রক্তস্বল্পতা বাংলাদেশে নীরব ও অবহেলিত সমস্যা

রক্তস্বল্পতা বাংলাদেশের মানুষের একটি নীরব ও অবহেলিত সমস্যা। কারও রক্তস্বল্পতা হলে শুরুতে খুব বেশি শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় না বলে রোগটি অবহেলিতই থেকে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের ৫ বছরের কম বয়সী ৪২ শতাংশ শিশু এবং ৪০ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে।

অন্যদিকে গ্রামীণ বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ কিশোরী ও ৪৯ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। কিন্তু শহরের চিত্রটা আরও খারাপ। (অ্যানিমিয়া ইন বাংলাদেশ: এ রিভিউ অব প্রিভেলেন্স অ্যান্ড এটিওলজি: এফ আহমেদ, পাবমেড আর্টিকেল)

স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১৪-১৬ গ্রাম/ডিএল থাকে। তা থেকে কম হলেই রক্তস্বল্পতা বলে ধরে নেওয়া হয়। লৌহ বা আয়রনস্বল্পতাই রক্তস্বল্পতার প্রধান কারণ। তবে পুরো বাংলাদেশে মারাত্মক রক্তস্বল্পতা ২ থেকে ৩ শতাংশ। আয়রনস্বল্পতা ছাড়াও পরজীবী সংক্রমণ এবং সঠিক ও প্রয়োজনমতো খাবার না খাওয়ার কারণেও ঘটে এ সমস্যাটি। 

এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের ‘এ ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি অ্যানিমিয়া প্রিভেনশন অ্যান্ড কনট্রোল ইন বাংলাদেশ’ নামক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৩৬ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ফলে শরীরে কম আয়রন জমা থাকে বলে তা খুব অল্প সময়েই শেষ হয়ে যায় এবং শিশু রক্তস্বল্পতায় ভোগে। 

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মাহমুদুল হাসান বলছেন, ‘রক্তস্বল্পতা হলে সামান্য কাজ করলেই যে কেউ দ্রুত হাঁপিয়ে উঠতে পারে। চুল ঝরে যেতে পারে। দিনে ৫০ থেকে ১০০টা চুল পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু তার চেয়ে বেশি চুল ঝরলে শরীরে আয়রন ঘাটতি রয়েছে বলে ধরে নেন চিকিৎসকরা। তবে অন্য কারণও থাকতে পারে, কিন্তু আয়রন ঘাটতিই প্রধান কারণ।

আয়রনের অভাব হলে দ্রুত ক্লান্তিভাব এসে যায়। ফুসফুসের সমস্যা বা অন্য কোনো কারণেও শরীর দ্রুত ক্লান্ত হতে পারে। হঠাৎ করে উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা বেড়ে যাওয়া রক্তস্বল্পতা বা আয়রনের ঘাটতির কারণ হতে পারে।’ পুষ্টিবিদদের মতে, রক্তস্বল্পতা বিশ্বের সবেচেয়ে বড় অপুষ্টিজনিত সমস্যা যা মূলত শরীরে আয়রনের অভাবেই হয়ে থাকে।

রক্তস্বল্পতা কী এবং কেন হয়

ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, শরীর লাল রক্ত কণিকা বা হিমোগ্লোবিন কমে গেলে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। হিমোগ্লোবিন শরীরে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে বিষণ্নতা, দুর্বলতা দেখা দেয়। পুষ্টিকর খাবার খেয়ে অথবা আয়রন, ফলিক অ্যাসিড (ফোলেট), ভিটামিন বি১২ খেয়ে রক্তস্বল্পতা দূর করা যায়। 

তিনি বলেন, রক্তস্বল্পতা বা রক্তশূন্যতার কারণে দেহ সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। ফলে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। ৯ থেকে ২০ বছরের কিশোরীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার পরিমাণ বেশি। মা হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ৩/৪ মাস পর থেকেই লৌহ সমৃদ্ধ খাবার বা আয়রন জাতীয় ওষুধ খেতে হয়। গর্ভকালীন অধিক মৃত্যুহারের অন্যতম কারণ রক্তশূন্যতা। বাংলাদেশে এ রক্তশূন্যতার হার অত্যন্ত বেশি। রক্তশূন্যতার কারণে ত্রæটিযুক্ত সন্তান জন্ম হচ্ছে। অভিভাবক এবং প্রত্যেক মায়ের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। 

রক্তশূন্যতা বোঝার উপায়

অল্প ও মাঝারি রক্তশূন্যতায় তেমন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। তবে পরীক্ষা করলে রক্তস্বল্পতা ধরা পড়ে। রক্তশূন্যতা একটু বেশি দেখা দিলে শরীরে নানা লক্ষণ ফুটে ওঠে। যা দেখে বোঝা যায় লোকটি রক্তশূন্যতায় ভুগছে। লক্ষণগুলো হলো অবসাদ, দুর্বলতা, বুক ধড়ফড় করা, সামান্য পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, চোখে ঝাপসা দেখা যাওয়া, হাত-পায়ে ঝিমঝিম করা, মাথাব্যথা করা, হাত-পাসহ পুরো শরীর ফ্যাকাসে হওয়া, অলসতা বেড়ে যাওয়া, মুখে ঘা, জিহ্বায় ঘা, গিলতে অসুবিধা ভোগ করা, নখ ভঙ্গুর বা চামচের মতো হওয়া। তাছাড়া ত্বকে ভাঁজ পড়া, নখ, ঠোঁটের ভেতরের অংশ মুখের রং ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া এবং নাড়ির গতি বেড়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ প্রকাশ পেলে রক্তস্বল্পতা হয়েছে বলে চিকিৎসকরা ধরে নেন। 

কী করতে হবে

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, বাড়িতে বসেই রক্তশূন্যতা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। লৌহ জাতীয় খাবার নিয়মিত খেতে হবে। উদ্ভিজ ও প্রাণিজ খাদ্যে উভয়টাই আয়রন পাওয়া যায়। যেমনকলিজা, মাংস, মাছ, ডিম, সয়াবিন, কলা, মটরশুঁটি, শিমের বিচি, সবুজ ও লাল শাক সবজি, ফুলকপি, ডাল, বাদাম, কিশমিশ, খেজুর, বরই, ধনেপাতা, পাকা তেঁতুল, ছোলা, আটা, শালগম, চিড়া, কালো জাম, শুঁটকি মাছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন আছে।

এসব খাবার কিশোর-কিশোরী মহিলা মা এবং শিশুকে প্রতিনিয়ত পরিমাণমতো খেতে হবে। উদ্ভিদ খাদ্যে ফাইটেট, অক্সালেট নামক উপাদান থাকায় আয়রন শরীরে ভালোভাবে শোষিত হতে পারে না। তবে প্রাণিজ আয়রন উদ্ভিদ আয়রন শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই আয়রনযুক্ত উদ্ভিজ্জ খাবারের সঙ্গে মাছ, মাংস খাওয়া ভালো। গর্ভবতী মাকে গর্ভধারণের ৩/৪ মাস থেকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণ এ রোগ প্রতিরোধে ভ‚মিকা পালন করে। 

বাড়তি খাবার

হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম এমন রোগীদের বিটের রস পান করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। লাল বর্ণের বিটে রয়েছে ফোলেট, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম, আয়রন, বেটাইন এবং ভিটামিন সিসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান। আয়ুর্বেদ ও ইউনানি শাস্ত্রে আছে, পালং ও পুদিনার রস রক্তস্বল্পতার জন্য শাক সবচেয়ে ভালো প্রতিকার। এতে আয়রনের পাশাপাশি ভিটামিন বি১২, ফলিক অ্যাসিডের মতো পুষ্টি রয়েছে। আধা কাপ পালং শাকে প্রায় ৩৫ শতাংশ আয়রন এবং ৩৩ শতাংশ ফলিক অ্যাসিড রয়েছে। 

এ ছাড়া এক গ্লাস পালং শাকের রসে দুই চামচ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন একবার পান করতে পারলে বাড়তি ফল পাওয়া যায়। ডালিম বা আনার বা বেদানার রস রক্তস্বল্পতা দূর করার অন্যতম উপাদান। এক কাপ ডালিমের রসে এক চামচের চার ভাগের এক ভাগ দারুচিনি গুঁড়ো এবং দুই চা চামচ মধু মিশিয়ে নিলে উপাদানটি আরও সুস্বাদু হয়। প্রতিদিন সকালের নাশতায় এটি খাওয়া যায়। 

এছাড়া এক গ্লাস গরম দুধে দুই চামচ শুকনো ডালিমের বীজের গুঁড়ো মিশিয়ে দিনে একবার বা দুই বার পান করলেও উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া রক্তস্বল্পতা রোধ করতে ভেজিটেবল মিক্স স্যুপ পান করা যায় অথবা স্যুপ করতে না পারলেও অনেকগুলো শাক-সবজি এক সঙ্গে রান্না করে খাওয়া যায়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল, আয়রন, ভিটামিন সি এবং ফাইবার পাওয়া যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //