প্রতিদিন অফিসে যেতে দেরি হয় কেন

অফিসে যেতে কিছু মানুষের সব সময় দেরি হয়। সাধারণত প্রায় সব অফিসে এ ধরনের কর্মী দেখা যায়। আর তাদের কপালে জোটে ‘লেট লতিফ’ খেতাব। তাদের নিয়ে অনেকে হাসি-ঠাট্টা করেন। এর সঙ্গে যোগ হয় বসের ঝাড়ি। কিন্তু এই দেরির বিষয়টি সবার ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত নয়। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। মেডিক্যাল সায়েন্স বলছে, কারও যদি অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি) থাকে, তাহলে তার জন্য কোথাও সময়মতো উপস্থিত থাকতে কঠোর পরিশ্রম করতে হতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণা বলছে, দেরিতে অফিসে ঢোকা কিংবা তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হওয়া দুটিই সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধার অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যার ইঙ্গিত করতে পারে। কিন্তু এর মধ্যে দেরি করাটা অনেক বেশি মৌলিক সমস্যা, যার মূলে থাকতে পারে মানুষের মানসিকতা। এ বিষয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা হয়েছে। সেসব গবেষণায় একটি ধারণা উঠে এসেছে, এই ধারণাটিকে প্ল্যানিং ফ্যালাসি বলা হয়। মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কাহনেম্যান ও তার সহকর্মী আমোস টভারস্কি ১৯৭৯ সালে ধারণাটি প্রবর্তন করেছিলেন। এটিকে তারা কাজের ব্যাপারে ‘অত্যধিক আশাবাদী’ হয়ে ‘প্রয়োজনীয় সময়ের অবমূল্যায়ন করার প্রবণতা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন।

দীঘস্থায়ী দেরি কি এডিএইচডির লক্ষণ? বিশেষত এডিএইচডি আক্রান্ত অনেকে সময়ের সঙ্গে লড়াই করেন। তিনি বা তারা সময়কে মানিয়ে নিতে পারেন না। তারা মনকে একটি পদ্ধতির মতো বেঁধে ফেলেন এবং সেখান থেকে বের হতে পারেন না। এডিএইচডির কিছু বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। যার সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে দেরির কারণ হতে পারে।

অমনোযোগিতা: কেউ হয়তো প্রস্তুত হওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তখন টেলিভিশনে কোনো পছন্দের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল কিংবা ফেসবুকে বা ইউটিউবে ভিডিও দেখতে গিয়ে কোনো অনুষ্ঠানে আটকে গেলেন। এতে সহজেই তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। ফলে তিনি ওই অনুষ্ঠান বা ভিডিওতে এতটাই নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা কর্মসূচির কথা ভুলে যান; এমনকি অফিসের কথাও।

বিশৃঙ্খলা: এডিএইচডির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বিশৃঙ্খল জীবন। কেউ হয়তো অফিসের জন্য বের হবেন ঠিক তখন চাবি, ফোন বা জুতা খুঁজে পান না। ফলে তার দেরি হয়ে যায়। বিশৃঙ্খলা যে কোনো ব্যক্তির নিজের কাজের জন্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০১৫ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, নিউরোলজিক ডিসঅর্ডার নিয়ে বাস করা বেশিরভাগ মানুষের জন্য এ ধরনের বিশৃঙ্খলা খুবই সাধারণ ব্যাপার।

সময়কে ধারণ করতে না পারা: যখন কারও কোনো কাজ কত সময় লাগবে বা কোনো নির্দিষ্ট কাজে কত সময় ব্যয় করেছে তা অনুমান করতে অসুবিধা হয়- তার মানে তিনি সময়কে ধারণ করতে পারেন না। যাকে বলা হয়, টাইম ব্লাইন্ডনেস। অনেক বিশেষজ্ঞ জোর দিয়ে বলেছেন, এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে টাইম ব্লাইন্ডনেস সমস্যাটি খুবই প্রকট। তাই এটি নিয়ে গবেষণা করা উচিত এবং সম্ভবত ডায়াগনস্টিক মানদণ্ডে যোগ করা উচিত।

কাজ মনে রাখতে না পারা: এডিএইচডিতে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়ই কাজ মনে রাখতে পারেন না, যাকে বলা হয়- ওয়ার্কিং মেমরি ডেফিসিট। এ সমস্যা কর্ম পরিকল্পনা, কাজ সংগঠিত করা, সময় নির্ধারণ ও সময়ের সঙ্গে থাকার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেটি অফিসে সময়মতো উপস্থিত হতে পারার অন্যতম একটি কারণ।

সহজেই বিরক্ত হওয়া: কাজের প্রতি বিরক্ত থেকে মানুষ অন্যান্য কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। কাজ একঘেয়েমি মনে হওয়ায় তারা কিছু অবাঞ্ছিত বিষয়কেও কাজ ভাবতে শুরু করে। ২০১৬ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, অনেকে কাজে বিরক্ত হয়ে ইন্টারনেটে যান। আর সেখানে গিয়ে আসক্ত হয়ে পড়েন। ফলে অফিসের কাজের প্রতি তার মনোযোগ কমে যায়। 

আবেগ: আবেগের কারণে অনেক সময় অফিসে বা কোনো কাজে যেতে দেরি হতে পারে। যেমন- কেউ অফিসের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত, তখন কোনো একজন বন্ধুর ফোনকল এলো। তিনি বন্ধুর কলে আপ্লুত হয়ে কথা বলা শুরু করলেন। তাদের মধ্যে ২০ মিনিট কথা হলে, অফিসে যেতেও ২০ মিনিট দেরি হবে। অথচ চাইলেই ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে রওনা দেওয়া যেত।

এডিএইচডি ছাড়াও আরও কিছু মানসিক কারণে অফিসে বা কোথাও যেতে দেরি হতে পারে। এই সাধারণ কারণগুলো হলো- সামাজিক উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, অবসেসিভ-কমপালিসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি), নার্সিসিজম, সাবসটেস্ট ইউজ ডিসঅর্ডার (এসইউডি) এবং সিজোফ্রেনিয়া। অবশ্য অফিসে দেরি হওয়ার বিষয়টি সবার জন্য মানসিক সময় না। কারণ কেউ কেউ হয়তো এমন পরিবার বা সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছেন যেখানে দেরি হওয়াটা সাধারণ এবং কোনোভাবেই বিষয়টিকে অবজ্ঞা করা হয় না। সময়ের ব্যাপারে দক্ষ হওয়ার অনেক উপায় আছে। সেগুলো মেনে চললে এখান থেকে বের হওয়া সহজ হবে।

পেশাদার কারও সহায়তা: কারও যদি নিয়মিতভাবে অফিসে যেতে দেরি হয়, আর সেজন্য যদি কর্মজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাহলে পেশাদার কারও পরামর্শ নিতে হবে। কারণ বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই পেশাদার কোনো মনোবিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি এখান থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন। কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও সেটি জানাবেন। 

টাইমার সেট করা: এটি সম্ভবত সবচেয়ে ভালো উপায়, যা সরাসরি প্রভাব ফেলবে। কখন প্রস্তুত হতে হবে, কখন বের হতে হবে সবগুলোর জন্য টাইমার সেট করে রাখতে হবে।

রুটিন মেনে চলা: একটি নিয়মিত রুটিন সময়কে কাজে লাগানোর সেরা উপায়। সময় নিয়ে যেসব সমস্যা আছে সেখানে থেকে বের হতে রুটিন দারুণ কার্যকর। ২০১৯ সালের গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিনের রুটিন স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় অবদান রাখে।

সুশৃঙ্খল জীবন: কারও যদি সব সময় দেরি করার অভ্যাস হয়ে যায় এবং কারণ খুঁজে না পায়, তাহলে সুশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। দরকার হলে একটি নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করুন। প্রতিদিন সেখানে চাবি, মানিব্যাগ, জুতা ও ফোন রাখতে হবে। তাহলে খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //