এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ঐচ্ছিক বদলি

আমি মুহাম্মদ আলী। বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে আমার জন্ম। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে আমার শৈশব আর কৈশোর কেটে গেছে এখানেই। কেটে গেছে তারুণ্যও। অতটা ভালো ছাত্র আমি ছিলাম না। আবার পারিবারিক সাপোর্ট কিংবা সুযোগ-সুবিধারও ছিল অনেকটাই ঘাটতি। বলতে গেলে আমার পরিবারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এখন পর্যন্ত আমিই সর্বোচ্চ শিক্ষিত। তাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, উপযুক্ত দিক নির্দেশনা বা উপদেশ কোনোটাই আমি পাইনি। তবুও যতটুকু পরিবার থেকে পেয়েছি তাতেই সন্তুষ্ট।  বুধবার (১৬ মার্চ) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, পড়াশোনার সুবাদে রংপুরে থেকেছি। আমার স্বপ্নটা কখনোই এত বড় ছিল না যে স্বপ্ন আমাকে আকাশ ছুঁইয়ে দেবে। তবে ছোট ছোট স্বপ্ন আমিও দেখতাম। মোটামুটি চাকরি করব। স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাব। সুখে-দুঃখে পরিবারের সবার সঙ্গে থাকব। ইত্যাদি। কিন্তু আমলনামায় ঘাটতি ছিল। তাই স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ দেখেনি। যদিও অনেক চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি। দু-চারটে ভাইবাও দিয়েছি। অনার্স পাস করেই দ্বাদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। স্বপ্ন দেখি শিক্ষক হওয়ার। আমি এখন পর্যন্ত তিনটি গণবিজ্ঞপ্তি পাই। প্রথম গণবিজ্ঞপ্তিতে আমার উপজেলায় আমার বিষয়ে তিনটি পদ শূন্য দেখায়। তিনটিতেই আবেদন করি। রেজাল্ট হওয়ার পর দেখলাম একজন মহিলা প্রার্থী তিনটিতেই টিকেছেন। পরে জানতে পারলাম পদগুলো মহিলা কোটা ছিল।

এরপর দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো। আবারো আমার নিজ উপজেলায় তিনটি শূন্যপদ দেখাল। এবার নিজ উপজেলার তিনটিসহ রংপুর বিভাগে মোট ২৬টি আবেদন করলাম। রেজাল্ট হওয়ার পর দেখলাম আমার উপজেলার তিনটিই মহিলা কোটা। অন্যগুলোতে মহিলা কোটা এবং উভয়ের জন্য থাকলেও সেগুলোতে আমার রেজাল্ট আসেনি। যারা এসেছেন তার আমার চেয়ে বেশি নম্বরধারী। আফসোস করিনি। এরপর অনেক মামলা আন্দোলনের পর তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এবার মহিলা কোটা এবং মহিলা পুরুষ উভয় কোটা উল্লেখ করে দেয়। এবার দেখে দেখে চার শতাধিক আবেদন করি পুরো বাংলাদেশে। তৃতীয় নিয়োগচক্রে আমার নিজ উপজেলা থেকে প্রায় সাতশ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম জেলার দ্বীপ উপজেলা স›দ্বীপের একটি দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক হিসেবে সুপারিশ পেয়ে যোগদান করেছি। যেখানে দুর্গম সাগর (স›দ্বীপ চ্যানেল) পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ কঠিন। স›দ্বীপ থেকে আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। জরুরি প্রয়োজনে বাড়ির আশা একদমই করা যাবে না। নিকট আত্মীয় বা পরিবারের কেউ মারা গেলে তার জানাজা বা দাফনকার্যে শরিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া একবার যাতায়াত খরচ কমপক্ষে ৪ হাজার টাকা। আর আমি সর্বসাকল্যে বেতন পাব ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। যা দিয়ে এখানে থাকা-খাওয়াই খুব কষ্টকর। পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা তো অনেক দূরের কথা। এমতাবস্থায় আমি কীভাবে এখানে চাকরি করতে পারি? 

অনেকেই বলবেন, আপনি জেনেশুনে এখানে আবেদন করেছেন, এ দায় আপনারই। হ্যাঁ, আমি জেনেশুনেই আবেদন করেছি। কেননা আমার যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আর চাকরিটা ছাড়তেও পারব না। আমার অবস্থান আমার চেয়ে আর কেউ ভালো বুঝবেন না। কিন্তু সরকার বাহাদুর ও তার নীতিনির্ধারক যারা রয়েছেন তারা কি কখনো ভেবে দেখেন না যে, একজন মানুষ কীভাবে মাত্র সাড়ে ১২ হাজার টাকায় এত দূরে গিয়ে তার সংসার চালাবেন? এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া মাত্র ১ হাজার টাকা। এই টাকায় বস্তির একটা ঝুপড়ি ঘরও ভাড়া পাওয়া যায় না। চিকিৎসা ভাতা দেয়া হয় মাত্র ৫০০ টাকা। তিন হাজার টাকা উৎসব বোনাস দিয়ে শিক্ষকদের করা হয় তিরস্কার। আসলে কি আপনারা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মানুষ মনে করেন? নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন। নিজেদের অবস্থান আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবস্থান তুলনা করুন। সুতরাং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর ও তদসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের কাছে আকুল আবেদন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, শতভাগ উৎসব বোনাস, চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ভাতা প্রদানসহ ঐচ্ছিক বদলির সুযোগ প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রজ্ঞাপন ও নীতিমালা জারির আকুল আবেদন করছি।

লেখক : এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //