ডা. মরিস বুকাইলের চিঠি

ডা. মরিস বুকাইলি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন ফেরাউনের মমি করা লাশের দিকে। তখন রাত অনেক গভীর । কিন্তু হিসেব মেলাতে পারছেন না৷ এ কী করে সম্ভব! কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এর পেছনে! শত শত বছর ধরে মেডিকেল সায়েন্সকে একপ্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি লাশ কীভাবে টিকে থাকল! লাশের দেহে পাওয়া গেছে লবন, যা প্রমাণ করে—এটিকে সমুদ্র থেকে তোলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ কেন কার্যকর হলো না লাশের শরীরে!

সে সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ফ্রাঁসোয়া মিতেরা। তিনি মিসর সরকারের কাছে অনুরোধ করেছিলেন—তার দেশ ফেরাউনের মমিকে ফ্রান্সে নিতে চায়। উদ্দেশ্য মমিটি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করার। সে সময়কার মিসর সরকার ফ্রান্সের এই অনুরোধ বিবেচনা করে সায় দিলো তাতে। মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে ফেরাউনের মমি নিয়ে আকাশে ওড়া বিমানটির গন্তব্য প্যারিস। 

বিমান যথারীতি পৌঁছে গেল প্যারিস এয়ারপোর্টে। ফেরাউনের মমি করা লাশ বিমান থেকে অবতরণ করল অনেকটা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মিশর শাসক বলে কথা! 

এসময় মমিকে স্বাগত জানাতে বিমান বন্দরে স্বয়ং উপস্থিত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। সাথে উজির নাজির অমাত্যবর্গ। বিমানের সিঁড়ি দিয়ে ফেরাউনের মমি নামানো হচ্ছে। সবার মধ্যেই টান টান উত্তেজনা। সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রীবর্গ এবং ফ্রান্সের সিনিয়র অফিসারগণ। কুর্নিশ করে ফেরাউনকে স্বাগত জানালেন তারা। 

জমকালো প্যারেডের মাধ্যমে রাজকীয়ভাবে বরণ করে নেওয়া হলো এককালের মিশর অধিপতি ফেরাউনের মমি করা লাশকে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফ্রান্সের প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রের একটা বিশেষ ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো মমি, যেখানে অপেক্ষমান ফ্রান্সের সবচেয়ে বড়ো সার্জনগণ। তারা ফেরাউনের মমির ময়নাতদন্ত করে তা থেকে উদঘাটন করবেন এর হাজার হাজার বছর ধরে অবিকল টিকে থাকার গভীর ও জটিল রহস্য।

এই গবেষক দলের প্রধান ছিলাম আমি (ডা. মরিস বুকাইলি)। আরও ছিলেন থেরাপিস্ট যারা মমির ক্ষত অংশগুলো ঠিক করে এটিকে পুনর্গঠন করবেন। 

আমার দৃষ্টি ছিল ভিন্ন দিকে। আমার চাওয়া ছিল ফেরাউনের মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করা। 

অবশেষে দীর্ঘ গবেষণার একপর্যায়ে মৃত্যুরহস্য স্পষ্ট হয়ে উঠল। পানিতে ডুবেই যে ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু লাশটি টিকে থাকল কীভাবে, সেই রহস্যের কোনো কিনারা করা যাচ্ছে না। আর ব্যাকটেরিয়া এখানে অকার্যকর কেন? 

অতঃপর এক রিপোর্টে পাওয়া যায়, 'এটি এক নতুন আবিষ্কার, যা আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য সহায়ক হতে পারে।' এরমধ্যে এক কলিগ জানালেন—ফেরাউনের ডুবে যাওয়া এবং তার লাশ সংরক্ষণের ব্যাপারে মুসলিমদের ধর্মীয় পুস্তক আল কুরআনে বলা হয়েছে। বিস্মিত হলাম শুনে। পালটা প্রশ্ন , 'এটা কীভাবে সম্ভব? এই মমি পাওয়া গেছে সবেমাত্র সেদিন; ১৮৮১ সালে, আর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে! আরবের লোকজন প্রাচীন মিসরীয়দের মমি করার পদ্ধতি জানতোই না। আমরাই তো এটা জানলাম মাত্র কয়েক দশক আগে!'

গভীরভাবে ভাবতে লাগলাম কলিগের কথাটি। বাড়তে থাকল কৌতূহল। এ বিষয়ে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত তথ্যগুলোর খোঁজ নিলাম। পাওয়া গেল—বাইবেলে ফেরাউন কর্তৃক মুসা আলাইহিস সালামের পিছু নেওয়ার কথা বলা হলেও শেষমেষ ফেরাউনের লাশের কী হয়েছিল, সে সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। হয়ত আরবের মরুভূমির এক নিরক্ষর মানুষের আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে এমন একটি তথ্য তাহলে কী করে জানবার কথা! এ তো অবিশ্বাস্য! 

মরিয়া হয়ে পড়লাম প্রশ্নগুলোর উত্তর জানবার জন্য। এরপর তাওরাত (তোরাহ্) সংগ্রহ করে সেখানে পেলাম, 'পানি এলো এবং ফেরাউনের সৈন্য ও তাদের যানবাহনগুলোকে ঢেকে দিলো। যারা সমুদ্রে ঢুকল, তাদের কেউই বাঁচতে পারল না।' কিন্তু ফেরাউনের লাশ সংরক্ষণের ব্যাপারে কিছুই বলা নেই তাওরাতে। তাহলে ইসলামের নবি মুহাম্মাদ এই তথ্য কী করে জানলেন! 

এ পর্যায়ে একটি মুসলিম দেশে গিয়ে প্রখ্যাত অটোপসি বিশেষজ্ঞ মুসলিম ডাক্তারের সাক্ষাৎকার নেওয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে তাঁর সমগ্র গবেষণার ফলাফল অবহিত জানলাম এবং এ বিষয়ে কুরআনের কোনো বক্তব্য সত্যিই রয়েছে কি না জানতে চাইলাম।

তখন মুসলিম বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পবিত্র কুরআন খুলে আয়াতটি পড়ে শোনালেন। আয়াতটি এমন, 'সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি সংরক্ষণ করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। আর নিশ্চয় অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল।' [সূরা ইউনুস : ৯২]

আর কুরআনের এই আয়াতটি শোনার পর সত্যি সত্যিই হতভম্ব হয়ে গেলাম। সেই মুহূর্তে মনে হলো—এই গ্রন্থটি মানুষের রচিত হওয়া কোনোভাবেও বাস্তবসম্মত নয়৷ আরবের মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে শত শত বছর আগে মিশরে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার এমন বিবরণ দেওয়া একজন নিরক্ষর মানুষের পক্ষে রীতিমতো অসম্ভব। 

ঘটনাটি এখানেই শেষ। কিন্ত এরপরের বিষয়টি আরও আশ্চর্য। 

 কারণ কুরআনের এই অভিনব সত্য দর্শনে সেই মুহূর্তেই তিনি জোর গলায় চিৎকার দিয়ে ঘোষণা দিলেন, 'আমি ইসলামে বিশ্বাস করি, আমি এই কুরআনে বিশ্বাস করি।'

আর এ ঘটনার পর ফ্রান্সে ফিরে গেলেন ডা. মরিস বুকাইলি। কিন্তু তখন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ। বিশ্বাসের হিরণ্ময় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত৷ পরবর্তী ১০ বছর পেশাগত ডাক্তারি প্রাকটিস বন্ধ রাখলেন এবং গভীর সাধনার মধ্য দিয়ে শিখে ফেললেন আরবি ভাষা। এরপর সমগ্র কুরআন আদ্যোপান্ত গবেষণা করলেন তিনি। সবকিছুই বিস্মিত করছিল তাঁকে। সেই অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে লিখে ফেললেন পৃথিবীবিখ্যাত বই, 'Bible Quran & Science.' এই বই পৃথিবীর অন্তত ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইটির একটি উক্তি হলো, 'The Quran does not contain a single statement that is assailable from a modern scientific point of view'. অর্থাৎ কুরআনে এমন একটি তথ্যও নেই, যা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 

ডা. মরিস বুকাইলি

চিকিৎসক ও গবেষক


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //