বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ নিয়ে কিছু কথা

দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন দাবিতে খণ্ড বিখণ্ড বা সম্মিলিতভাবে শিক্ষকবৃন্দের মানববন্ধন, অবস্থান করতে দেখা যাচ্ছে। কখনো শতভাগ উৎসব ভাতার দাবিতে, কখনো বা পুরো বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি। প্রশ্ন হলো, শিক্ষকদের এসমস্ত দাবি কতটা যৌক্তিক? তাছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করলে শিক্ষার মান বাড়বে কিনা ইত্যাদি।

শিক্ষা যে কোনো প্রগতিশীল সমাজের মেরুদণ্ড। বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জনসংখ্যার একটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে শিক্ষা প্রদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষকসহ সব পর্যায়ের শিক্ষকদের স্বল্প পারিশ্রমিকের প্রকট সমস্যা শিক্ষা খাতের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ-স্তরের শিক্ষকদের বর্তমান বেতন কাঠামো, প্রতি মাসে মাত্র ১২,৫০০ টাকা, একটি শালীন জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য তাদের বেতন ভাতা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এর ফলে আর্থিক অসুবিধা হয়, শিক্ষকদের জন্য তাদের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, এটি তাদের প্রেরণা, কাজের সন্তুষ্টি এবং সামগ্রিক কর্মক্ষমতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

উৎসব উদযাপন বাংলাদেশী সংস্কৃতি ও সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাইহোক, নগণ্য উৎসব ভাতা (মূল বেতনের ২৫%) দিয়ে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এই উদযাপনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। এমনকি তাদের উৎসব ভাতা অতি নগন্য হওয়ায় তারা নিজ পরবার সদস্যদের নিকট উৎসব ভাতার পরিমাণটুকু বলতে লজ্জা পায়। এটি শুধুমাত্র তাদের মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে না বরং সামগ্রিক একাডেমিক পরিবেশকেও ব্যাহত করে, ফলশ্রুতিতে, শিক্ষার্থীদের শিখন শেখার উপর প্রভাব ফেলে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশের শিক্ষাগত ভূদৃশ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে, যা শিক্ষা খাতের ৯৭% অংশ। সারাদেশে শিক্ষা ও সাক্ষরতার ব্যাপক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়িত্ব ও উন্নয়ন অপরিহার্য।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের স্বল্প বেতন এবং অপ্রতুল উৎসব ভাতার সমস্যা প্রদত্ত শিক্ষার মানের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এটি উচ্চ প্রতিভাবান শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে এবং ধরে রাখতে অনেকটাই অক্ষম এবং শিক্ষার মান নিম্ন স্তরের দিকে পরিচালিত করে। ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা অপর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা এবং পরামর্শদানে ভুগতে পারে, যা তাদের একাডেমিক কর্মক্ষমতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে ব্যাহত করে।

জাতীয়করণের সুবিধা

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ফলে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। প্রথমত, এটি সরকারকে শিক্ষকদের জন্য মানসম্মত বেতন স্কেল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম করবে। এটি শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা বাড়াবে, যার ফলে শিক্ষার ভালো ফলাফল হবে। দ্বিতীয়ত, এটি সরকারকে আরও কার্যকরভাবে সম্পদ বরাদ্দ করতে, অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ এবং শেখার উপকরণের উন্নতি করতে দেয়। তৃতীয়ত, একটি কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলিকে স্ট্রিমলাইন করতে পারে এবং শিক্ষাগত অনুশীলনে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারে।

জাতীয়করণের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে, যেমন আমলাতান্ত্রিক বাধা এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা। তবে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আমলাতান্ত্রিক বাঁধা কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না। আর্থিক সীমাবদ্ধতা যাইহোক সতর্ক পরিকল্পনা, বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলির নিজস্ব আয় সরকারি কোষাগারে জমা নিয়ে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সহযোগিতা এবং স্বচ্ছ নীতি অনুসরণ করে এই আর্থিক বাধাগুলি অতিক্রম করতে সাহায্য করতে পারে।

বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বর্তমান দুর্দশা, তাদের স্বল্প বেতন এবং অপ্রতুল উৎসব ভাতা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষকের সন্তানের শিক্ষা ভাতা না থাকা একটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা খাতের ৯৭% অংশ, তাই মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য এই সমস্যাটি জরুরীভাবে সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়করণ এই ব্যবধান পূরণ করার জন্য একটি কার্যকর সমাধান উপস্থাপন করে এবং একটি টেকসই এবং কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নীত করে যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই উপকৃত হয়। শিক্ষকদের কল্যাণে বিনিয়োগ করে, জাতি তার শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ এবং এর সামগ্রিক উন্নয়নে বিনিয়োগ করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //