প্রসাধনীর ক্ষতিকর কেমিক্যাল

বিউটি প্রডাক্ট বা প্রসাধনী ব্যবহারে যে কাউকে সুন্দর দেখায়। তবে এটাও সত্য যে, এসব প্রসাধনীতে থাকা রাসায়নিক উপাদান ত্বকের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এতে আমাদের ত্বক ও শরীর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২টি ব্যক্তিগত পরিচর্যাপণ্য ব্যবহার করেন, যার মধ্যে ১৬৮টি বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান আছে। আর ত্বক তার সংস্পর্শে আসা পণ্যের রাসায়নিকের ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শোষণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের ইভানস্টনের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের আরেকটি গবেষণায় জানা গেছে, সৌন্দর্যপণ্যের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের তালিকার শীর্ষে আছে হেয়ারকেয়ার পণ্য।

সাদিয়াস মেকওভারের কর্ণধার ও ডার্মাটোলজিস্ট ডা. সাদিয়া আফরিন বলেন, বিউটি প্রডাক্টগুলো প্রস্তাবিত ফল না-ও দিতে পারে। বিপরীতে নিম্নমানের ও ক্ষতিকর উপাদান অ্যালার্জি, বিবর্ণতা, টেক্সার পরিবর্তন, ত্বক বা চুলের স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে। এসব পণ্যের অধিক ব্যবহার ও অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদনের ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একইসঙ্গে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি দেখেছি আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ, বিশেষ করে কম ও মধ্যবয়সীদের সংখ্যা বেশি।

বিউটি প্রডাক্টে পাওয়া সবচেয়ে সাধারণ রাসায়নিক হলো- প্যারাবেন; যা ডিওডোরেন্টস, ময়শ্চারাইজার, শ্যাম্পু, বডি ওয়াশ ও মেকআপের প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এগুলো কিন্ত স্তন ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ায়। এর রাসায়নিক গঠন অ্যাস্ট্রোজেনের অনুরূপ এবং অল্প পরিমাণেও কার্সিনোজেনিক হতে পারে। যেসব পুরুষ প্যারাবেনযুক্ত পণ্য ব্যবহার করে তাদের শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যায় এবং কম টেস্টোস্টেরন থাকতে পারে। এটি এন্ডোক্রাইনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। 

এদিকে নখের পণ্য, চুলের রং, চুলের স্ট্রেইটনার, আঠালো আইল্যাশ, প্রসাধনীর গ্লু ও শ্যাম্পুতে থাকা ফরমালডিহাইডসহ কিছু উপাদানও ক্যানসারের জন্য দায়ী। এ ছাড়াও এগুলো ইমিউন সিস্টেমের ক্ষতি করতে পারে। আবার মেকাপের প্রসাধনীতে ইথানোলামাইন থাকে। যেটি মূলত নাইট্রোসামিনের মতো এবং সাধারণত পণ্যের লেবেলে তালিকাভুক্ত করা হয় না। এটি শ্বাসযন্ত্র, ত্বক ও অন্যান্য অঙ্গের ক্যানসার সৃষ্টিকারী বিষাক্ত পদার্থ। এটি সাধারণত সাবান, শ্যাম্পু, চুলের কন্ডিশনার, রং, শেভিং ক্রিম, আইলাইনার, মাসকারা, সুগন্ধি ও সানস্ক্রিনে পাওয়া যায়।

চুলের স্প্রে ও লোশনে থাকা ফ্যাথালেট পুরুষ ও নারীদের মধ্যে প্রজননজনিত জন্মগত ত্রুটি, লিভার, কিডনি ও ফুসফুসের ক্ষতি এবং ক্যানসারের কারণ হতে পারে। অধিকাংশ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সাবান ও ডিওডোরেন্টে পাওয়া ট্রাইক্লোসান ত্বকের জ্বালাপোড়া ও সংক্রমণের কারণ। ব্যক্তিগত যত্নের পণ্যগুলো সাধারণত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল হিসেবে কাজ করে। যা এন্ডোক্রাইন বিঘ্নকারী হিসেবে কাজ করতে পারে এবং থাইরয়েড, টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন নিয়ন্ত্রণকে ব্যাহত করতে পারে। ফলে প্রারম্ভিক বয়ঃসন্ধিকাল, বন্ধ্যাত্ব, স্থূলতার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। যদি শিশুরা অল্প বয়সেই এর সংস্পর্শে আসে তা হলে তাদের অ্যালার্জি, হাঁপানি ও একজিমা হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

সাধারণত ত্বক ফর্সাকারী পণ্যে থাকে হাইড্রোকুইনোন। এগুলো নির্দিষ্ট ক্লিনজার ও ময়েশ্চারাইজারে পাওয়া যায়। এটি আরেকটি ক্ষতিকারক ড্রাগ যা এক্রোনোসিসের কারণ হতে পার। তাই এর কারণে খোলা ত্বকে কালো ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে। আবার অনেক ফেয়ারনেস ক্রিমে স্টেরয়েড থাকে। যা ত্বকের ক্ষতি, পাতলা, লালভাব, রং পরিবর্তন ও ব্রণ সৃষ্টি করে।

এ ছাড়া বিউটি প্রসাধনী তৈরিতে ব্যবহৃত ইথোক্সিলেটেড সার্ফ্যাক্ট্যান্ট এবং ১, ৪-ডাইঅক্সেন (অন্যান্য রাসায়নিকের প্রতিক্রিয়া কমাতে কার্সিনোজেনিক ইথিলিন অক্সাইড যোগ করে পাওয়া উপজাত), সিসা (লিপস্টিক ও চুলের রঞ্জক পদার্থে ব্যবহার করা হয়), পারদ (মস্তিষ্কের বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে) এবং মিনারেল অয়েল (যা ত্বকের টক্সিনমুক্ত করার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে) নানারকম ক্ষতি করে। এমনকি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হেয়ার স্ট্রেটনারের মতো মৌলিক পণ্যগুলোও আমাদের ধারণার চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে।

ডা. সাদিয়া আফরিন ব্যাখ্যা করেন- হ্যান্ড স্যানিটাইজারগুলো জীবাণু মারতে কার্যকর। তবে এর অত্যধিক ব্যবহার ভালো ব্যাকটিরিয়াকেও মেরে ফেলতে পারে। সুতরাং এটি সীমিত পরিমাণে ব্যবহার করুন। এ ছাড়া বাজারে পাওয়া বেশিরভাগ শিশুর ওয়াইপগুলোতে মেথিলিসোথিয়াজোলিনোন নামে একটি রাসায়নিক থাকে; যা ত্বকের অ্যালার্জি, ফুসকুড়ি ও জ্বালা সৃষ্টি করে।

ডিওডোরেন্ট ও টুথপেস্টে পাওয়া সমস্যাযুক্ত রাসায়নিকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেশিরভাগ ডিওডোরেন্টে অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড হেক্সাহাইড্রেট ও প্যারাবেনস থাকে; যা ক্যানসার, আলঝাইমার রোগের কারণ হতে পার। টুথপেস্ট ফ্লোরাইডের একটি প্রধান উৎস এবং যদি গ্রহণের পরিমাণ বেশি হয় তবে এটি ডেন্টাল ফ্লোরোসিসকে বিচ্ছিন্ন করার প্রধান কারণ হয়ে উঠতে পারে।

হেয়ার স্ট্রেইটনারগুলোতে ফর্মালডিহাইড ও হেয়ার ডাই অ্যামোনিয়া থাকে। বর্তমানে বাজারজাত করা চুলের রঞ্জক ও রঙের ৮০ শতাংশে বর্ণহীন ডাই ইন্টারমিডিয়েট (সুগন্ধযুক্ত অ্যামাইনস) এবং ডাই কাপলার থাকে। আবার অস্থায়ী চুলের রঞ্জকগুলোর মধ্যে অ-অক্সিডেটিভ এবং রঙিন যৌগ থাকে, যা চুলকে সরাসরি রঙিন করে। তবে এই যৌগগুলো ত্বকে অ্যালার্জি সৃষ্টি করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //