স্মৃতিভ্রংশ রোগ: প্রতি ১২ জনে একজন আক্রান্ত

ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগটি হলে স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং প্রতিদিনের স্বাভাবিক কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষমতা কমে যায়। এটা বয়স্কদের রোগ, কম বয়সীদের মধ্যে সাধারণত দেখা যায় না। তবে সব সময় বয়সের কারণেই যে রোগটি হয় তাও না। বংশগতভাবে এ রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিও থাকে। রোগটি হলে মানুষের নাম মনে না রাখতে পারার সমস্যাটা বেশি দেখা দেয়। 

এছাড়া কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস নিজের হাতে রাখলেও কোথায় রেখেছে পরে তা মনে রাখতে না পারা, এমনকি নিজের হাতে ঘড়ি অথবা চোখে চশমা রেখেও ঘরের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে থাকে এ রোগে আক্রান্তরা। ডিমেনশিয়া একটি বিশেষ রোগ হলেও এই রোগটির কোনো চিকিৎসা নেই। তবে কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে রোগটিকে বিলম্বিত করা যায়। বাংলাদেশে বয়স্কদের মধ্যে রোগটির প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়ছে।

ডিমেনশিয়া রোগ এড়ানোর উপায় নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। তারা ব্রেইন ট্রেনিংয়ের কথা বললেও এর মাধ্যমে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমে কিনা এখনো প্রমাণিত নয় বলেও জানিয়ে দিয়েছে সংস্থা। তবে জীবনযাত্রা পরিবর্তনের মাধ্যমে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ কমানো সম্ভব।

নিউরো ডিজেনারেটিভ রোগ ডিমেনশিয়া
ডিমেনশিয়া হচ্ছে একটি জটিল নিউরো ডিজেনারেটিভ রোগ। এ রোগ হলে মানুষ ধীরে ধীরে তার স্মৃতিশক্তি হারাতে থাকেন। ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডিমেনশিয়া নিয়ে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়ার ওপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্ব জুড়ে ৫৫ মিলিয়ন (সাড়ে ৫ কোটি) মানুষ এই রোগ নিয়ে বেঁচে আছেন এবং প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগটি বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ মৃত্যুর কারণ। রোগটি হয়ে গেলে বয়সকালে অন্যদের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়ে যায়। অন্যদের সাহায্য ছাড়া ডিমেনশিয়া আক্রান্তরা স্বাভাবিক চলাফেরাও করতে পারেন না। বেশ কিছু রোগের কারণে মস্তিষ্কের পরিবর্তন ঘটে যা পরিশেষে স্নায়ুকোষ বা নিউরন নষ্ট করে। ডিমেনশিয়ার সয্গে সংশ্লিষ্ট রোগের মধ্যে রয়েছে, আলঝেইমারস। এটা মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষ ও স্নায়ুতন্ত্রকে ধ্বংস করে তথ্য প্রবাহের মেসেজবাহী ট্রান্সমিটারের প্রবাহকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বিশেষত স্মৃতিগ্রহণ সমন্বয় ও রক্ষণ কাজে সংশ্লিষ্ট স্নায়ুকোষসমূহ এ রোগে অধিক আক্রান্ত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে ডিমেনশিয়া
২০১৯ সালে আইসিডিডিআরবি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স বাংলাদেশে সাতটি বিভাগে একটি সমীক্ষা চালায়। শহর ও গ্রামাঞ্চলের ষাটোর্ধ্ব ২ হাজার ৭৯৬ জনের ওপর সমীক্ষাটি চালানো হয়। এতে দেখা যায়, প্রতি ১২ জনের মধ্যে একজনের ডিমেনশিয়া রয়েছে। পুরুষদের তুলনায় নারীদের ডিমেনশিয়ার প্রকোপ ২.৫ গুণ বেশি। রাজশাহীতে ১৫ শতাংশ এবং রংপুরে ১২ শতাংশ মানুষ ডিমেনশিয়ায় ভুগছে। 

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে যারা কখনো স্কুলে যায়নি এবং যাদের স্ত্রী বা স্বামী নেই সামগ্রিকভাবে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ তাদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে বেশি। এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ৫২ শতাংশের বেশি হাইপারটেনশন, ৫৪ শতাংশ হতাশা এবং ৮ শতাংশের ডায়াবেটিসসহ দীর্ঘস্থায়ী রোগ ছিল। সমীক্ষায় বলা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ। ২০২৫ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াবে ১৩ লাখ ৭০ জনে। 

ঝুঁকি কমানোর উপায়
ডিমেনশিয়া কমাতে অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ নেওয়া বন্ধ করতে হবে। সব সময় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে, উত্তেজিত হতে হয় এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এটা শুধু ষাটোর্ধ্ব নয়, সব বয়সীদেরই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই রোগের কোনো চিকিৎসা না থাকলেও নানাভাবে রোগের ঝুঁকি কিছুটা কমানো যেতে পারে। প্রাপ্তবয়স্করা সপ্তাহে ১৫০ মিনিট কঠোর কিংবা মাঝারি ধরনের শারীরিক পরিশ্রম করতে পারলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমতে পারে বলে নিউরোলজিস্টরা বলছেন। ব্যায়াম হতে হবে পরিকল্পিত উপায়ে এবং নিয়মিত। বয়স্কদের জন্য সাইক্লিং কিংবা নিয়মিত বাসা-বাড়ির কাজ করা অন্যতম।

ব্যায়াম ছাড়াও ধূমপান বন্ধ করতে হবে যেন মস্তিষ্কে ক্ষতিকারক বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ বাসা বাঁধতে না পারে। তারা বলছেন, শারীরিক পরিশ্রম করার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে তাজা সবজি এবং ফল সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তাছাড়া পরিষ্কার পানির মাছ যেমন সামুদ্রিক মাছ বেশ উপকারী হতে পারে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ব্রেন ট্রেনিং ডিমেনশিয়া কমাতে পারে এমন প্রমাণ না থাকলেও নিউরোলজিস্টরা বলছেন, প্রমাণ না থাকলেও যেসব কাজ মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত সেগুলো করলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমতে পারে। বন্ধু এবং স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে সেটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। সে কারণে বেশি করে সামাজিক হওয়া কিংবা সমাজের নানা কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখা ভালো। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে মেদ বাড়ায় না এমন ভালো খাবার খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। 

সুস্বাস্থ্যের জন্য উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস কমিয়ে রাখা উচিত। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস হলেই চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর উচ্চ রক্তচাপ ব্রেইনসহ শরীর অনেক প্রয়োজনীয় অঙ্গকে অকার্যকর করে দেয়। উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে ডিমেনশিয়ার বেশ সম্পর্ক আছে। চিকিৎসকরা বলছেন, কলেস্টেরলও ডিমেনশিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ভিটামিন ট্যাবলেট ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে না। পশ্চিমা বিশ্বে মদ্যপানকে ডিমেনশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলা হয়েছে। মদ্যপানের কারণে ইউরোপ ও আমেরিকানরা ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন। 

আশার আলো
ব্রিটেনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা ডিমেনশিয়া কমাতে আশার আলো দেখিয়েছে। কেমব্রিজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের গবেষক ডক্টর শানকোয়ান চেনের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণা বলছে, লিথিয়াম নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ ডিমেনশিয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। ২০০৫ থেকে ১৪ বছর ধরে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের ওপর এই গবেষণা চালিয়েছেন তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি ‘সাইকিয়াট্রিক টাইমস’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, জীবনে কোনো না কোনো সময় লিথিয়াম গ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে এই রোগের আশঙ্কা অনেকটাই কম।

কেমব্রিজের গবেষণাটিতে অংশ নেওয়া সকলেই পঞ্চাশোর্ধ্ব ছিল। এর মধ্যে কোনো না কোনো লিথিয়ামযুক্ত ওষুধ ব্যবহার করা মানুষের সংখ্যা ছিল ৫৪৮ জন। গবেষণার ফল বলছে, যারা লিথিয়ামযুক্ত ওষুধ খেয়েছেন, তাদের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তের হার ৯.৭ শতাংশ। যারা কখনো লিথিয়াম ব্যবহার করেননি তাদের ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়ার হার ছিল অনেক বেশি। 

ফলে গবেষণায় বলা হয়েছে, লিথিয়াম ডিমেনশিয়ার উপশম হিসেবে কাজে আসতে পারে। তবে ঠিক কেন এমন হয়, তা নিয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারেননি গবেষকরা। বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা করতে বলা হয়েছে। গবেষকগণ বলছেন, প্রতিদিন এক্সারসাইজ করলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রতিদিন হাঁটতে বলা হয়েছে। প্রতিদিন মাত্র ১৩ মিনিট এক্সারসাইজ করলেও পরবর্তী জীবনে ডিমেনশিয়া হওয়ার আশঙ্কা কমে। এমনকি ডিমেনশিয়া দেখা দেওয়ার পরেও প্রতিদিন এক্সারসাইজ করলেও রোগের অগ্রগতি অনেকটাই ধীর করে দেওয়া সম্ভব। আবার প্রতিদিন ৩৫ মিনিট ঘাম ঝরিয়ে হাঁটলেও ভবিষ্যতে ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। 

বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, বহু ডিমেনশিয়ার রোগীই জিঙ্কের ঘাটতিজনিত সমস্যায় ভুগছেন। তাই জিঙ্কযুক্ত খাদ্য প্রতিদিন খাওয়া দরকার। কুমড়ার বীজ, কালো চকোলেট, ছোলা, মটরশুঁটি, মুরগির গোশতে প্রচুর জিঙ্ক থাকে। এছাড়া দৈনিক ৮ ঘণ্টা ঘুমালে ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ সম্ভব। কারণ ঘুমের সঙ্গে স্মৃতির একটা বড় যোগযোগ রয়েছে। ঘুমানোর সময়েই আমাদের কোন স্মৃতি জমা হয়ে থাকবে তা ঠিক করা হয়। ফলে প্রথম থেকে সঠিক মাত্রায় ঘুমের অভ্যাস ঠেকাতে পারে ডিমেনশিয়ার সমস্যা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //