জুলাই মাসে হামলা-মামলার শিকার ৪৮ সাংবাদিক

সরকার পতন আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই ছিল একটি উত্তাল মাস। এই মাসের গত ৩০ দিনে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের জেরে হামলা ও মামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৪৮ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে পেশাগত দায়িত্বপালনকালে হামলা, নির্যাতন ও বাধার মুখে পড়েছেন ৩৫ জন সাংবাদিক এবং মামলার আসামি করা হয়েছে ১৩ জন সাংবাদিককে। মামলায় আসামি হওয়া ১৩ সাংবাদিকের মধ্যে ৯ জনকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আসামি করা হয়েছে।

এর আগে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে (জানুয়ারি থেকে জুনে) মোট ১৫০ জন সাংবাদিক নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। খুন হয়েছেন দুইজন।

ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি গত ২৮ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহকালে এবং ১৮ জুলাই ফেনীতে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি চলাকালে হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা।

এছাড়া সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও লাকসাম, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে। এসব হামলার বেশিরভাগই পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের মাধ্যমে ঘটেছে।

দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র ও শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংবাদ পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মনিটরিং কমিটি সাংবাদিক নিপীড়নের এই চিত্র পেয়েছে। তবে আরো কয়েকটি ঘটনা থাকলেও যেসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি তা এই পরিসংখ্যানে যুক্ত করা হয়নি।

বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ ও মহাসচিব নুরুল আমিন রোকনের নেতৃত্বে এই মনিটরিং কমিটিতে কাজ করছেন সহ-সভাপতি রাশিদুল ইসলাম, সহকারী মহাসচিব শহীদুল্লাহ মিয়াজী, প্রচার সম্পাদক মাহমুদ হাসান ও দফতর সম্পাদক তোফায়েল হোসেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৮ জুলাই সিরাজগঞ্জের তাড়াশে মারধরের শিকার হন সাংবাদিক আবদুস সালাম। তিনি স্থানীয় আমাদের বড়াল পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। মাদককারবারিরা তার ওপর এ হামলা চালিয়েছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

১৪ জুলাই নোয়াখালীতে বিএনপির সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহে যাওয়ার সময় লাকসামে সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হন ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক বাবুল তালুকদার। তাদের বহনকারী মাইক্রোবাস ভাঙচুর করা হলে তিনি কোনো রকমে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।

১৮ জুলাই গাবতলী থেকে বিএনপির পদযাত্রার কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে সংঘর্ষে আহত হন যমুনা টিভির সাংবাদিক শরীফুল ইসলামসহ কয়েকজন। একই দিন ফেনীতে বিএনপির পদযাত্রার সংবাদ সংগ্রহকালে আওয়ামী লীগের হামলা এবং ফেনী প্রেসক্লাবে আক্রমণের সময় স্থানীয় ১১ জন সাংবাদিক হেনস্থার শিকার হয়েছেন। হেনস্তা ও হুমকির শিকার সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এন এন জীবন, মানবজমিন প্রতিনিধি নাজমুল হক শামিম, মোহনা টিভি প্রতিনিধি তোফায়েল আহমেদ নিলয়, বাংলাভিশনের ক্যামেরা জার্নালিস্ট মিরাজুল ইসলাম মামুন, সময় টিভির ক্যামেরা জার্নালিস্ট মীর হোসাইন রাসেল, ডিবিসি টেলিভিশনের প্রতিনিধি দুলাল তালুকদার ও ফেনীর তালাশের রিপোর্টার এম এ আকাশ।

২৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে নিজ এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন দৈনিক আমাদের কণ্ঠের ক্রাইম রিপোর্টার ও ডিইউজের নির্বাহী সদস্য রাজু আহমেদ। এলাকায় চুরি, ছিনতাইসহ অপরাধ নিয়ে কথা বলায় তার ওপর হামলা চালায় বলে রাজু জানান।

২৪ জুলাই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে সন্ত্রাসী হামলায় আহত হন এশিয়ান টেলিভিশনের প্রতিনিধি, চৌদ্দগ্রাম প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও চৌদ্দগ্রাম টেলিভিশন সাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন নয়ন। উপজেলা পরিষদের কাছে দোয়েল চত্বরে দিন-দুপুরে তার ওপর হামলা করে অজ্ঞান হয়ে পড়ার পর সন্ত্রাসীরা বীরদর্পে চলে যায়। আগের দিন ২৩ জুলাই স্থানীয় ভোরের কলাম পত্রিকার প্রতিনিধি আতাউর রহমান রিপনের ওপরও সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। সংবাদ প্রকাশের জের এ দু’টি হামলা হয় বলে জানা গেছে।

২৭ জুলাই সিলেটের আদালত প্রাঙ্গণে হামলায় রক্তাক্ত হন স্থানীয় দৈনিক শুভ প্রতিদিনের সহকারী সম্পাদক অ্যাডভোকেট তাজ উদ্দিন। তিনি দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি ও সিএসবি টেলিভিশনের সাবেক সিলেট প্রতিনিধি এবং সিলেট মেট্রোপালিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য। তুচ্ছ ঘটনায় হামলা করে তার নাক ফাটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়।

২৮ জুলাই ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশের সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত শেয়ারবিজের বীর সাহাবীর মোবাইল কেড়ে নেন এবং হেনস্তা করেন পুলিশের এসি আবদুল্লাহ আল মামুন। এ নিয়ে এসি মামুনের সাথে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে তুমুল বচসা হয়। পরে চাপের মুখে ফোন ফেরত দিতে বাধ্য হন। একই দিন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় হামলার শিকার হন দৈনিক কালের কণ্ঠের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি বিশ্বজিৎ পাল। আখাউড়ার রাধানগর কমফোর্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এ হামলার ঘটনা ঘটে। ক্লিনিক থেকে একটি মেয়েকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাতে বাধা দিলে সাংবাদিক বিশ্বজিৎকে মারধর করা হয় বলে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়।

২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশ পথে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহকালে অন্তত নয়জন সাংবাদিক শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। পুলিশের টিয়ারশেল, ছরা গুলি ও সরকার দলীয় ক্যাডারদের হামলায় তারা কম-বেশি আহত হন। আহতরা হলেন যমুনা টেলিভিশনের শরীফুল ইসলাম, নিউজ টোয়েন্টিফোরের আরেফিন শাকিল ও আজনবী, যুগান্তরের তরিকুল ইসলাম, চ্যানেল আইয়ের আক্তার হোসেন ও মনির, মানবজমিনের নূরে আলম জিকু ও কিরণ শেখ এবং রেডিও ধ্বনির শাহাবুদ্দিন চৌধুরী। এছাড়া মাতুয়াইল এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও বাধার মুখে পড়েন বাংলাভিশনের সেকান্দার রেমান ও কেফায়েত শাকিল, মাইটিভির ইউসূফ আলী, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার জয়নাল আবদীন শিশির, এখন টিভির শাহরিয়ার জামান এবং বিদেশী গণমাধ্যম রাপ্টলির প্রতিনিধি হোসাইন তারেক প্রমুখ।

মামলা ও গ্রেফতার

১১ জুলাই প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মুস্তাফিজ শফিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম সিএমএম আদালতে মামলা করা হয়। চন্দনাইশের কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার পারভেজ দানু প্রকাশিত সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে এ মামলা করেন। মামলার অপর দুই আসামি পত্রিকাটির প্রকাশক কাউসার আহমেদ অপু এবং পটিয়া প্রতিনিধি শফিউল আযম।

২৭ জুলাই মিরপুরের নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দৈনিক পাঞ্জেরীর নির্বাহী সম্পাদক ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) নির্বাহী সদস্য তালুকদার নুরুল মোমেন রুমিকে। তাকে বিএনপির পদযাত্রায় সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে।

৩০ জুলাই ঢাকার কাছে সাভারে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। স্থানীয় দৈনিক ফুলকির সম্পাদক নাজমুস সাকিব ও দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের সাভার প্রতিনিধি এমদাদুল হকের বিরুদ্ধে সাভার থানায় এ মামলা দায়ের করেন শাহীনুর ইসলাম নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী। দৈনিক ফুলকিতে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবরের সাথে ভুল করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি প্রকাশ করায় এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। যদিও ভুল ধরা পড়ার সাথে সাথে সংশোধন করে ক্ষমা চায় পত্রিকাটি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সাত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন নবীনগর পৌরসভার নারী কাউন্সিলর নিলুফার ইয়াসমিন। ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সন্তান সেজে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন’ শীর্ষক সংবাদের জেরে দায়ের করা মামলার আসামিরা হলেন দৈনিক ভোরের সময়ের সাবিনা ইয়াসমিন পুতুল, দেশ রূপান্তরের জ ই বুলবুল, দৈনিক বর্তমানের মো. সফর মিয়া, ঢাকা নিউজের মমিনুল হক রুবেল এবং সত্যের সন্ধানে পত্রিকার নবীনগর প্রতিনিধি। মামলাটি গত জানুয়ারিতে দায়ের করা হলেও তদন্ত শুরু হওয়ার পর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে জানা জানি হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //