্রেড), বিভাগীয় ভাতার ব্যবস্থা আছে, পরিপূর্ন অবসর ভাতাসহ মাসিক পেনশন আছে, অভিভাবকগণকে তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য স্বল্প ও নির্ধারিত ব্যয় করতে হয়, শিক্ষকের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা আছে।

সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য থাকায় শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ বিশ্বমানের শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ ঘোষণা অতীব জরুরী। তাই ‘বে’ উপসর্গের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে মুজিববর্ষেই মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার উদ্যোগী হবেন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

লেখকঃ প্রধান শিক্ষক, পীরকাশিমপুর আর এন উচ্চ বিদ্যালয়, মুরাদনগর, কুমিল্লা। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //