পাছে লোকে কিছু বলে

‘করিতে পারি না কাজ... সদা ভয় সদা লাজ... সংশয়ে সংকল্প সদা টলে- পাছে লোকে কিছু বলে। আড়ালে আড়ালে থাকি... নীরবে আপনা ঢাকি, সম্মুখে চরণ নাহি চলে... পাছে লোকে কিছু বলে।’

কামিনী রায়ের এই বিখ্যাাত কবিতাটা সবার জানা। কিন্তু এই কবিতার কথা কিন্তু শুধুই নিছক কাব্য নয় বরং বাস্তব জীবনের সঙ্গেও এর মিল পাওয়া যায়। আমরা প্রায় সময়ই যে বিষয়টা ভেবে অস্থির হয়ে পড়ি সেটা হলো পাছে লোকে কী বলে! ধরুন এখন অনেকেই অনলাইন ব্যবসা করছে। আপনি ভাবলেন আপনি নিজেও এটা শুরু করবেন; কিন্তু পরক্ষণেই পিছিয়ে গেলেন এই ভেবে যে ধুর যদি পাছে লোকে কিছু বলে? হয়তো অনেকেই যেটা সহজেই শুরু করতে পারছে, আপনি সেটাই শুরু করতে সাতপাঁচ অনেক ভাবনা ভেবে বসে আছেন। তাই হয়তো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভালো একটি কাজ শুরু করতে পারছেন না। 

আবার বয়সটা চল্লিশ পেরিয়েছে; কিন্তু লাল রঙের প্রতি মায়া কাটাতে পারছেন না, আবার লোকলজ্জার ভয়ে লাল শাড়িটা পরতেও লজ্জা পাচ্ছেন! ভাবছেন এই বয়সে যদি এ রকম উজ্জ্বল রঙ পরেন তবে লোকে কী বলবে! মধ্যবয়সে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে এখন একটু অবসর জুটেছে, তাই পুরনো গানের গলাটা একটু ঝালাই করে, দু লাইন গান গেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে মন চায়! গলা বেশ ভালো তারপরও পাছে কিছু লোকে বলে এই ভাবনায় ধুলো পড়া হারমোনিয়ামে আর হাত দেওয়া হয়ে ওঠে না। শৈশবে ভীষণ মন চাইত সাইকেল চালানো শিখতে। মনে সুপ্ত ইচ্ছাটা অনেক বড় হয়ে যাওয়ার পরও ছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে সুমী যখন বন্ধুদের কাছে সাইকেল চালানো শেখার সুযোগ পেল, তখনো সে সাইকেল চালানো শিখতে পারল না! কেন? ওই যে একই বিষয়! ক্যাম্পাসে সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে যখন পড়ে যাবে তখন কী বলবে অন্যরা? বয়সটা ৫০ পেরিয়ে গেছে, এখনো মনটা চায় ব্লু জিনসের সঙ্গে নীল পোলো শার্ট পরে ঘুরতে! মনের ইচ্ছাটা মনেই রেখে দেন পলাশ সাহেব। আরে না! তাই কি হয়! এ বয়সে লোকে কী বলবে? 

এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত একটা জীবন কাটিয়ে দেই অন্যের মর্জিতে, অন্যের ভয়ে। শুধু এই ভেবে যে পাছে লোকে কী বলবে! অথচ লোক কিন্তু আপনার জীবনটা যাপন করে না, বরং আপনি আপনার জীবনটার সর্বময় অধিকারী। একটাই তো জীবন আর সেই জীবনের অনেক ইচ্ছা, অনেক সাধ, অনেক স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেন পাছে লোকে কী বলে এই ভেবে। মজার বিষয় হলো আপনার সুখে বা দুঃখে যারা নেই, আপনার জীবনের কোনো করিডোরেই যাদের আনাগোনা নেই, সেই তারাই নিয়ন্ত্রণ করে পরোক্ষভাবে আপনার জীবন। কী হাস্যকর না ব্যাপারটা? হ্যাঁ, অবশ্যই হাস্যকর, অথচ এই হাস্যকর বিষয়টির কারণেই অনেকের যাপিত জীবনে ঘটছে ছন্দপতন। কী করবেন যখন এই পাছে লোকে কিছু বলে- এই ভাবনা আপনাকে বিব্রত করবে। হয়তো উঠতে বসতে চলতে ফিরতে প্রতিটা সময়ই আপনি এই ভেবেই গুমরে মরেন এটা কি করব? যদি এ নিয়ে কেউ কিছু বলে! কেন ঘটে এটা আপনার সঙ্গে? 

প্রধানত তিনটি কারণ এজন্য দায়ী- লজ্জাবোধ, আত্মবিশ্বাসের অভাব ও ভয়।

কীভাবে এই বিষয়গুলো থেকে বের হবেন?

  • নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলুন। আর এজন্য সামাজিক হোন। অন্যদের সঙ্গে মিশুন হালকা মেজাজে, প্রাণ খুলে হাসুন।
  • মানুষ একমাত্র প্রাণী, যার আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি, তাই অন্যরা হাসি-ঠাট্টা করবে- এই ভয়ে অনেকেই মনপ্রাণ চাইলেও অনেক কিছু করতে পারেন না। এই বিষয় থেকে বের হতে গেলে আপনার ভেতরের ইগোকে দূরে সরিয়ে নিজেকে শিশুর মতোই সরল আর প্রাণোচ্ছল করে তুলুন। 
  • যা করতে চান সেটাকে নিয়ে লজ্জা পাবেন না, বরং নিজেকে আশ্বস্ত করুন এই বলে যে এই কাজটি আপনার জন্যই একদম সঠিক। কাজেই এ নিয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই।
  • দৃঢ়সংকল্প রাখুন নিজের ভেতরে। নিজেকে ভরসা করবেন।
  • কাছের কোনো বন্ধুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে পারেন। যার সঙ্গে কথা বলে নিজের সমস্যার একটি উপায় বের করতে পারেন।
  • আপনাকে নিয়ে নেতিবাচক কথাগুলো ইতিবাচকভাবে নেওয়ার চর্চা করুন। মনে রাখবেন মানুষ তখনই সমালোচনা করে যখন আপনি আপনার মতো করে চলবেন বলে ঠিক করেন। তাই এই নিন্দুকের কথায় কান দিয়ে নিজের সময় নষ্ট না করে আপনার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান।
  • ইগনোর বা উপেক্ষা করতে শিখুন। অন্যদের কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো করে চলার ব্যক্তিত্ব তৈরি করুন।
  • নিজেকে ভালোবাসুন, নিজেকে মূল্যায়ন করুন। দিন শেষে আপনার সঙ্গে যে থাকবে সে হলেন আপনি। তাই নিজের সঙ্গে থাকুন সবসময়।
  • ইতিবাচক বন্ধু রাখার চেষ্টা করুন। নেতিবাচক কথা ও পরিবেশ থেকে থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন। 
  • কখনো কোনো কিছু নিয়ে নিজের মনে কোনো সংশয় রাখবেন না। নিজের মত ও সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //