দিনাজপুরের ঐতিহাসিক রাজবাড়ি

প্রত্নতাত্বিক ও ঐতিহ্য বিবেচনায় দিনাজপুর জেলাটি সবার কাছেই সুপরিচিত। বিশেষ করে বিখ্যাত বেদানা লিচু ও অন্যান্য জাতের সুস্বাদু লিচু ছাড়াও আরও বেশ কিছু জাতের আমের জন্য রয়েছে এই জেলাটির সুনাম। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১২-১২০ ফুট গড় উচ্চতায় অবস্থিত দিনাজপুর। ভৌগোলিকভাবে এ জেলা ২৫০১৪ এবং ২৫০৩৮ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮০০৫ ও ৮৫০২৮ ডিগ্রী দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। মোট ১৩ টি উপজেলা নিয়ে গঠিত জেলার আয়তন ৩৪৩৭.৯৮ বর্গ কিলোমিটার।

২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ৩৩,১৫,২৩৮ জন, যার মধ্যে পুরুষ ১৬,৬০,৯৯৭ জন এবং মহিলা ১৬,৫৩,৩০৫ জন। উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে জেলাটির উত্তরে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়, দক্ষিণে গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট, পূর্বে নীলফামারী ও রংপুর জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পর্যন্ত ছড়িয়ে।

লোকশ্রুতি রয়েছে, জনৈক দিনাজ অথবা দিনারাজ দিনাজপুর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারেই রাজবাড়ীতে অবস্থিত মৌজার নাম হয় দিনাজপুর। পরবর্তীতে বৃটিশ শাসনামলে ঘোড়াঘাট সরকার বাতিল করে বৃটিশরা নতুন জেলা গঠন করে রাজার সম্মানেই জেলার নামকরণ করে দিনাজপুর।

কোম্পানী আমলের নথিপত্রে প্রথম দিনাজপুর নামটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। তবে ভৌগলিকভাবে দিনাজপুর মৌজাটি অতি প্রাচীন। দিনাজপুরের ভূতপূর্ব কালেক্টর ও বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ মিঃ ওয়েষ্ট মেকট সর্বপ্রথম দিনাজপুর নাম ও তার উৎস উদঘাটন করেন বলে প্রসিদ্ধ রয়েছে।

দিনাজপুর জেলার বর্তমান আয়তন ৩৪৩৭.৯৮ বর্গ কিলোমিটার। তবে পূর্বে এ জেলা আয়তনে ছিল সুবিশাল। পাল রাজবংশের চরম উন্নতির সময়ে দিনাজপুর সমগ্র রাজশাহী বিভাগ ও ঢাকা জেলার বেশকিছু অঞ্চল জুড়ে ছিল। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে ও মুসলিম রাজত্বের পতনের সময়ে বর্তমান মালদহ ও বগুড়া জেলার প্রায় পনের আনা এবং রংপুর, রাজশাহী ও পুর্নিয়া জেলার অনেকাংশ দিনাজপুরের অন্তর্ভূক্ত ছিল। ঐতিহাসিক বুকানন এর আয়তন ৫৩৭৪ বর্গমাইল বলে উল্লেখ করেছিলেন।

পরে ইংরেজ আমলের মাঝামাঝির দিকে অর্থাৎ ১৭৫৭ হতে ১৮৬১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পরিচালিত এক রাজস্ব জরিপে সুবিশাল ভূ-ভাগের আয়তন কমিয়ে ৪,৫৪৩ বর্গমাইলে আনা হয়। ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে তা ৪,১৪২ বর্গমাইলে নেমে আসে এবং ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে আয়তন দাঁড়ায় ৩,৯৪৬ বর্গমাইলে।

উল্লেখ্য, ১৮০০ হইতে ১৮০১ খৃষ্টাব্দে দিনাজপুরের বড় বড় এষ্টেট পূর্ণিয়া, রংপুর এবং রাজশাহী জেলার সংগে যুক্ত করা হয়। আর ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে আর একটি বড় অংশ বগুড়া ও মালদহ জেলার সাথে যুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত আর কোন রদবদল করা হয়নি।

আজ আমরা এ জেলার ঐতিহাসিক রাজবাড়ি সম্পর্কে জানব।


'রাজবাটী' গ্রামের সন্নিকটে এই স্থানটি রাজ বাটিকা নামে বিশেষভাবে পরিচিত। উল্লেখ্য যে, প্রাচীন এই রাজ বাড়িটির নামেই গ্রামের নামকরণ হয়েছে যা সদরের কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনালের দক্ষিনে অবস্থিত।

ইতিহাস

দিনাজপুর রাজবাড়ি ও রাজ্য রাজা দিনরাজ ঘোষ এটি স্থাপন করেন। আবার অনেকের মত, পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে ইলিয়াস শাহীর শাসনামলে সুপরিচিত রাজা গণেশ এই বাড়ির স্থপতি। রাজা দিনরাজ ঘোষ গৌড়েশ্বর গণেশনারায়ণের (১৪১৪-১৪১৮ খ্রি:) অন্যতম রাজকর্মচারী। আর তিনি ছিলেন উত্তর রাঢ়ের কুলীন কায়স্থ । রাজা দিনরাজের নাম থেকেই রাজ্যের নাম হয় 'দিনরাজপুর', যা বারেন্দ্র বঙ্গীয় উপভাষায় পরিবর্তিত হয়ে দিনাজপুর নাম ধারণ করে ।

ইতিহাস বেত্তারা বলেন, গৌড় সংলগ্ন সনাতনী রাজ্য দিনাজপুর পাঠান, মুঘল ও নবাবদের বহু যুদ্ধে পরাস্ত করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে শ্রীমন্ত দত্ত চৌধুরী দিনাজপুরের জমিদার হন। কিন্তু শ্রীমন্ত দত্ত চৌধুরীর ছেলের অকাল মৃত্যুর পর ভাগ্নে সুখদেব ঘোষ তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হন।

১৭২২ সালের দিনাজপুর যুদ্ধ

দিনাজপুরের মহারাজা প্রাণনাথ রায়ের শাসনকালে রাজ্যের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে । সেসময় মুঘল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগে তিনি তার প্রতিবেশী মুঘল অধিকৃত অঞ্চলের জমিদার ও তালুকদারদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে নিজ রাজ্যের পরিধিও বাড়িয়ে নিয়েছিলেন । মাত্র চল্লিশ বছরের শাসনকালে দিনাজপুর রাজ্য বাংলার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর পর মুর্শিদাবাদের নবাব রূপে মসনদে বসেন শুজাউদ্দীন মুহম্মদ খাঁ । ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার প্রদেশ বাংলা নবাবি'র সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এই সময় শুজাউদ্দীন ঢাকায় এবং বিহার ও উড়িষ্যা শাসনের জন্য আরও দুইজন নায়েব নাজিম নিযুক্ত করেছিলেন।

এদিকে ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথ মারা গেলে তার উত্তরাধিকারী রাজা রামনাথ রায় রাজসিংহাসনে বসে রাজা রামনাথ পতিরাম, পত্নীতলা ও গঙ্গারামপুর অঞ্চল নিজ অধিকারে আনেন । পরে তিনি গৌড়ের পথে মালদহের চাঁচল, খরবা ও গাজোল পরগনা অধিকার করতে থাকেন । সামগ্রিকভাবে তাঁর রাজ্যের আয়তন ও সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি লাভ করে।

রাজা রামনাথের ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য নবাব সুজাউদ্দিন অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েন । তিনি রংপুরের নব নিযুক্ত মুঘল ফৌজদার সৈয়দ মহম্মদ খাঁ কে দিনাজপুর আক্রমণ ও দখলের আদেশ দেন ।

কথিত যে, সৈয়দ মহম্মদ খাঁ এক বিশাল সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে দিনাজপুর শহরে নিকটবর্তী রাজবাড়ি আক্রমণ ও লুট করতে এগিয়ে আসেন। এসময় রাজা রামনাথও প্রত্যুত্তরে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে  এগিয়ে চললেন সৈয়দ মহম্মদ খাঁ ও তার নবাবি সৈন্যবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে। দুপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধে সৈয়দ মহম্মদ খাঁ পরাজিত হয়ে শেষ পর্যন্ত রাজা রামনাথের হাতে বন্দীলাভ করেন।

অবশেষে মুর্শিদাবাদের নবাব সুজাউদ্দিন খান, রাজা রামনাথ রায়ের সাথে সন্ধি করে নবাবের অনুরোধে পরাজিত সৈয়দ মহম্মদ খাঁকে ছাড়িয়ে নেন।

বর্গী আক্রমণে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা 

রাজা রামনাথ (১৭২২-৬০) প্রায় বিয়াল্লিশ বৎসর দিনাজপুরের মহারাজ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার শাসনামলে বাংলায় বর্গীদের আক্রমণ ঘটে । বর্গীদের ভয়ে লোকেরা ভাগীরথীর পূর্বদিকে পালিয়ে যেতে লাগল। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিবছর বর্গীরা বাংলায় এসে গ্রাম ও নগর আক্রমণ করে লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালিয়েছিল বাংলার মানুষের উপরে।

আর বরেন্দ্রভূমিতে বর্গী আক্রমণ সফলভাবে প্রতিহত করেন দিনাজপুরের রাজা রামনাথ রায় । তিনি রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিরক্ষার জন্য ১০টি কামান নিযুক্ত করেছিলেন বলে কথিত রয়েছে।

ফলে বর্গীরা দিনাজপুর, মালদহ, রাজশাহী, রংপুরে তেমন কোনও তৎপরতা চালাতে অক্ষম হলে এ অঞ্চলগুলোতে বর্গী অত্যাচারের বীভৎসতা থেকে রক্ষা পায় ।

গঠন প্রণালী

বর্তমানে দিনাজপুর রাজবাড়ি বলতে এর অবশিষ্টাংশকে বুঝায়। বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু গুটিকয়েক স্থাপনা এখন বিদ্যমান। রাজবাড়ির প্রবেশ মুখে পশ্চিমমুখী একটি মিনার আকৃতির বিশাল তৌরণ রয়েছে। রাজবাড়ির এই সীমানার মধ্যে কিছু দূরে বামদিকে একটি উজ্জ্বল রঙের কৃষ্ণ মন্দির ও ডানদিকে রাজবাড়ির বহিঃমহলের কিছু ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান।

আর সীমানার ভেতরে আরকটি তোরণ আছে, যার মাধ্যমে রাজবাড়ির প্রধান বর্গাকার অংশে প্রবেশ করা হয়। রাজবাড়ির প্রধান অংশের পূর্বদিকে আরেকটি সমতল ছাদবিশিষ্ট মন্দির আছে যেখানে অনেক হিন্দু দেবতার প্রতিমা এখনও রয়েছে।

রাজবাড়ি প্রধানত তিনটি মহল বা ব্লকের সমন্বয়ে গঠিত- আয়না মহল, রাণি মহল ও ঠাকুরবাটি মহল। পাশাপাশি আরো কিছু অপ্রধান স্থাপনা আছে। যা জমিদার পরিবারের বিভিন্ন রাজা ও উত্তরাধিকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত।

রাজবাড়ির সীমানায় আরো কিছু মন্দির, বিশ্রামাগার, দাতব্য চিকিৎসালয়, পানির ট্যাঙ্ক ও আমলাদের বাসস্থান স্থাপিত হয়।

রাজবাড়ির ভূমির মোট আয়তন ১৬.৪১ একর যার মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দুটি বৃহৎ পানির চৌবাচ্চা/ট্যাঙ্ক, মঠ, বাগান, কাঁচারী ঘর, টেনিস কোর্ট ও কুমারের বাড়ি অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও এর মুল অংশে দুইটি পুকুর রয়েছে, যার একটি রানিপুকুর নামে পরিচিত। এবং রাজবাড়ির পিছনে আরো দুইটি বিশালাকৃতির পুকুরের একটি পদ্মপুকুর ও অপরটি সুখসাগর নামে পরিচিত । রাজবাড়ির 'হিরাবাগান'নামে একটি মাঠ রয়েছে। বর্তমানে রাজবাড়িটিকে দুইটি অংশে ভাগ করা হয়েছে যার সামনের অংশ অর্থাৎ মন্দির অংশে প্রতিবছর ধর্মীয় ভাবভঙ্গীমায় কান্তজিওঁ ও দুর্গাপুজা অনুষ্ঠিত হয়। এ অংশটি 'রাজদেবত্তর এস্টেট' নামে মন্দির কমিটির তত্বাবধানে রয়েছে। অপর অংশটি অর্থ্যাৎ আয়নামহল ও রানিমহল ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় রয়েছে যেখানে প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী ও কারুকার্য এখনও দেখা যায়।

তবে লোহার তৈরী কলাম ও বীম গুলো চুরি হয়ে গিয়েছে। পুরো জায়গাটি বৃহদাকার আম,জাম,লিচু,কাঠাল ও অন্যান্য জংলী গাছে বর্তমানে আবৃত। এর পাশেই বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত সরকারি এতিমখানা 'শিশুপরিবার' রয়েছে।

বর্তমানের ভগ্নদশা সমৃদ্ধ এই বিশাল রাজবাড়িটি একটি আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক ঐতিহ্য হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও টুরিজম স্পট হিসেবে আরেকটু গুছানো হতে পারে।

কিন্তু এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক স্বীকৃত না হওয়ায় এই বিশাল স্থাপনাটি অযত্নে অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে । বর্তমানে জনগণ এটিকে অনেকতা ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করায় বিদ্যামান অংশও ধ্বংসপ্রায়। অবিলম্বে স্থাপনাটি সংরক্ষণ না করা হলে হয়ত কোন এক সময় কালের গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে রাজবাড়ির গোরবদীপ্ত ইতিহাস।

লেখক, সমাজসেবী ঢাকা। 


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //