করোনা পরবর্তী ট্রমা ও স্ট্রেস সামলাতে...

যেকোনো বড় দুর্ঘটনার পরই কিছু মানুষ পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেসে বা রোগ-পরবর্তী মানসিক চাপে ভুগতে শুরু করেন। সে বন্যা, ভূমিকম্প কিংবা ধর্ষণ, মহামারি, যুদ্ধ বা বড় কোনো দুর্ঘটনা- আতঙ্কের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে তাদের মনে। ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেন না। দুঃস্বপ্ন দেখেন। মনে হয়, জীবন শেষ হয়ে গেছে, আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না।

যারা নিজে থেকে বা কারও সহায়তায় বা মানসিক চিকিৎসায় মাসখানেকের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন, তাদের সমস্যা মিটে যায়। যারা পারেন না, তারা হয় নিজেকে শেষ করে দেয়ার সুযোগ খোঁজেন, নয়তো অর্ধোন্মাদ হয়ে জীবন কাটাতে থাকেন। 

দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেস পুরোদস্তুর ডিজঅর্ডারে পরিণত হয়। যার নাম ‘পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার’ বা পিটিএসডি।

করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রমণের পরও শুরু হয়েছে এই ব্যাপার সারা পৃথিবী জুড়েই। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, চীনের উহানে সাধারণ অবস্থায় যেখানে এক শতাংশ মানুষের পিটিএসডি ছিল, কভিডের পর তা বেড়ে হয়েছে ৭ শতাংশ। যেখানে জটিল ধরনের কভিডের প্রকোপ বেশি ছিল, পিটিএসডিও সেখানে বেশি হয়েছে। প্রায় ১৮.৪ শতাংশ।

যেখানে রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে কম ছিল, সেখানে হয়েছে ৫.২ শতাংশ মানুষের। এই তালিকায় শুধু যে রোগীরা রয়েছেন এমন নয়। যাদের রোগ এখনো হয়নি, কিন্তু রোগের আতঙ্কে প্রহর গুনছেন, তারা আছেন। বাদ যাননি স্বাস্থ্য কর্মীরাও। প্রবল চাপের মুখে দিনরাত রোগী ঘাঁটতে ঘাঁটতে তারাও এক সময় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। 

বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে প্রায় ৪.৪ শতাংশ মানুষ পিটিএসডিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলেছেন, আতঙ্কের ধকল সামলানোর ক্ষমতা সবার সমান থাকে না। কেউ বড় সমস্যাও সহজে সামলাতে পারেন, কেউ ভেঙে পড়েন ছোট আঘাতেই। সেই জন্যই দেখা যায় উদ্বেগপ্রবণ মানুষের সমস্যা বেশি হয়।

এছাড়া স্কিৎজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা মেজর ডিপ্রেশনের রোগী, যারা একাকিত্বে ভোগেন, নিউরোটিক পার্সোনালিটি অর্থাৎ একটুতেই যাঁদের রাগ-দুঃখ-হতাশা-উদ্বেগ-অপরাধবোধ বা ভয় মাত্রা ছাড়ায়, নেশা করেন, অনিদ্রায় ভোগেন, আইকিউ কম- তাদের বিপদ বেশি হয়। বেশি হয় নারীদের ক্ষেত্রেও। একাধিক বড় দুর্ঘটনা একসাথে ঘটলে সমস্যা বাড়ে।

জয়রঞ্জন বলেন, সমস্যা বাড়ে তাদের যারা ছোটবেলা থেকে কোনো দুর্ঘটনার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার যারা সমস্যা সমাধান করার চেয়ে এড়িয়ে যাওয়া বেশি পছন্দ করেন বা কারও সাহায্য ছাড়াই সব কিছু সামলে ফেলতে পারবেন বলে ভাবেন, তাদেরও অনেক সময় বিপদ হয়। 

যাদের পরিবার ও বন্ধু সহৃদয় মনের কথা খুলে বলতে পারেন, বিপদের মোকাবিলা করার সাহস আছে, সব কিছুর ভাল দিক দেখেন, পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারেন, আধ্যাত্মিক চেতনা আছে- তাদের সমস্যা কম হয়।

ভাইরাস ও চিকিৎসাও বিপদের কারণ

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে, জটিল কভিড রোগীদের বিপদ বেশি হয়। এর মূলে কিছুটা হাত আছে ভাইরাসের, কিছুটা প্রাণান্তকর চিকিৎসার। ভাইরাস অনেক সময় ব্রেনেও ছড়ায়। ফলে মুড সুইং, দোটানা, অবুঝপনা ও চিন্তাভাবনার অসঙ্গতি বেশ কিছুদিন থেকে যায় অনেকের। কারও হয় অবসাদ। রোগ যত জটিল হয়, পাল্লা দিয়ে বিপদ বাড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি কভিড রোগীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশের আইসিইউ কেয়ার লাগে। তার মধ্যে যতজন বাঁচেন, তাদের প্রায় ৯৬ শতাংশের পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেসের উপসর্গ হয়। এর কারণ রোগ ও চিকিৎসার প্রবল কষ্ট।

জটিল রোগীদের আইসিইউতে যেভাবে চিকিৎসা করা হয়, নাকে-গলায় নল ঢোকানো, ভেন্টিলেটরের সাথে যুক্ত করা ইত্যাদি- তার কষ্ট অমানুষিক। কষ্ট কমাতে কখনো বেশি করে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়। 

গবেষণা থেকে জানা গেছে, এতেও আবার পিটিএসডির আশঙ্কা বাড়ে। তবে শুধু কভিডের ক্ষেত্রে নয়, যেকোনো জটিল আইসিইউ রোগীর ক্ষেত্রেই এ কথা সত্যি। আইসিইউতে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর অনেক রোগীরই পুরোদস্তুর ডিজঅর্ডার না হলেও পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেসের উপসর্গ দেখা দেয়।

সামাজিক কারণও জড়িত

কভিড রোগীরা খুব একা হয়ে যান। সংক্রমণের ভয়ে কেউ তাদের ধারেকাছে ঘেষেন না। ফলে রোগের প্রকোপে শরীরে-মনে বিধ্বস্ত রোগীর যে ভালোবাসা ও সেবার দরকার হয়, তা সেভাবে পান না তারা। একটু সেরে ওঠার পর তার সাথে যোগ হয় জীবন-জীবিকার চরম অনিশ্চয়তা, সামাজিকভাবে একঘরে হওয়ার ভয়। 

বিজ্ঞানীদের মতে, এসবের কারণেই সার্স, মার্স, ইবোলা ইত্যাদির মহামারির সময় যতজন পিটিএসডিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, কভিডে হচ্ছেন বা হবেন তার চেয়ে আরো অনেক বেশি মানুষ।

সমাধান

•  কভিডের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কারণ রোগ একবার হলে, তা সে যত মৃদুই হোক-না কেন, এত রকম ধকল সামলাতে হবে যা দুর্বল মনের মানুষের জন্য এক বিরাট চাপের ব্যাপার।

•  পিটিএসডির রিস্ক ফ্যাক্টর থাকলে আগে থেকে সতর্ক থাকুন। সামান্যতম উপসর্গ দেখা দিলেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ কিন্তু নিজে থেকে সারবে না। ফেলে রাখলে পরিস্থিতি জটিল হবে দিনে দিনে।

•  মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিলে, তিনি কখনো থেরাপি দেবেন, কখনো ওষুধ দেবেন, কখনো আবার দুটোরও প্রয়োজন হতে পারে। 

•  থেরাপির মধ্যে প্রধান হল কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি। পরিস্থিতিকে যেভাবে দেখার ফলে মানুষটির মনে ভয় ঢুকেছে, তাকে কাটাছেঁড়া করে থেরাপিস্ট ভুলগুলোকে চিহ্নিত করেন ও কীভাবে সেই সব ভাবনাকে শুধরে বাস্তবমুখী চিন্তা করতে হবে তা শেখান ধাপে ধাপে।

•  প্রয়োজন হলে ১২ সপ্তাহ ধরে করা হয় কগনিটিভ প্রসেসিং থেরাপি। সপ্তাহে এক-দেড় ঘণ্টার সেশন। প্রথমে রোগীকে পুরো ঘটনা, মনের ভাব, ভয়ের কারণ খুলে বলতে বলা হয়। তারপর বলা হয় লিখতে। এই লেখার পর্বেই থেরাপিস্টের সাহায্যে রোগী ধীরে ধীরে বুঝে যান- তার সমস্যা কোথায় ও কীভাবে তাকে চলতে হবে।

•  কারও ক্ষেত্রে করা হয় আই মুভমেন্ট ডিসেন্সিটাইজেশন অ্যান্ড রিপ্রসেসিং থেরাপি। সপ্তাহে একদিন করে তিন মাস। এতে থেরাপিস্টের হাত নাড়ানো, লাইট জ্বালানো বা কোনো বিশেষ আওয়াজের দিকে মন দিতে বলা হয় রোগীকে। কষ্টের বিষয় থেকে মন ঘুরিয়ে অন্যদিকে এনে ফেলাই এই থেরাপির উদ্দেশ্য।

•  স্ট্রেস ইনকুলেটিং ট্রেনিংয়ে ম্যাসাজ, ব্রিদিং ও অন্য রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজের সাহায্যে কীভাবে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তা শেখানো হয়।

•  এসবে কাজ না হলে দেয়া হয় ওষুধ। কখনো প্রথম দিকেও দিতে হয়। সাথে দরকার হয় বাড়ির লোকের সহযোগিতা। সবে মিলে ধীরে ধীরে রোগী স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। -আনন্দবাজার পত্রিকা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //