বইপড়ুয়া জাতির তালিকায় নাম নেই কেন?

একবিংশ শতাব্দীর তরুণ সমাজ বই পড়ার চর্চা থেকে অনেকটা দূরে। সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানবিষয়ক বই পড়ার অভ্যাস তরুণ সমাজের মধ্যে এখন খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। আধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাব জীবনকে করেছে সহজ থেকে সহজতর, উন্নত থেকে উন্নততর; কিন্তু নানা উদ্ভাবনের অন্তরালে তরুণরা বাস্তবিক জগত থেকে সরে গিয়ে ভাচু‌র্য়াল জগতে আসক্ত হয়ে পড়েছে।

মাকড়সার জালের মতো স্মার্টফোন জাল ছড়িয়ে লাখ লাখ তরুণকে আবদ্ধ করে ফেলেছে। মন চাইলেও এর থেকে মুক্তি মেলা দায়!

একসময় দেখা যেত, বাচ্চারা সন্ধ্যায় দৌড়াদৌড়ি করে ঘরে ফিরত এবং হাত মুখ ধুয়ে দ্রুত পড়ার টেবিলে বসত। পড়া শেষে খাওয়াদাওয়া করে বিছানায় শুয়ে পড়ত। বাবা-মা অথবা বয়স্করা তাদের বিভিন্ন কিসসা-কাহিনি কিংবা রূপকথার গল্প শোনাত এবং গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত। বর্তমান সময়ে ঠিক এর উলটো চিত্র দেখা যায়। সন্ধ্যায় বা রাতে তাদের হাতে বই থাকার বদৌলতে থাকে স্মার্টফোন।

এমনকি খাবারের সময়ও তাদের হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে খাবার খাওয়াতে হয়। এক্ষেত্রে অভিভাবকরা কম দায়ী নয় কোনো অংশে। তারাও স্মার্টফোনে সমান তালে ব্যস্ত। বই পড়ার চর্চা তাদের মধ্যেও আশানুরূপভাবে দেখা যায় না। তাছাড়া, তরুণ সমাজের উন্নতির অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে মাদকাসক্তি। অবাধে তারা মাদক সেবন করছে। পাঠাগারে একসঙ্গে বই পড়ার চর্চা করা বাদ দিয়ে অনেক তরুণ মাদকচক্রে জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে অধিকাংশ লাইব্রেরি দেখা যায় পাঠকশূন্য, বইগুলো ঘুণে খাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা। বেকারত্বের সমস্যা ঘোচাতে প্রকৃত সাহিত্যের চর্চা বাদ দিয়ে একগাদা গাইড বই মুখস্হ করা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তাদেরকে। অনেকে একাডেমিক পড়ায় ফাঁকি দিয়ে চাকরির পড়ায় বেশি সময় দিচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্হাকে কর্মমুখী করতে হবে। আনন্দের সঙ্গে পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।

সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বলছেন, অবসরে তারা ফেসবুকে চ্যাট করেন। আর ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশের ভাষ্য, অবসরে তারা উপন্যাস পড়েন। ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ বই পড়ার চেয়ে ফেসবুকে সময় কাটাতে কিংবা ইউটিউবে মুভি দেখতে বেশি পছন্দ করেন। এরকম প্রতিটি জরিপেই বইবিমুখকতার চিত্র পরিলক্ষিত হয়।

বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, সারা পৃথিবীতেই বই পড়ার হার কমছে। বইপড়ুয়া জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে স্হান করে নিতে চলেছে ভারতীয়রা। শীর্ষ বইপড়ুয়া জাতির তালিকায় টানা দুই বছর ধরে প্রথম স্হান অধিকার করে আছে প্রতিবেশী এই দেশের মানুষ। গত বছর ভারতের মানুষ সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা ৪২ মিনিট ব্যয় করেছে বই পড়ার পেছনে। বলা ভালো, ১২০ কোটি জনসংখ্যার দেশে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণেই ভারতীয়রা বই পড়ার দিক থেকে এগিয়ে থাকবে, এটা স্বাভাবিক।

তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ভারতে সাক্ষরতার হার কম হলেও যারা মোটামুটি শিক্ষিত, তারা বই পড়ার পেছনে বেশি সময় ব্যয় করেন। জরিপ অন্তত সেটাই প্রমাণ করে। ভারতের পরের অবস্হানে রয়েছে থাইল্যান্ড। বই পড়ায় তারা ব্যয় করে ৯ ঘণ্টা ২৪ মিনিট। তৃৃতীয় অবস্হানে রয়েছে চীন। চীনের মানুষ বই পড়ে সপ্তাহে ৮ ঘণ্টা। এই তালিকায় বাংলাদেশের কোনো নাম নেই। এখন প্রশ্ন হলো কেন বই পড়ব? এর গুরুত্ব কী?

জ্ঞান বৃদ্ধি, নুতন জ্ঞান সংগ্রহ, শারীরিক উন্নতি, মানসিক উন্নতি, কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি, স্মৃতি শক্তি বাড়ায়, স্ট্রেস কমায়, হতাশা কমায়, আয়ু বাড়ায়, কমিউনিকেশন স্কিল বাড়ায়, স্মার্টনেস বাড়ায় বই। হতাশা আর স্ট্রেস যদি জীবন থেকে সরে যায়, আয়ু তো বাড়বেই। মন যখন স্মার্ট, সাহসী, বড় বড় স্বপ্ন দেখে, বই পড়ে পড়ে শুধু পজিটিভ কথাবার্তা মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তখন তো সেই মনের মধ্যে পজিটিভ শক্তির সৃষ্টি হবেই। বই পড়ার অভ্যাস থাকলে বই বার্ধক্যের দুঃখ ঘোচাতে সাহাঘ্য করবে—বার্ধক্যে একমাত্র সাথি কিন্তু বই-ই হবে। বই মেলা থেকে বই কিনে শুধু শেলফে সাজিয়ে রাখলেই চলবে না, প্রয়োজন যথাযথ ব্যবহার তথা বেশি বেশি বই পড়া।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //