সাংবাদিকতার সাতকাহন

বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। বিবর্তনের মধ্যদিয়ে সংবাদপত্র শিল্প ও সাংবাদিকতা পেশা যুগ থেকে যুগ পেরিয়ে এর ভাষা, শিরোনাম, রিপোর্ট তৈরি, উপসম্পাদকীয় ও সম্পাদকীয় লেখা ইত্যাদি নানান ধরনের কর্মযজ্ঞে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।

প্রযুক্তিগত উন্নতি বর্তমানে আধুনিকতার শীর্ষে, এরপর কী ধরনের উন্নতি সাধিত হবে, তা এখনি ভাবতে পারছি না। তবে গত পঞ্চাশ বছরে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তাতে একে ‘বৈপ্লবিক’ শব্দটি ব্যবহার করে চিহ্নিত করা যেতে পারে। লেখায়, ভাষা ও বাক্য নির্মাণের ক্ষেত্রেও নিজ নিজ পছন্দসই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে সংবাদপত্রকে পাঠকগ্রাহ্য করার নানা কৌশল চলছে। বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতি এবং সামাজিকমাধ্যমের ব্যাপক প্রচার ও জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সংবাদপত্রের কাটতি কমেনি। বরঞ্চ সার্কুলেশন কেবল যে বেড়েছে তা-ই নয়, অসংখ্য দৈনিক পত্রিকার আবির্ভাব ঘটেছে ঢাকা শহরে এবং রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। 

সম্পাদক পত্রিকার শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে যেকোনো লেখার দায়িত্ব যেমন গ্রহণ করতেন, তেমনি যেকোনো কারণে কোনো সাংবাদিক বিপদে পড়লে অভিভাবক হিসেবে সম্পাদক সেখানে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে এগিয়ে যেতেন

আমাদের অনেকের ধারণা ছিল টেলিভিশন আসলে সংবাদপত্রের কাটতি কমে যাবে, কিন্তু সে ধারণা ক্রমশ ভাঙছেই। তা না হলে একটির পর একটি পত্রিকা কেমন করে বের হচ্ছে এবং বাজারে চলছে। তবে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে পরিমাণে সংবাদপত্র, টেলিভিশন, এফএম রেডিও এবং ওয়েব পোর্টাল চলছে, তাতে একথা নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে- পত্রিকা কখনোই ক্ষয়িষ্ণু বা অচল হয়ে যাবে না। কিন্তু ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তান জমানায় খবরের কাগজের যে চরিত্র আমরা লক্ষ্য করেছি এবং সংবাদ প্রকাশে যে দায়িত্বশীলতা ও বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন সাংবাদিকেরা, আজ তা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য- বিগত সত্তর-আশি বছরে সংবাদপত্র জগতে যে ধরনের প্রতিভাসম্পন্ন জ্ঞানী ও সাহসী সম্পাদক ও সাংবাদিক আমরা পেয়েছি, আজ এমন দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটছে না! যদি পাকিস্তান আমলের কথাই বলি- আজ আমরা একজন আব্দুস সালাম, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, এমনকি একজন আবুল কালাম শামসুদ্দিন পর্যন্ত পাচ্ছি না। তাঁরা তখন সংবাদপত্রের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাতে করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার কোনো চক্রান্ত বা কৌশল সহজে সফল হতে পারেনি। আজ এ ধরনের দায়িত্বশীল, সাহসী এবং স্বাধীনচেতা সম্পাদক কেন দেখতে পাচ্ছি না?- এটি অবশ্যই একটি বড় প্রশ্ন হতে পারে। আগেরকার সংবাদপত্রে যা কিছু ছাপা হতো, চিঠি, মন্তব্য, রিপোর্ট, উপসম্পাদকীয়, সম্পাদকীয় এ সবকিছুর জন্য দায়ী থাকতেন সম্পাদক, এ এমনই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল। তখনকার দিনে সংবাদপত্রের মালিক কে, সেটা হয়তো জানতে পারতাম, কিন্তু সহসা তাকে দেখতে পেতাম না। আজকাল মালিকের দর্শন এবং কর্তৃত্ব বহুল পরিমাণে প্রকাশিত। সংবাদপত্র শিল্প ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সেদিন যেমন প্রতিটি সদস্যই সমানভাবে দায়িত্ব অনুভব করতেন, আজ যেন তার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। 

সংবাদপত্রের বর্তমান প্রচলিত রূপ কেন জানি না, আগের চাইতে অনেক বেশি ফারাক মনে হচ্ছে। তাছাড়া সম্পাদক পত্রিকার শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে যেকোনো লেখার দায়িত্ব যেমন গ্রহণ করতেন, তেমনি যেকোনো কারণে কোনো সাংবাদিক বিপদে পড়লে অভিভাবক হিসেবে সম্পাদক সেখানে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে এগিয়ে যেতেন। অথচ আজকালকার অভিজ্ঞতায় দেখা যায়- সম্পাদকের ‘দায়িত্বহীনতা’র কারণে সাংবাদিকদের কারাবরণ করতে হয়, মামলার আসামি হতে হয়, এমনকি মার খেয়ে হাত-পা-মাথা ভাঙে তো বটেই, প্রাণটাও দিয়ে দিতে হয়। এসব ব্যাপারে খুব একটা তাপ-উত্তাপ কেউ বোধ করেন কি না, তার কোনো হদিস আমাদের কাছে  খুব একটা নেই। যেমন ধরুন, এ পর্যন্ত যেসব সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, তাদের হত্যাকারী চক্রের অপরাধের কোনো বিচারই হয়নি। তবু সাংবাদিকতা এমনই একটি পেশা, শত বাধা-বিপত্তি, গুম-হত্যা-গ্রেফতারের ভয়কে উপেক্ষা করে কৌশলে লেখার চেষ্টা কেউ কেউ করেন। কিন্তু সবাই তা পারেন না। এটা ওই নিরাপত্তাহীনতার জন্যেই- তিনি কোনো বিপদে পড়লে মালিক কিংবা সম্পাদক অথবা প্রতিষ্ঠানগতভাবে কেউ এগিয়ে আসবেন না, এই ভেবে। 

আমাদের জমানায়, অর্থাৎ আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে একজন সাংবাদিক যতটা দায়িত্বশীল ছিলেন এবং সংবাদ সংগ্রহ ও লেখার ব্যাপারে নিজের মেধা ও শ্রম কাজে লাগাতেন, এখন তার প্রয়োজন মনে হয় অনেকটা কমে গেছে। আগেরকালে এত গাড়ি, মোটরসাইকেল এসবের চল ছিল না। কোথাও সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে নিজের দায়িত্বে যেতে হতো, তার জন্য বিল করলে কেউ হয়তো দিতেন, আবার কেউ প্রশ্ন তুলতেন- ‘রিকশায় না গিয়ে বাসে গেলে না কেন?’ অর্থাৎ তখন ভাবা হতো, সাংবাদিকতা করতে হলে কিংবা একজন রিপোর্টার হতে হলে তাকে সবকিছুই নিজ উদ্যোগে করতে হবে। আর এখন পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে মুক্তিযুদ্ধোত্তর নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ায় আমাদের যে দায়িত্ব বেড়ে গেছে, তার বিচারে সাংবাদিকতার ক্ষেত্র আগের চেয়ে বহুল পরিমাণে বেড়ে গেছে। আগে যেমন পিন্ডি কিংবা করাচির দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো, এখন সেটা ঢাকা-চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সভা-সমাবেশ, আন্দোলন, সংগ্রাম ইত্যাদি সবকিছুই আমাদের স্বদেশের গণ্ডির মধ্যেই ঘটছে, আর সেসব খবরই রচনা করছেন সাংবাদিকেরা। অর্থাৎ রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার প্রতিষ্ঠানের নীতি অনুসরণ করে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করছেন বটে, কিন্তু খবর সংগ্রহ ও লেখার কিংবা ছবি তোলা নিজের ইচ্ছেমতো করতে পারছেন বলে অনেক সময় মনে হয় না।

একথা সত্য যে, বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে আকার ধারণ করেছে তাতে করে নানা ধরনের বিতর্ক উপস্থাপিত হচ্ছে নানা মহল থেকে, ফলে বিভিন্ন সংবাদপত্র মালিকের চাহিদা অনুযায়ী, বড়জোর নির্ধারিত নীতি মেনে প্রতিবেদন রচনা হচ্ছে। এমনকি ছবির ব্যাপারেও কখনো কখনো একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। সংবাদপত্রের রিপোর্টিং এবং রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সংবাদগুলোর মধ্যেও নীতি ও রীতি অনুযায়ী পরিবেশন করা হয়ে থাকে।

সত্যি কথা বলতে কি, রাজনৈতিক সংবাদই এখন খবরের কাগজের বহুলাংশ জুড়ে প্রকাশিত হয় এবং তাতে বিভিন্ন পত্রিকার ভিন্ন ভিন্ন নীতি প্রকটভাবে প্রস্ফুটিত। অবশ্য ইদানীং নির্বাচনের পর সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ‘সচেতন সমতা’ মাঝেমধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কখন যে কোন পথে পরিচালিত হচ্ছে, তা সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। কারণ রাজনীতির পরিচ্ছন্নতা খুব যে সুস্পষ্ট তা যেমন বলতে পারা যাবে না, তেমনি এর পেছনে অন্তর্নিহিত কি সব কারণ আছে, তাও খুঁজে বের করতে যাওয়া যেকোনো সাংবাদিকের পক্ষে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পাঠক হিসেবে একটি কাগজ পড়ে যে ধারণা আপনার সৃষ্টি হবে, সেটাই যে সঠিক- তাও আপনি বুঝতে পারবেন না। যদি অন্য কোন পত্রিকা হাতে নেন তাহলে দেখবেন, আগের পড়া খবর এখন যেন পাল্টা ধারণা দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিতর্ক বা বিরোধের কারণে সংবাদপত্র যখন কোনো পক্ষ অবলম্বন করে, তখন পাঠক হিসেবে সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি আশ্রয় করে। এটা কিন্তু সংবাদপত্রের নীতি নয় এবং হওয়া উচিতও নয়। সংবাদপত্রের বস্তুনিষ্ঠতা একান্তই প্রয়োজনীয় বিষয়। আবার আমরা অনেক সময় বলে থাকি, ‘যা দেখবো তাই লিখবো’- এটা কিন্তু সব ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ যে সংগৃহীত সংবাদে রাষ্ট্র বা জনগণের কোনো ক্ষতি হয় বা রাজনীতিতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, তা যতই চোখে দেখেন না কেন- তা লেখা উচিত নয়।

সত্যি কথা বলতে কি, রাজনীতির ডামাডোলে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনেক সময় পক্ষপাতদুষ্ট হয়। সাংবাদিকতার নীতিমালায় এটা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আজকাল পুঁজি বিনিয়োগকারী নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে যেমন পত্রিকাকে অনেক সময় ব্যবহার করেন, আবার তেমনি রাজনীতির আবরণে অনেকটা নিজের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টাও করেন। মুশকিলটা হয় যারা এ ধরনের একপেশে, পক্ষপাতদুষ্ট অথবা স্বার্থপর পথ অনুসরণ করেন না, তারা পড়েন বিপদে, অর্থনৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবেও। যতদিন না গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হবে ততদিন এই ‘দুরবস্থা’ চলতেই থাকবে অথবা মেনে নিতেই হবে। মালিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের সবারই জন্যে যেন এ এক অশনিসঙ্কেত। 

আমাদের দেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সম্পাদকের যে গুরুত্ব ছিল আগেরকালে, তা আজকাল যেন অনেকটাই কমে এসেছে। আগে যেমন সম্পাদক পত্রিকার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতেন, এখন এটি উল্টে গেছে। মালিকের ‘নাক গলানো’ বলবো না, নীতি নির্ধারণীতে তার স্বার্থে প্রভাব অনেকটাই যে খাটান, সেটাও স্পষ্ট। 

আরেকটা দিক খুবই প্রণিধানযোগ্য- সরকার, মালিক এবং সাংবাদিক-কর্মচারী সম্মিলিতভাবে ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে বেতন বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণা করেন, তা সব মালিকরা মেনে চলেন কি? খোঁজ নিলে দেখা যাবে সরকারি নির্দেশের বা পালনীয় নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এতে করে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বেতন বৈষম্য, সুযোগ-সুবিধার অভাব ওদের মানসিকভাবে পীড়িত করছে। আমার ধারণা- এতে কর্মীদের কাজের স্পৃহা কি প্রয়োজনমাফিক কার্যকর থাকে? মোদ্দা কথা, বেতন বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণা করার পর সংবাদপত্রগুলো কতখানি বাস্তবায়ন করছে, সরকারের পক্ষ থেকে তা দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। 

মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশে দীর্ঘ আটচল্লিশ বছর চলে যাচ্ছে- অষ্টম, নবম ওয়েজবোর্ড ঘোষণাও হচ্ছে, কিন্তু এটি বাস্তবায়নে যে ‘ফাঁকফোকড়’ থেকে যাচ্ছে, তা হয়তো সরকারকে কোনো কারণে উদ্বিগ্ন করছে না। আর তা সাংবাদিক ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। আমার তো মনে হয়, বর্তমানে দ্বিখণ্ডিত সাংবাদিক ইউনিয়নের কারণে মালিকরা এই সুযোগ ও ‘লুকোচুরি’ করতে দ্বিধা করছেন না। সরকারের কি কোনো দায়িত্বই নেই এ ক্ষেত্রে?

এ পর্যায়ে একটি দুঃখজনক বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি- বর্তমানে বাংলাদেশে যে প্রায় চব্বিশ-পঁচিশটি টেলিভিশন চ্যানেল চালু আছে, সেখানে প্রযোজক ও তাদের সহযোগী-সহকারী, রিপোর্টার এবং ক্যামেরাম্যানরা বহুবছর ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং প্রয়োজনে সময়ের কথা চিন্তা না করে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের কথা কেউ ভাবছেন না কেন? আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে দ্বিখণ্ডিত সাংবাদিক ইউনিয়নও কোনো চিন্তাভাবনা করছে না। এ ব্যাপারে নতুন তথ্যমন্ত্রী সেদিন পরবর্তী ওয়েজবোর্ডে টেলিভিশনকর্মীদেরও অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, টেলিভিশনে কাজের ধরন ভিন্নতর, এমনকি সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানকে যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ইত্যাদি কাভার করতে হয়, তাতে কিন্তু সময়ের কোনো বালাই থাকে না। টেলিভিশনের যেকোনো কাজ সম্পূর্ণ করতে গেলে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানদের প্রয়োজনে অনেক বেশি সময় কাজ করতে হয়, তার কোনো হিসাব থাকে না। আবার দিন কি রাত তাও এদের ক্ষেত্রে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। সুতরাং নতুন মন্ত্রীমহোদয়ের আশ্বাস আশাব্যঞ্জক হলেও কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকি, বিপদ, সময়সীমা ইত্যাদি বিবেচনা করে বেতন কাঠামো ঠিক করলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে। যেন এ আর বিড়ম্বিত বা বিলম্বিত না হয়। 

আজকাল আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে সাংবাদিকতা। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালনকে ঠেকাতে না পারায় ইতিমধ্যেই যশোরের শামছুর রহমান থেকে আরম্ভ করে খুলনার মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালু, বগুড়ার দীপঙ্কর চক্রবর্তী, ঢাকার সাগর-রুনির মতো সাহসী ও সৎ সাংবাদিকতার প্রতীক অকারণে ঝরে যেতে হয়েছে। এ নিয়ে সরকার আজও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সাংবাদিকরা পেশাগত কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সংবাদ সংগ্রহ করেন, কিন্তু তাই বলে তাদের জীবনের কোনো মূল্য থাকবে না, এটা হতে পারে না। তারা পত্রিকা এবং মালিকের জন্যে বেতনের বিনিময়ে কাজ করছেন বটে, পেশার চরিত্র হিসেবে এই সাংবাদিকতা তাদের নেশায়ও ঢুকে গেছে। একথা রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে- কোনো রাজনৈতিক পক্ষ যেন সাংবাদিকদের জীবনের ওপরে হামলা চালাতে না পারে সেদিকটাতেও রাষ্ট্রের ও সরকারের নজরদারী প্রখর করতে হবে। সাংবাদিককে কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে? তারা তো দেশ ও জনগণের জন্যও সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ যেমন সাংবাদিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে, তেমনি সন্ত্রাসী-মৌলবাদীরাও। এই হুমকির মোকাবিলা করতে হলে সাংবাদিকদের সংঘবদ্ধতা অপরিহার্য। 

দুর্ভাগ্য হলো- পাকিস্তান আমলের ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আজ দ্বিখণ্ডিত। শুধু কি তা-ই, সংবাদপত্রের কোনো অফিসেই আগের মতো পক্ষ-বিপক্ষ কারো সাংবাদিক ইউনিয়নের কোনো ইউনিটও নেই। ফলে অফিসে অফিসে কার্যক্ষেত্রের নিরাপত্তা, চাকরির নিশ্চয়তা, সময়মতো বেতন পাওয়ার প্রতিশ্রুতি, বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধিসহ নানা সুযোগ-সুবিধাদি আদায়ে কোনো চেষ্টাও নেই। পাকিস্তান আমলে আমরা ঔপনিবেশিক শোষক, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে বেতন বোর্ড আদায় করেছিলাম, তাও আবার সামরিক শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে। অথচ আজ মুক্ত স্বদেশে যথার্থ বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করতে পারছি না। আগের চেয়ে সংবাদপত্রের সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে, বেড়েছে সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীর সংখ্যাও। সঠিক তথ্য নির্ণয়ের মাধ্যমে সংবাদপত্র অফিসগুলোতে বেতনবোর্ড রোয়েদাদ সত্যিই যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা খুঁটিয়ে না দেখলে, উদ্বেগ ও অসন্তোষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবেই। এককভাবে কোনো সাংবাদিক এর প্রতিবাদ করতে ও প্রতিকার চাইতে পারবে না, সেখানে সাংবাদিক ইউনিয়নের বলিষ্ঠ ভূমিকা অপরিহার্য। 

সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে আকূল আবেদন- রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক কাজের দিকে নজর না দিয়ে সত্যিকার অর্থেই দেশ ও সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিজেদের নিবেদন করুন। তবেই যথার্থ সাংবাদিকতা এই ক্ষেত্রের পেশাজীবী মাত্রই প্রীত হবেন এবং পাঠক সমাজের সাধুবাদ পাবেন। তাই সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও কর্মী বন্ধুদের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সনির্বন্ধ অনুরোধ রেখে সাংবাদিকতা পেশার মানকে সমুন্নত রাখবেন এই শুভকামনায় শেষ করছি।


লেখক : সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //