ভয়ঙ্কর শব্দদূষণ স্ট্রোক বাড়ায়

ঢাকা মহানগরীর ভয়ঙ্কর শব্দদূষণ ব্রেইন স্ট্রোক বাড়িয়ে দিচ্ছে। শ্রাব্যতার সীমা অতিক্রম করা শব্দ স্ট্রোকের সঙ্গে মানুষের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি এবং নিদ্রাহীনতা ও মানসিক অশান্তি বাড়ছে। অতিরিক্ত শব্দদূষণে বিশেষভাবে ক্ষতি হতে পারে শিশুদের। দিনের পর দিন শব্দদূষণের শিকার শিশুদের লেখাপড়ায় মনোযোগের ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে।

মূলত ঢাকা মহানগরীর যানবাহনের চালকেরা শব্দদূষণের পেছনে সবচেয়ে দায়ী। যানবাহনের চালকেরা শব্দ তৈরির প্রতিযোগিতায় নামে যেন। যানবাহন ছাড়াও এ শহরে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নির্মাণ কাজ চলে। নির্মাণ কাজের ইটভাঙার মেশিনের বিকট শব্দ, এর সঙ্গে আছে টাইলস, গ্রিল কাটার শব্দ। এছাড়া নানা প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে উচ্চ নিনাদের মাইক। সব মিলিয়ে ঢাকা শহর হয়ে উঠেছে বিশে^র সবচয়ে শব্দদূষণের নগরীতে। যক্ষা চিকিৎসায় ১৯১০ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী চিকিৎসক রবার্ট কোচ বলেন, ‘মানুষকে একদিন শব্দদূষণের মোকাবিলা করতে হবে কলেরা এবং কীটপতঙ্গ ঠেকানোর মতো সমান গুরুত্বের সঙ্গে।’ 

স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়

শব্দ স্নায়ুর বা নার্ভাল সিস্টেমের সাহায্যে মানুষের মস্তিস্কে পৌঁছায়। মানুষের মাথায় কানের জন্য নির্ধারিত অংশ কাজ করে বলে মানুষ শব্দ শুনে তার উত্তরে কিছু বলতে পারে এবং সে অনুযায়ী অ্যাকশনে যেতে পারে। কিন্তু অতিরিক্ত শব্দ তৈরি হলে তা মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। কারণ অতিরিক্ত শব্দ উচ্চ রক্তচাপ তৈরি করে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেগে রক্ত মস্তিস্কে পৌঁছে দেয় ও মস্তিষ্কের কোমল নার্ভাল সিস্টেমগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে এবং মস্তিষ্কে স্ট্রোকের অবস্থায় পৌঁছে যায়। নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হানিফ মোহাম্মদ বলছেন, ‘উচ্চ মাত্রার শব্দ প্রতিনিয়ত কানের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছালে মস্তিষ্ক এক পর্যায়ে সেটা আর সহ্য করতে পারে না। এ কারণে মস্তিষ্কের কোষে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া দেখা দেয়, উচ্চ রক্তচাপে মস্তিষ্কের রক্তনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়, রক্তনালি ছিঁড়ে যায়।’ 

হার্ট অ্যাটাকের কারণ

বিকট শব্দে অনেক সময় মানুষের হার্টবিট দ্রæত হতে থাকে। আর তা থেকে কারও কারও নিশ্বাস বন্ধ হওয়ারও উপক্রম হয়, মাথা ঘোরে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত শব্দ হৃদযন্ত্রের নানা ধরনের অসুখের উৎস। কিন্তু সচেতনতার অভাবে এটা অনেকেই মনে করেন না। এছাড়া অতিরিক্ত শব্দ মানুষের দেহে অভ্যন্তরীণ নানা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। তারা বলছেন, উচ্চমাত্রার শব্দে মানুষের শরীরে অ্যাড্রেনালিন নামক একটি হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই হরমোনটি মানুষের শরীরে রক্তচাপ ও হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। পরিবেশে যত বেশি শব্দ থাকবে এবং মানুষ যত বেশিক্ষণ এই অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকবে ততক্ষণ দেহে অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ হতে থাকবে। এই হরমোনের ক্ষরণ অব্যাহত থাকলে অসুস্থ মানুষ তো বটেই স্বাভাবিক মানুষেরও বেড়ে যেতে পারে হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ) এবং উচ্চ হাইপারটেনশনের কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় বলে জানিয়েছেন শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ ডা. ফারুক ওসমানী। ৩৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সী ১৫ হাজার হাজার নারী-পুরুষ নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর অতিরিক্ত শব্দের ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয় জার্মানিতে। সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয় যে, অতিরিক্ত শব্দ হার্ট অ্যাটাক বৃদ্ধি করে থাকে। 

শ্রবণেন্দ্রিয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে

শব্দদূষণে শরীরের যে অঙ্গটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়। জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুহাম্মদ আবু হানিফ বলেন, কানের ভেতরে রিসেপ্টর প্রথমে শব্দ তরঙ্গকে ধারণ করে, তারপর ককলিয়ার নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায়। দীর্ঘদিন অতিরিক্ত শব্দ এই রিসেপ্টরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্রমাগত যারা অনেক শব্দের মধ্যে থাকেন তারা ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হারাতে থাকেন। অনেকে বুঝতেই পারেন না যে, তারা ধীরে ধীরে কানে কম শুনছেন। ২০২২ সালে জাতিসংঘের পবিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দুটি শহরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকায় বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে শব্দের মাত্রা ১১৯ এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবল। এই পরিমাণ শব্দ একজন মানুষের কানের সহ্য ক্ষমতার অনেক বেশি। মানুষের কান ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ সহ্য করতে পারে। শব্দের মাত্রা ৪০ ডেসিবলের বেশি হলেই কানের অথবা শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে থাকে। দিনের পর দিন যদি লম্বা সময় ধরে কেউ ৭০ ডেসিবলের ওপর শব্দের মধ্যে থাকেন তাহলে শ্রবণশক্তি ক্রমশ কমে যেতে থাকে। শহরগুলোতে সারাক্ষণ হর্ন বাজানো গাড়িচালক নিজেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশ, শহরের ব্যস্ততম শহরে সড়কে দীর্ঘ সময় থাকতে হয় এমন মানুষ, নির্মাণ কর্মীরা শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। আবাসিক এলাকাতেও যে পরিমাণে গাড়ির হর্ন, নির্মাণ কাজ বা মাইকের শব্দ শুনতে হয় তাতে নিজের বাড়িতে থেকেও একজন মানুষের কান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কানে কম শোনে

দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক কানে কম শোনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নাক-কান-গলা বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত বাংলাদেশে বধিরতার হার নিরূপণের লক্ষ্যে পরিচালিত জাতীয় সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে আসে। এই সমীক্ষাটি ১০ বছর আগের। বর্তমানে কানে কম শোনা মানুষের হার আরও বেশি বেড়েছে, কারণ শব্দদূষণ আগের চেয়ে বেশি। চিকিৎসকেরা বলছেন, দ্রুত রোগনির্ণয়, চিকিৎসা ও জনসচেতনতার মাধ্যমেই ৫০ ভাগ বধির ও শ্রæতিক্ষীণ মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। 

বিশ্বে শব্দদূষণে ঢাকা শীর্ষে

বিশ্বে শব্দদূষণে রাজধানী ঢাকা শীর্ষে। ঢাকার বাইরে রাজশাহী বিশে^র চতুর্থ স্থানে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, এই পরিমাণ শব্দ অন্য শহরগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৯৯ সালের গাইডলাইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ঢাকার বাসিন্দারা জাতিসংঘের গাইডলাইনের সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দ সহ্য করে থাকে। 

বাইরের শব্দ ঠেকাতে নতুন প্রযুক্তির ভবন

সর্বাধুনিক শব্দ প্রযুক্তি এবং নতুন ধরনের নির্মাণ উপকরণ উন্নত নতুন শহর তৈরি করতে পারে। প্রযুক্তি দিয়ে বর্তমানের পুরনো নির্মাণ শৈলীর ভবনগুলো এমনভাবে বদলে দেওয়ার গবেষণা করা হচ্ছে যে, ভবনের বাইরের অংশ অবাঞ্ছিত শব্দগুলো ঠেকিয়ে রাখবে। ‘সুনির্দিষ্ট শব্দ তরঙ্গ আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য তৈরি করে অবাঞ্ছিত শব্দকে ভবনের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না’ এমন প্রযুক্তি তৈরির কাজ করছেন ইংল্যান্ডের সলফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রকৌশলী ট্রেভর কক্স। ভবনগুলোতে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে যে, ভবনের কয়েক মিটারের মধ্যে পৌঁছলে বাইরের অতিরিক্ত শব্দ আর শোনা যাবে না। ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার গবেষকরাও বিশেষ আকারের জানালা তৈরি করেছেন। ভবিষ্যতের ওই জানালা চারপাশ থেকে আসা শব্দকে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে ধরবে এবং বাড়ির মালিক তার ঘরের ভেতর পছন্দের সঙ্গীত তার সঙ্গে মিশিয়ে একটা নতুন শব্দরাজ্য তৈরি করে নেবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //