৯ম পে-স্কেল: সরকারি কর্মচারীদের শেষ ভরসা প্রধানমন্ত্রী

লাখ লাখ টাকা খরচ করে ডাকঢোল পিটিয়ে বিদ্যমান বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সকলস্তরের কর্মচারীদের জন্য একটি সুষম পে-স্কেল ঘোষণার উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন করা হলো ২০১৩ সালে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরকে প্রধান করে গঠিত কমিশন মাঠপর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করলো, যাছাই-বাছাই করে একটি সুষম পে-স্কেল প্রস্তাব ও করেছিলো। সেখানে সর্বনিম্ন বেতন স্কেল ১৮,০০০/- টাকা এবং গ্রেড সংখ্যা ২০ থেকে কমিয়ে ১২ করার প্রস্তাব করা হয় বলে শুনা যায়।

উপরস্তরের কর্মকর্তাদের অনুরোধে সেটা পরিবর্তীত হয়ে সর্বনিম্ন স্কেল ১২,০০০/- টাকা এবং গ্রেড সংখ্যা ১৬ করা হয়; কিন্তু সুবিধাভোগীদের শকুনি দৃষ্টি বলে কথা। তাঁরা সরকারকে ভুল বুঝিয়ে পে-কমিশনের প্রস্তাবনা বাস্তব সম্মত নয় বলে উক্ত প্রস্তাবনাকে কচুকাটা করার্থে গঠন করলো সচিব কমিটি। লাখ লাখ টাকা খরচ করা পে-কমিশনের প্রস্তাবনা যদি সচিব কমিটি দিয়ে কাটাকুটি করতে হয় তাহলে পে-কমিশনের প্রয়োজনটা কি ছিলো? সচিব মহোদয়গণকে দিলেই তো তারা তাদের বিজ্ঞতার বলে একটা পে-স্কেল দিতে পারতো। সেক্ষেত্রে সরকারের এতো অর্থের অপচয় হতো না, এতা লঙ্কাকাণ্ডও ঘটতো না। 

যাহোক শেষ পর্যন্ত সচিব কমিটি দিয়েই কাটাকুটি করে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশ করা হলো। ফলে যা হবার তাই হলো। যেই লাউ সেই কদু। বৈষম্যতো কমলো না, আরো বাড়লো এবং চরমভাবে বাড়লো। গ্রেড সংখ্যা ১২ বা ১৬টাতে নামা দূরে থাকুক বরং কমার পরিবর্তে ২টি বেড়ে গ্রেড হলো ২২টা। ২০তম গ্রেডের উপর আরো দুটি গ্রেড লুকোচুরি খেলার মতো লুকিয়ে রেখে পে-স্কেল ঘোষণা হলো।

সেখানে যে চরম বৈষম্যের নতুন দেয়াল রচনা করা হলো তা একটুখানি খেয়াল করলেই যে কারো কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে।

১ম গ্রেডে বেতন স্কেল ৭৮,০০০ টাকা; কিন্তু ২০তম গ্রেডে মাত্র ৮,২৫০ টাকা। আবার ১ম গ্রেডের উপরে আরও দুটি গ্রেড রয়েছে।

২০তম গ্রেড থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত মোট ৮টা গ্রেড মিলিয়ে যেখানে বেতন বাড়ে মাত্র ৩০৫০ টাকা, সেখানে ৭ম গ্রেড থেকে মাত্র ১টা গ্রেড পেড়িয়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে গেলেই বেতন বাড়ে ৬৫০০ টাকা, দ্বিগুণেরও বেশি! ২য় গ্রেড থেকে ১ম গ্রেডে একটা গ্রেড পরিবর্তনে যেখানে বেতন বাড়ে ১২০০০ টাকা, সেখানে শেষের দশটা গ্রেড মিলিয়ে বেতন বাড়ে মাত্র ৭৭০০ টাকা! গ্রেড ১- ১০ নং এর মোট পার্থক্য- ৬৫,৫০০ টাকা অপরদিকে গ্রেড ১১-২০ নং এর পার্থক্য মাত্র- ৪,২৫০ টাকা।

আবার নিচের দিকের এক গ্রেড থেকে পরের গ্রেডের পার্থক্য মাত্র ২ থেকে ৩শ টাকা যা তাদের সাথে মজা করা বা তামাশা করার মতো। ২০১৫ সালের পে-স্কেলের আগে নিয়ম ছিল, আট বছর চাকরি পূর্ণ হলে প্রথমবারের মতো গ্রেড উন্নীত হবে, যাকে টাইম স্কেল বলা হতো। ২০১৫ সালের পে-স্কেলে তা বাদ দিয়ে নিয়ম করা হয়- ১০ বছর চাকরির পর প্রথমবারের মতো গ্রেড পরিবর্তন হবে। ধরা যাক, একজন ১৮ নম্বর ধাপে চাকরি শুরু করেছেন। ১০ বছর অপেক্ষার পর তার বেতন বাড়বে ২০০ টাকা। এটা কি চরম অপমান ও ঠাট্টা-তামাশার বিষয় নয়?

যেখানে নিচের শ্রেণীর এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ২০০-৩০০ টাকা, আর উপরের এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। সব গ্রেডে সমানহারে বেতন বাড়লে ক্ষতি কী? বেতন গ্রেডের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্নের পার্থক্য বের করে ১৯ দিয়ে ভাগ করলে যা হয় (৭৮০০০-৮২৫০/১৯=৩৬৭১ বা ৩০০০/৪০০০), প্রতি গ্রেডে পার্থক্য তাহলে অসুবিধা কোথায়?

২০তম গ্রেড ৮২৫০/- আর ১০তম গ্রেড ১৬০০০/- এই রেশিওমতে ১ম গ্রেড হওয়ার কথা ৩২০০০/-

কিন্তু সেটা.......... ???

আবার ১০তম গ্রেডের প্রারম্ভিক বেতন ১৬০০০/- তিন ধাপ পার হয়ে ৩৫,৫০০/- বৃদ্ধির হার ১২২%
২০তম গ্রেডের প্রারম্ভিক বেতন-৮২৫০/- তিন ধাপ পর হয়ে ৯,৩০০/- বৃদ্ধির হার ১২%
১০ম গ্রেডে প্রারম্ভিক বেতন ১৬০০০/- তিন ধাপ পর হয়ে ৩৫,৫০০/- বৃদ্ধির হার ১২১%।
১৬তম গ্রেডে প্রারম্ভিক বেতন ৯৩০০/- তিন ধাপ পর হয় ১১,৩০০/- বৃদ্ধির হার ২১%
১০ তম গ্রেডে ১৬০০০/- আর ১ম গ্রেডে ৭৮,০০০/- বৃদ্ধির হার ৩৮৭%
২০তম গ্রেডে ৮২৫০/- আর ১১তম গ্রেডে ১২৫০০/- বৃদ্ধির হার ৫১% কিন্তু কেন???

তা্ইতো বর্তমান বাজারে নিম্নপদস্থ কর্মচারীগণ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। তাদের অবস্থা এখন অনেকটা জিম্মি দশার মতো। ২০ গ্রেডের ৮,২৫০/- টাকা স্কেলের একজন কর্মচারী সব মিলিয়ে ১৪,৪৫০/- টাকা পায় যা দিয়ে বর্তমান বাজারদরে ০৬ (ছয়) সদস্যের পরিবারের পুরো মাসের যোগান দেওয়া অসম্ভব। ২০০ টাকার টিফিন ভাতায় এক মাস টিফিন খাওয়া সম্ভব?

আবার একই ডিপার্টমেন্টের একই গ্রেডের একই পে-স্কেলের একটি পদের পদন্নোতি হচ্ছে অন্য পদের পদন্নোতি নেই। সারাজীবন একই পদে চাকুরি অথবা নামমাত্র পদোন্নতি নিয়ে অবসরে যাচ্ছে তারা। চাকুরী জীবনে যেমন চরমভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে উপরন্তু বেতন স্কেল না বাড়ায় তাঁর পেনশনও অনেক কম। অর্থ্যাৎ বুড়ো বয়সের অবসর জীবনেও তাকে খেয়ে না খেয়ে মরতে হবে ধুঁকে ধুঁকে। কিন্তু কেন এত বৈষম্য থাকবে? দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীীতবাজরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ দেশের জন্য যারা খাটছে তাদের সামান্য কটা টাকা বাড়তি দেয়াতে সরকার দেওলিয়া হয়ে যাবে???

উপরের গ্রেডের চাকরিজীবীরা হয়তো বলতে পারেন, নিচের দিকের গ্রেডগুলোতে জনবল বেশি। তাই তাদের বেশি বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। দেশের প্রতি তাদের এতই যদি মায়া থাকে, তাহলে নিজেদের গ্রেডগুলোর মধ্যকার পার্থক্য এত বেশি কেন? এমনিতেই উপরের দিকের গ্রেডে চাকরি করছেন, এরপর বেতন বৃদ্ধি যদি নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে দু’-তিন গুণ বেশি হতো, তবু কম হতো না। কিন্তু তাদের বেতন বাড়ে নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে ২০-২৫ গুণ বেশি। তাদের এত বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতির ওপর কি চাপ পড়ে না? এসব হচ্ছে বাহানা। নিজেরা বেতন কম নিয়ে দেশপ্রেমের কথা বললে তা সত্যিকার দেশপ্রেম হতো।

প্রয়োজন ইতিবাচক চিন্তার। উচ্চস্তরের চাকরিজীবীদের মধ্যে অতি স্বল্প সংখ্যক আমলা নামের আকামের কামলাদের হিংসুটে থাবা থেকে দেশের অসহায় জনগণ ও নিম্নস্তরের কর্মচারীদের মুক্তি দিতে না পারলে দেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়।

তাই সকল ডিপার্টমেন্টের সকল পদের কর্মচারীদের পদন্নোতি থাকতে হবে, পদোন্নতির পদ না থাকলে ৫ (পাঁচ) বছর পর পর উচ্চতর গ্রেড প্রদান করতে হবে। বৈষম্য কমাতে গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে।

সমস্যা হলো, নিম্নস্তরের কর্মচারীদের চাপা কান্না শোনার মতো কেউ নেই। শোষিতজনের আর্তনাদে দরদী হওয়ার জন বর্তমানে নেই। একজন ছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নস্তরের কর্মচারীগণের দাবীর পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার হয়েছিলেন। সেই নেতা নেই, তর্জনীর সাবধানী সংকেত আর বজ্রকন্ঠের হুংকারও নেই। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো নব্যযুগের মীর জাফররা। সেই মীর জাফরের দোষররা আজো কৌশলে অসহায় মানুষের রক্ত পান করে চলেছে। তাঁর কন্যা মজলুম মানুষের প্রতি সংবেদনশীল হলেও সুবিধাভোগীরা চারপাশে এমন দেয়াল তৈরি করে রেখেছেন যাতে মজলুমের কান্না তাঁর কানে পৌঁছাতে না পারে।

তাই বঞ্চিত মানুষের একতা যেমন প্রয়োজন তেমনি বঞ্চণার খতিয়ান মানবতার নেত্রী, উন্নয়নের কাণ্ডারি, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নজরেও নেয়া প্রয়োজন।

এছাড়া এমন বঞ্চনা হতে আশু মুক্তির আর কোন পথ আপাতত খোলা আছে বলে মনে হয় না।

এম এ হাশেম
সাবেক সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব
কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের কর্মচারী সমিতি, ঢাকা
এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কর্মচারী কল্যাণ সমিতি
বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, চট্টগ্রাম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //