মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) নামীয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায় ৪০ লাখ গ্রাহককে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ১০০ কোটি ডলার (১১ হাজার কোটি টাকা) হাতিয়ে নিয়েছে। কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের পাশাপাশি নাইজেরিয়া, ঘানা, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বে বেশ কয়েকটি দেশে এই প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল। তবে গ্রাহকের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশে।
প্রতিষ্ঠানটি অল্প টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিক পরিমাণ মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেছে। ফায়দা লুটতে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তারা ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে। অনলাইনের পাশাপাশি তারা অফলাইনেও বিভিন্ন সেমিনার, সভা ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে প্রচারণা ও জনমনে বিশ্বাস অর্জন করতে সারাদেশে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৫ শতাধিক সিইও রয়েছে। কোনো গ্রাহক একটি নির্দিষ্ট টার্গেট পূরণ করতে পারলেই তাকে প্রমোশনস্বরূপ সিইও হিসেবে নিযুক্ত করা হতো। গ্রাহক বৃদ্ধির আরেকটি চমকপ্রদ ফাঁদ ছিল রেফার করে বাড়তি আয়ের সুযোগ দেয়া। এর ফলে কোনো গ্রাহক নতুন যুক্ত হয়েই বাড়তি আয়ের লোভে নতুন গ্রাহক আহ্বান করত। এভাবেই একটি জালের ন্যায় সৃষ্টি হয়ে গ্রাহকের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির টার্গেট ছিল ২০-৪০ বছর বয়সী বেকার ও স্বল্প আয়ের যুবকদের। তাদের মধ্যে অল্প সময়ে ধনী হওয়ার একটা স্বপ্নে বিভোর করে তুলেছিল। ফলে তারা হাতের নগদ অর্থ, সঞ্চয়ের টাকা ইত্যাদি এই অ্যাপে বিনিয়োগ করে। অতি মুনাফার লোভে কেউ জায়গা জমি বিক্রি করার টাকা এমনকি কেউ কেউ আবার বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে লোন নিয়েও অ্যাপটিতে ডলার ডিপোজিট করেছে। শুরুর দিকে কিছু লভ্যাংশ পেলেও কিছুদিন পর গ্রাহকের হিসাব হয়ে যায় শূন্য। ফলাফল হিসেবে এরা সবাই আজ সর্বস্বান্ত হারিয়ে নিঃস্ব। অনুনোমোদিত অ্যাপটিতে লেনদেন অবৈধ হওয়ায় কোনো গ্রাহক তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন পেশার মানুষসহ অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকজন এ অ্যাপটিতে বিনিয়োগ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এসেও মানুষ কতটা অসচেতন হলে এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়তে পারে? এসব প্রতারণার ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেতে দরকার শুধু একটু সচেতনতা। আগেও এত এত প্রতারণার নজির থাকা সত্ত্বেও আর কতবার প্রতারিত হলে মানুষ সচেতন হবে? ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, যুবক, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, এহসান গ্রুপ, রিং আইডিসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়েছে। ধারণা করা হয় এক কোটি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকে আছে এসব কোম্পানিগুলোর কাছে। এর মাঝে গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে সামান্য কিছু টাকা ফেরত দিলেও সিংহভাগই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
অনলাইনে বিনিয়োগের আগে একটু যাচাই-বাছাই করলেই মানুষ এমন প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। দেখতে হবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মটি বাংলাদেশের আইনানুযায়ী মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএমের অনুনোমোদিত কি না? এছাড়া অস্বাভাবিক মুনাফা অফার করা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম কার্যক্রম ভাসমান কিনা ইত্যাদি বিষয় একটু যাচাই করলেই কেউ এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়বে না। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে এসব তথ্য উপাত্ত বের করা এখন খুবই সহজ।
ভবিষ্যতে যাতে এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ওই জালিয়াতির সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে চিহ্নিত করতে হবে। জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনীকে আরও বেশি সজাগ থাকতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচারণা চালাতে হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এসব প্রতারণার ফাঁদে অর্থ হাতিয়ে নিলে ব্যক্তির পাশাপাশি দেশের অর্থব্যবস্থাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এমন প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিজের লোভ নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতার বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh