ক্ষতিকর টেস্টিং সল্টের ব্যবহার বৃদ্ধি

খাবারের স্বাদ বাড়াতে টেস্টিং সল্টের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এই লবণ ব্যবহারে খাবারের স্বাদ বাড়ে, তাই কোনো বাছ-বিচার না করেই টেস্টিং সল্ট রান্নায় যোগ করা হচ্ছে। লবণটি পরিমাণে বেশি ও দীর্ঘদিন খেলে ডেকে আনে স্বাস্থ্যের জন্য মহাবিপদ।

মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (এমএসজি) নামে এই লবণ একটি নীরব ঘাতক। এই লবণ হাড় দুর্বল করে দিতে পারে, স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে খেলে টেস্টিং সল্ট নেই এমন অন্যান্য খাবারে অরুচি জন্মায়। ফলে না খেয়ে থাকার একটি প্রবণতাও তৈরি হয়।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির সমীক্ষায় বাজারে প্রচলতি আলুর চিপসের পাশাপাশি ৫৫টি নুডুলস, পপকর্ন ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাইতে অতিমাত্রায় টেস্টিং সল্ট পাওয়া গেছে। টেস্টিং সল্টের ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য এটাকে ‘চাইনিজ রেস্টুরেন্ট সিন্ড্রোম’ নামকরণ করা হয়েছে। পুষ্টিবিদরা বলেন, মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট টমেটো ও পনিরে প্রাকৃতিকভাবেই থাকে। তাই খাবারে টেস্টিং সল্টের পরিবর্তে টমেটো ব্যবহার করলে পুষ্টিও পাওয়া যায় এবং খাবারের স্বাদও বাড়ে।

এমন অনেকেই আছেন ঘরের রান্না করা খাবার খেতে পারেন না সময়ের কারণে। তাকে দিনের একটি সময়, বিশেষ করে দুপুরের খাবার বাইরে খেতে হয়। বাইরের খাবার ঘরের রান্নার চেয়ে অনেক স্বাদের হয়ে থাকে। ফলে ঘরের খাবারে আর রুচি হয় না। আর রেস্টুরেন্টের খাবারে সাধারণ লবণের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে টেস্টিং সল্ট। এটাকে চাইনিজ সল্ট বা চাইনিজ লবণও বলা হয়ে থাকে। 

বাংলাদেশে চাইনিজ রেস্টুরেন্টের খাবারে টেস্টিং সল্টের প্রথম ব্যবহার শুরু হলেও এখন সাধারণ রেস্টুরেন্টে তো বটেই, এটা ছড়িয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানে, এমনকি ঘরের রান্না করা খাবারেও। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট নামের রাসায়নিক উপাদানে তৈরি টেস্টিং সল্ট স্নায়ুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। 

লবণটি শরীরে গেলে বিভিন্ন জটিল রোগের ঝুঁকি তো আছেই, উপরন্তু এতে কোনো পুষ্টিগুণও নেই। টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করলে খাবার যে পরিমাণে সুস্বাদু হয় সেরকম স্বাদ অন্যকিছু ব্যবহারে পাওয়া যায় না বলে অনেকে কোনো বাছ-বিচার না করেই ব্যবহার করে থাকে। 

তাছাড়া টেস্টিং সল্ট ফাস্ট ফুডেও বেশি ব্যবহার করা হয় বিক্রি বাড়ানোর জন্য। হালিম, ঝালমুড়ি, চটপটি, ফুচকা, গ্রিল, পিজা, স্যান্ডউইচ, চানাচুর, ক্রেকার্স, ভেজিটেবল কারি, সয়া সস, কেচআপ, সাধারণ সস, বিস্কুট, নুডলস, চিপস ও স্যুপেও ব্যবহৃত হয় এই লবণ।

দীর্ঘদিন ব্যবহারে বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে

টেস্টিং সল্ট দীর্ঘদিন ব্যবহারে শরীরে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ ও ওজন বৃদ্ধি। যেহেতু টেস্টিং সল্ট সাধারণ লবণের চেয়ে মজা বেশি, সে কারণে এটা পরিমাণে বেশি যাচ্ছে শরীরে। ফলে ওজন বেড়ে যায়। কারণ লবণ কোষগুলোতে পানি জমিয়ে দেয়। 

টেস্টিং সল্ট লিভারে (যকৃৎ বা কলিজা) চর্বি জমা করা রাখতে ভূমিকা রাখে, হাড় দুর্বল বা ক্ষয় করে থাকে, খাবারে অরুচি জন্মায়, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, মাথা ব্যথা বাড়ে, মাংসপেশিতে ব্যথা, হাত এবং পায়ে ঝিমঝিম বা অবশ লাগে, হার্ট বিট দ্রুত হয়, মেধা বিকাশে বিঘ্ন ঘটতে পারে বা স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে পারে। 

পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলেন, দীর্ঘদিন টেস্টিং সল্ট খাওয়ায় অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ডের অস্বাভাবিক গঠনে দেহে ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেনক্রিয়াস (অগ্ন্যাশয়), লিভারের প্রদাহ, হরমোনাল ইনব্যালেন্স হতে পারে। সোডিয়াম গ্লুটামেট মস্তিষ্কের নিউরাল কোষকে উত্তেজিত করে থাকে।

এই কোষ মানুষের শিক্ষা, জ্ঞান, স্মৃতিশক্তি ও যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতিরিক্ত টেস্টিং সল্ট দেহে প্রবেশ করে যা মস্তিষ্কের গ্লুটামেট রিসেপ্টরকে খুব বেশি উত্তেজিত করে। এতে মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় স্নায়বিক পদ্ধতির কাজে বিঘ্ন ঘটে। এতে মাথাব্যথা, মাংসপেশি ব্যথাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। 

অতিরিক্ত বা দীর্ঘদিন টেস্টিং সল্ট মানবদেহের টেস্ট বা স্বাদ নামক রিসেপ্টরকে নষ্ট করে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে স্বাদ বা রুচিকর আর কিছুই থাকবে না। এতে জিহ্বায় কোনো খাবারেরই স্বাদ থাকবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেস্টিং সল্টযুক্ত খাবারে মুখের লালা (স্যালাইভা) বেশি তৈরিতে সহায়তা করে। এই স্যালাইভা বেশি করে খাবার খেতে জিহ্বাকে উৎসাহিত করে থাকে। এভাবে টেস্টিং সল্ট বেশি খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে দেয়। ফলে মানুষ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মোটা হয়ে যায়।  

কৃত্রিম স্বাদ বৃদ্ধিকারী টেস্টিং সল্ট নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা একটি ভয়ানক নীরব ঘাতক। এই লবণটি নানাভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে থাকে। তাই একে অভিহিত করা হয়েছে ‘স্নায়ু বিষ’ হিসেবে। শিশুদের জন্য এটি আরও মারাত্মক। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেস্টিং সল্টের ব্যবহার থামাতে না পারলে অ্যালকোহল ও নিকোটিনের মতো বড় বিপদ ঘটাতে পারে।

বিজ্ঞানীরা একে ‘উদ্দীপক বিষ’ নামেও অভিহিত করেছেন। টেস্টিং সল্ট মানবদেহে প্রবেশ করে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে বিষিয়ে তোলে। ফলে স্নায়ুতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কাজে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়, ঘুম কম হয়, স্বাভাবিক খাবারে অরুচিকর হয়ে থাকে।

টেস্টিং সল্টের ইতিহাস

সর্বপ্রথম ১৯০৮ সালে জাপানিজ বায়োকেমিস্ট কিকুনি ইকেদা খাবারের স্বাদ বাড়াতে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা টেস্টিং সল্ট ব্যবহার শুরু করেন। পরে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) বাণিজ্যিকভাবে টেস্টিং সল্ট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। ইউএস এফডিএ কোনো কিছু অনুমোদন দিলে অন্যান্য দেশ বিনা সন্দেহে এফডিএকে অনুসরণ করে। কারণ এফডিএ কোনো কিছুর অনুমোদন দিলে তা যথেষ্ট মান যাচাই করে দেয়।

কিন্তু সোডিয়াম গ্লুটামেটের ক্ষেত্রে এফডিএর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। এটা খাবারের স্বাদ বাড়ালেও এটা লবণ। আর অতিরিক্ত লবণ শরীরের অনেক ক্ষতি করে থাকে এটা এখন সর্বজন বিদিত। কারণ লবণের ক্লোরাইড বাদ দিয়ে শুধু সোডিয়াম খুবই সামান্য শরীরের জন্য উপকারী। 

বর্তমানে টেস্টিং সল্টের ক্ষতিকর দিক প্রমাণ হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই লবণটি বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়েসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ পাকিস্তান অন্যতম। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট স্যুয়োমোটো রুল ইস্যু করে ২০১৮ সালের মার্চে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বিক্রি, আমদানি ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করেন। 

ইউএস এফডিএর গাইড লাইনে প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ১৩ গ্রাম গ্লুটামেট খেতে পারে। কিন্তু রাসায়নিকভাবে তৈরি মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট খেতে পারে মাত্র ০.৫৫ গ্রাম। কিন্তু আমাদের দেশের খাবারে এর চেয়ে অনেক বেশি মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট খেয়ে থাকে।

পশ্চিমা বিশ্বের কোনো কোনো দেশের খাবারে অথবা রেস্টুরেন্টে ঘোষণা দিয়ে খাবার বিক্রি করছে যে, তারা তাদের খাবারে মনো সোডিয়াম গ্লুটামেট ব্যবহার করে না। তবে প্রথমবার অথবা খুবই স্বল্প পরিমাণে এই লবণটি দেহের ক্ষতি করতে পারে না।  

মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট তৈরি হয় যেভাবে

সামুদ্রিক সবুজ শৈবাল সিওয়েড বা মেরিন অ্যালগি পুড়িয়ে স্ফটিকাকারে টেস্টিং সল্ট তৈরি করা যায়। এছাড়া স্টার্চ, মিষ্টি বিট, আখ অথবা গুড় গাজন প্রক্রিয়ায় মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা টেস্টিং সল্ট তৈরি করা হয়। দই বা সিরকা যেভাবে গাজন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা যায় ঠিক একই রকমভাবে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট তৈরি করা যায়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //