বছরান্তে নারীর আনন্দ-বিষাদ

‘নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত! আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন করিলাম নত’- রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটির মতোই আসতে চলেছে নতুন বছর। ২০২২-কে বিদায় দিয়ে পা রাখতে চলেছি ২০২৩-এ। কিন্তু এই যাত্রা পথ কি খুব সহজ ছিল? কেবল আনন্দে আনন্দেই কেটে গেল, নাকি সঙ্গে ছিল কিছুটা দুঃখ-কষ্ট বা হার-জিতের গল্প? বছরান্তে কষা হয় জীবনের লাভ-ক্ষতির হিসাব।

তবে সামগ্রিক নারী সমাজে ক্ষতির পাল্লাটাই যেন ভারী! মেয়েরা এখন প্লেন চালায়, রকেট সায়েন্স নিয়ে গবেষণা করে, জয় করে হিমালয়। তবুও বলা হয়- এটা তোমার জায়গা নয়। পরিবার, সমাজ কিংবা দেশ যতই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলুক না কেন, এখনো কিন্তু মেয়েদের প্রদীপের তলায় রাখতেই পছন্দ করে। আবার ‘নারীর সাফল্য, সবার সাফল্য’- আনন্দময়ী বাক্যটিও আন্দোলিত করে বাঙালিকে। 

বাংলার মেয়েদের দক্ষিণ এশিয়া জয়

দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবলের অন্যতম জনপ্রিয় আসর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। এ আসরে ২০২২ সালের আগে বাংলাদেশ নারী দলের কোনো সাফল্য ছিল না। সেই আক্ষেপটাই ঘুচল ২০২২ সালে এসে। স্বাগতিক নেপাল নারী দলকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয় সাবিনা খাতুনের দল। এর আগে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। তবে সেবার ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে ভাঙে স্বপ্ন। ছয় বছর পর সেই দুঃস্বপ্নের ক্ষতে প্রলেপ দেয় টাইগ্রিসরা।

অদম্য তামান্নার সাফল্যগাথা

তামান্না আক্তার নূরা। জন্ম থেকেই তার নেই দুহাত ও একটি পা। তবু দমেননি; একটি পা নিয়েই এগিয়ে চলেছেন। অদম্য এ মেধাবী সব প্রতিবন্ধকতাকে তুড়ি মেরে পায়ে লিখেই প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক- সব পরীক্ষাতেই মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। বরাবরের মতো ২০২২ সালে উচ্চমাধ্যমিকেও জিপিএ-৫ পাওয়া তামান্না এখন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) ইংরেজি বিভাগে স্নাতক করছেন। আবেগ নিয়েই তিনি বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু আমার তো হাত-পা নেই। ডাক্তারির পড়ায় অনেক প্র্যাকটিক্যাল আছে। আমি তো করতে পারব না। তাই আমার এখন স্বপ্ন ইংরেজিতে পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার।’ তার সেই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।

নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে কৈশোরেই আইডল তারা

ফরিদপুরের সালথা উপজেলার দরগা গট্টি গ্রামের আতিক মাতুব্বরের মেয়ে আছিয়া আক্তার। স্থানীয় জয়ঝাপ উচ্চবিদ্যালয়ের এখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার বিয়ে ঠিক করে পরিবার। গত ২১ নভেম্বর ফরিদপুর আদালতে তার বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আছিয়া এখন বিয়ে করতে চায় না। লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা। পরিবার তার সেই ইচ্ছার মূল্য দিচ্ছিল না। তাই পুলিশকে ফোন করে নিজেই নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে দেন আছিয়া। 

একইভাবে নওগাঁর রানীনগর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী মিম আক্তারও নিজের বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে। উপজেলার পূর্ব বালুভরা গ্রামের বাবু মণ্ডলের মেয়ে মিম নিজের বিয়ে বন্ধ করতে গত ৯ নভেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ফোন করে। খবর পেয়ে ইউনও শাহাদাত হুসেইন বালুভরা গ্রামে গিয়ে বাল্যবিয়ের সব আয়োজন পণ্ড করে দেন। রাতের বাসে কতটুকু নিরাপদ নারী?

দিনটি ছিল গত ১৪ জানুয়ারি। বগুড়া থেকে ঢাকাগামী একটি বাসে ডাকাতি করতে ওঠে ডাকাত দল। যাত্রীদের সবকিছু লুটে নেয়ার পর তাদের লোলুপ চোখ পড়ে এক তরুণীর ওপর। সঙ্গে থাকা বাবা-মাকে বেঁধে রেখে তাদের মেয়েকে ধর্ষণ করে ডাকাত দলের সদস্যরা। বাসে থাকা আরেক তরুণীকেও এ সময় দলবেঁধে ধর্ষণ করে তারা। পরে তাদের একটি ফাঁকা জায়গায় নামিয়ে দেওয়া হয়। 

নওগাঁ থেকে গত ৬ আগস্ট এক নারী স্বামীর সঙ্গে বাসে করে এসে রাত সাড়ে ৩টার দিকে গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া বাইপাসে নামেন। পরে তারা মাওনা যাওয়ার উদ্দেশ্যে তাকওয়া পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। বাসটি গাজীপুর শহর অতিক্রম করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে শ্রীপুরের মাওনা এলাকায় পৌঁছলে বাসের চালক, হেলপার ও অন্যরা মিলে নারীর স্বামীকে জোর করে বাস থেকে নামিয়ে দেয়। এরপর চলন্ত বাসে নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। ছিনিয়ে নেওয়া হয় সঙ্গে থাকা ব্যাগ ও নগদ টাকাপয়সা। ধর্ষণের পর মাওনা থেকে গাজীপুরের দিকে আসার পথে হোতাপাড়া এলাকায় মহাসড়কের নির্জন স্থানে ভিকটিমকে নামিয়ে দেওয়া হয়। 

কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার এক নারী চাকরির সূত্রে স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকায়। আখাউড়ায় একটি মাজার জিয়ারত করতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বাসে চড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। তবে বাসটি যখন জেলা শহরের কাউতলী পৌঁছায়, তখন অনেক রাত হয়ে যায়। তাই গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে বাসে উঠিয়ে নেন চালক ও সহকারী। এরপর নির্জন স্থানে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করা হয়। এখানেই শেষ নয়, সেই দৃশ্য দেখে ফেলে পাশের একটি করাতকলের মালিকের ছেলে। এরপর সেও ভয় দেখিয়ে ওই নারীকে করাতকলের কার্যালয়ে নিয়ে ধর্ষণ কর। পরে তারা ভিকটিমকে বাসে করে শহরের কাউতলী এলাকায় নামিয়ে দিয়ে ট্রেনে ঢাকায় চলে যেতে বলে। কিন্তু রাত ৩টার দিকে ওই নারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায় গিয়ে ঘটনাটি পুলিশকে জানান। 

গার্মেন্টসে চাকরির জন্য কুষ্টিয়া থেকে এক নারী গত ৩ আগস্ট ঈগল পরিবহনের একটি বাসে করে ঢাকায় আসছিলেন। রাত দেড়টার দিকে পথিমধ্যে ১০-১২ তরুণ যাত্রী সেজে বাসে ওঠে। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর তারা অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের সবাইকে জিম্মি করে বেঁধে ফেলে। এরপর সব যাত্রীর কাছ থেকে মোবাইল, নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নেয়। বাসটি বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে তিন ঘণ্টার মতো নিয়ন্ত্রণে রাখে। পরে পথ পরিবর্তন করে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়ায় বালুর স্তূপে বাসটি উল্টিয়ে ডাকাত দল পালিয়ে যায়। তবে যাওয়ার আগে এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণ করে একে একে ছয় ডাকাত।

জিন্স-টপস পরায় রেল স্টেশনে হেনস্তা

নরসিংদীতে বেড়াতে এসে গত ১৮ মে ঢাকায় ফিরছিলেন দুই তরুণ ও এক তরুণী। ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের জন্য বিকালে তারা স্টেশনের প্ল্যাটফরমে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তরুণীর জিন্সের প্যান্ট ও টপস পরা এবং আরেক তরুণের হাতে ট্যাটু করা দেখে স্টেশনে অবস্থানরত এক নারী বাজে মন্তব্য শুরু করেন। তরুণীর সঙ্গে থাকা এক তরুণ এর প্রতিবাদ জানান। একপর্যায়ে ওই নারী ইচ্ছা করেই ঝগড়া বাধান।

এ সময় স্টেশনের কিছু বখাটে হঠাৎ ছুটে এসে ওই তরুণ-তরুণীর সঙ্গে তর্কে জড়ায়। ওই নারী তরুণীকে গালাগাল ও পোশাক ধরে টানাটানি করতে থাকেন। পরে তরুণী ছুটে গিয়ে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে আশ্রয় নেন। এদিকে কিছু লোক দুই তরুণকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। পরে দুই তরুণও স্টেশন মাস্টারের কক্ষে আশ্রয় নেন। ভুক্তভোগীরা জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন দিলে নরসিংদী সদর মডেল থানার পুলিশ গিয়ে তাদের ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দেন। ফেসবুকে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন অনেকে। অনেক স্থানে প্রতিবাদও হয়। 

আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, ‘নারীরা ঘরে-বাইরে, সব সম্পর্কে, সব বয়স-শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সরকার নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং ভয়াবহতা ও নৃশংসতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে সংঘটিত নারী নির্যাতন মামলাগুলো তদন্তেই বিনষ্ট হয়ে যায়। অধিকাংশ মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা প্রভাবশালীদের মাধ্যমে প্রভাবিত হন। এতে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় না।

এছাড়া অনেক অপরাধী জামিনে বের হয়ে কৌশলে বিচার এড়িয়ে যায়।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //