মুঠোবন্দি শৈশব

রাজধানীর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে ফাহাদ (ছদ্মনাম)। স্কুল থেকে ফিরে আর সময় কাটে না তার। এলাকায় যদিও একটি মাঠ আছে, তবে পরিবারের কেউ সময় দিতে না পারায় খেলতে যাওয়ার সুযোগ হয় না ফাহাদের। তাই তার বিনোদন ও সময় কাটানোর একমাত্র মাধ্যম স্মার্টফোন।

শিশুটির মা রাহেলা বেগম বলেন, ফাহাদের স্কুল শুরু হয় সকাল সাড়ে ৮টায়। এরপর বাসায় ফেরে সাড়ে ১০টায়। এসেই মোবাইল ফোন নিয়ে বসে পড়ে। এটা ওর অভ্যাস হয়ে গেছে, এমনকি ফোন হাতে নিয়েই সে খায়। ঘুমের আগেও তার হাতে মোবাইল ফোন থাকে। এলাকায় একটা মাঠ থাকলেও আমরা সঙ্গে যেতে পারি না, আর তাকে একাও ছাড়তে পারি না। তাই বাসায় নিজে নিজে মোবাইলে গেমস খেলে বা ইউটিউবে কার্টুন দেখে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক কিছু উন্নতি হলেও সার্বিকভাবে তারা সামাজিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। শিশুদের শারীরিক কিংবা মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা অত্যন্ত জরুরি। তবে শহরের, বিশেষ করে ঢাকা শহরের শিশুরা সেই সুযোগ পায় না। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একটি হলো পরিবারের সময়ের অভাব, অন্যটি খেলার জন্য উন্মুক্ত স্থান নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় খেলার মাঠ থাকে না। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নেই খেলার স্থান। ফলে বাধ্য হয়েই ডিভাইসে বন্দি হচ্ছে শৈশব । 

করোনা মহামারির সময়ে মোবাইলে আসক্ত শিশুদের সংখ্যা বেড়ে যায় বহুগুণে, এই সংখ্যাটা এখনো বাড়ছেই। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশুর শারীরিক, ভাষিক ও মানসিক বিকাশজনিত সমস্যা। নানা গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনাকালীন ডিজিটাল ডিভাইসে অতিমাত্রায় আসক্তির কারণে অনেক শিশুমনে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের অভ্যাসগত চাঞ্চল্য। পাশাপাশি শিশুর চোখ ও মাথা ব্যথার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঘরে বসে থাকার কারণে ওজন বেড়ে গিয়ে শারীরিক নানা ধরনের জটিলতারও সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ও মোবাইলের প্রতি আসক্তির ফলে শিশুদের মাঝে মনোযোগের ঘাটতিজনিত মানসিক চঞ্চলতা বা এডিএইচডির (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) ঝুঁকি বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর বর্তমানে ‘এডিএইচডি’তে আক্রান্ত। বাংলাদেশের চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়।

প্রতিকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগকে অগ্রাহ্য করে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নেতা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আবার গৃহবন্দি শিশুদের অনলাইন শিক্ষা ও বিনোদন থেকে হুট করে ফিরিয়ে আনাও সম্ভব নয়। হঠাৎ কোনো বড় পরিবর্তন শিশু মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে সময় নিয়ে ধৈর্য সহকারে শিশুর দৈনন্দিন কাজের তালিকাকে স্বাভাবিক সময়ের মতো করে নিয়ে আসতে হবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘মা-বাবাও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাই শিশুও তাদের অনুসরণ করে। তাই মা-বাবাকে মোবাইল স্ক্রিন থেকে নজর সরিয়ে শিশুদের লালন-পালনে আরও যত্নশীল হতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে সন্তানকে নিয়ে ছুটির দিনে ঘুরতে যেতে পারেন মা-বাবা। ঘরে শিশুর সঙ্গে লুডু, ক্যারম, দাবা খেলতে পারেন। বাড়ির ছাদেও কিছু খেলাধুলা করতে পারেন। 

শিশুকে নিয়ে বিকালে বা ভোরে হাঁটতে বের হোন। তার বয়সী শিশুদের সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেটের মতো খেলার সুযোগ থাকলে দেওয়ার চেষ্টা করুন। ছুটির দিনে শিশুকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসুন। সবুজ ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে দিন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //