করোনাকালে মিডিয়ার ভূমিকা

রুপার্ট মারডকের কথা হয়তো এখনকার ওয়েব প্রজন্ম জানবে না। যারা প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ শুরু করেছিলেন তদের অনেকেই এই নামটি জানেন। মারডক একজন মিডিয়া ব্যবসায়ী। ‘নিউজ করপোরেশন’-এর মালিক। সারাবিশ্বে কয়েকশ’ পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল রয়েছে তার। দৈনিক পত্রিকা, ট্যাবলয়েড, ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেল, চলচ্চিত্র, বই প্রকাশনা, শেয়ার ব্যবসা, ওয়েব পোর্টাল- কী নেই! মিডিয়া বাণিজ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া তার দখলে। আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্রের মালিকানাও তার। তার প্রকাশিত খবরেই নড়ে ওঠে গোটা বিশ্ব। কয়েকটি দেশে তার প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক চালে সরকার বদল হয়, যুদ্ধ বাঁধে সে কারণেই রুপার্ট মারডককে মিডিয়া সাম্রাজ্যের ‘বাদশাহ’ মানা হয়।

তারপরও এই দেশে বর্তমানে অন্তত ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশজন মারডকের ‘বাংলাদেশি ভার্সন’ রয়েছে। তারা টিভি চ্যানেলের মালিকই হয়েছেন এটাকে আরেকটা লাভজনক ব্যবসা সাব্যস্ত করে, সেই সঙ্গে আরও ডজনখানেক ব্যবসার ‘এপিটাইজার’ কিংবা ‘ব্যাকআপ ফুয়েল’ হিসেবে। এর মধ্যে কেউ কেউ এই ব্যবসা-বাণিজ্যটা একটু রুচিসম্মতভাবে করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ দলবাজি বা চাটুকারি করলেও, সেটি মাটিতে উপুড় হয়ে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণামের মতো নয়, একটু দূর থেকে মেরুদণ্ড বাঁকা করে বো-করা! আর বিস্তর ডিগ্রি নেয়ার পরও যারা শিক্ষার ছোঁয়া পাননি, তারা প্রয়োজনে ক্ষমতাবলয়ের চারপাশে মাছির মতো ভন ভন করতে থাকেন।

জনে জনে ফালা ফালা করে মিডিয়া ব্যবচ্ছেদ উদ্দেশ্য নয়। এ নিয়ে বলতে শুরু করলে শেষ হবে না। শুধু তিনটি উদাহরণ দিয়ে এই চ্যাপ্টার ক্লোজ করব- নিজেদের গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির বিজ্ঞাপন বেশি বেশি প্রচার করবেন, সেটি কোনো ফর্মেটেই দোষের কিছু নয়; কিন্তু সেটি যখন ‘সাদা ছাগলটাও আমার, কালো ছাগলটাও আমার’-এর মতো বিরক্তিকর হয়, তখনই দোষের। কিছু চ্যানেলকে দেখা যায় নির্বাচনের সময়ে দলে তিনশ’ সংসদ সদস্য থাকলেও তাদের মালিক কোথায় কী বলেছেন, সেটিই বারে বারে প্রচার করে। কোনো চ্যানেলকে দেখা গেছে সুন্নতে খতনা বা জন্মদিনের খানাপিনার লাইভ টেলিকাস্ট করছে, কোনো চ্যানেল আবার বায়তুল মোকাররমের জুমার নামাজ লাইভ দেখায়- এরকম ডজনখানেক ‘অপেশাদারিত্ব’ আছে। থাকুক। সর্বশেষটা বলি- এক মালিক উপনির্বাচনে প্রার্থিতার দাবিদার। তিনি আপামর জনসাধারণকে ধরে ধরে প্রার্থিতার জন্য মাননীয় অমুকের কাছে মিনতি করাচ্ছেন। মুখস্ত করার পরও কেউ হয়তো বলে বসছেন- ‘উনাকে ভোট দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি’। এমন বহুবিধ স্টাইল আর প্যাশন নিয়ে যে খানা চল্লিশেক টিভি চ্যানেল চলছে, তাদের উল্লেখিত এইসব আচরণ বিরক্তিকর, হাস্যকর বা বিব্রতকর হলেও ভীতিকর নয়। আতঙ্ক ছড়ায় না। তবে এখন, এই করোনাকালে তারা যা করছে, সেটি রীতিমতো উদ্বেগজনক!

এসব মিডিয়া, বিশেষ করে চ্যানেলগুলো যারা প্রিন্টেড মিডিয়ার চেয়েও শক্তিশালী, তারা একটি ‘না’ উচ্চারণ করলেও আটষট্টি হাজার বর্গমাইলে সেটি প্রতিধ্বনিত হয়। এই করোনাকালে সারাবিশ্বের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষও অকাতরে মরছে। আক্রান্ত হচ্ছে। ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে হাত-পা গুটিয়ে অর্ধমৃত হয়ে থাকছে। ঠিক সেই সময় আমাদের মিডিয়া অতিআবেগী হয়ে, অতিউৎসাহী হয়ে এবং টিআরপি বাড়ানোর জন্য অতিপ্রতিযোগী হয়ে মানুষকে আরও বেশি আতঙ্কিত করছে! মানুষকে প্রতি মুহূর্তে সাহস দেয়ার নাম করে শক দিচ্ছে কীভাবে? দেখুন-

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কভিড-১৯ সংক্রমণে মৃতদের দাফনের দৃশ্যগুলো ঝাপসা করছে না। ঘন ঘন স্ক্রল, পপআপ, এল-শেপড পপআপ দিতে থাকে- যার সবই ভয়ের সংবাদ। স্মিত হাসি দিয়েই কেউ বলা শুরু করল- কভিড-১৯ এর লেটেস্ট ‘হটস্পট’ ব্রাজিল! কেন? ‘হটস্পট’ বলতে হবে কেন? এটা কি ফিল্ম হিট করানোর সেই হার্টথ্রব হট নায়ক-নায়িকার ব্যাপার?

এরই মধ্যে প্রতিদিন কয়েকবার করে নামি-বেনামি ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, হোমিও, অ্যালোপ্যাথি, আয়ুর্বেদি, ইউনানি, পীর-মাশেয়েক হাজির করে করোনাভাইরাস বিষয়ক জ্ঞান দেয়া হয়। এত এত বিচিত্র ধরনের ডাক্তার-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, প্রেসক্রিপশন, পালনীয় পদ্ধতি শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষ চরমভাবে বিভ্রান্ত! তারা হয়তো সকালে এক চ্যানেলে শুনতে পেল- করোনাভাইরাস তিন ফুট দূর অব্দি যেতে পারে। তাই তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। সন্ধ্যায়ই আরেক চ্যানেলে আরেক বিশেষজ্ঞ ভারিক্কি চালে বলে বসলেন- বাতাসে এ ভাইরাস ১০/১২ ফুট যেতে পারে, সুতরাং মাস্ক কখনোই খোলা যাবে না। এর সঙ্গে আছে সান্ধ্যকালীন এবং রাত্রিকালীন টকশো। সেখানে আজকাল বৃন্দ আবৃত্তির মতো হয় অনলাইনে ৪ থেকে ৮ জন পর্যন্ত আলোচনা করতে থাকেন। তাদের সবার কথার নির্যাস- ‘ভয়ের কিছু নেই। নিজের নিরাপত্তা নিজের কাছে। মানসিক সাহসই করোনাকে জয় করতে পারে। ভালো ভালো পুষ্টিকর খাবার খান, ইমিউনিটি বাড়ান। ঘরে থাকুন। নিরাপদ থাকুন।’ অথচ এই শেষ কয়েকটি কথা বলার আগে মানুষের কলিজা পর্যন্ত ভীতি প্রবিষ্ট করানো হয়েছে আর বিস্ময়করভাবে তা ক্রমাগত করা হচ্ছে। মিডিয়া রোজ রোজ সেই কলিজা কাঁপানো আলোচনা করিয়েই যাচ্ছে!

আক্রান্ত হলে কী করবেন, তার একটা ব্যবস্থাপত্রের নমুনা-

সার্বক্ষণিক সঙ্গে যা যা রাখবেন- প্লেট, জগ, বাটি, গ্লাস, চামচ, ইলেকট্রিক কেটলি, ফ্লাস্ক, ডাস্টবিন, টিস্যু, স্যাভলন, ফ্লোর ক্লিনার, ব্লিচিং ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ইনফ্রারেড থার্মোমিটার, পালসঅক্সিমিটার, ইনহেলার, নেবুলাইজার, ওষুধপত্র। সঙ্গে খাবার নিয়ে বিশাল এক ফর্দ। মনকে প্রফুল্ল রাখা, প্রার্থনা, ব্যায়াম, গোসল ও পানাহার। প্রতিদিন গোসলের আগে পুরো রুম এন্টিসেপটিক ওয়াশ, প্রতিদিনের পরিহিত কাপড় এক ঘণ্টা ডিটারজেন্টে ভিজিয়ে ধুয়ে ফেলা। ৪-৬ বার গরম পানির গড়গড়া, ভাঁপ নেওয়া, মসলা চা, মধু, লেবু, কালোজিরা ইত্যাদি।

এখানেই শেষ নয়। এইসব প্রচার চলতে থাকলে, মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আগেই অর্ধমৃত হয়ে যাবে। বিশ্বে এবারই প্রথম মহামারি হয়নি। এর আগেও ভয়াবহ মহামারি এসেছে। সে সময় মিডিয়া ছিল না। সে সময় মিডিয়ার এখনকার ভূমিকা থাকলে হয়তো এত মানুষ মারা যেত না।

এখন মিডিয়া ‘এটাকিং মেথডে’ প্রচার চালাচ্ছে বলে সারা বিশ্বেই মৃতের সংখ্যা কম। অর্থাৎ মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ সচেতন হওয়ায় মৃত্যুহার কম। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, মিডিয়ার এই আগ্রাসী ভূমিকা না থাকলে এতদিনে বিশ্ব প্রায় কোটি মানুষের মৃত্যু দেখত- এসবই মিডিয়ার ইতিবাচক দিক। তারপরও নেতিবাচক দিকটি কেন আলোচিত হচ্ছে? কারণ, মানুষ মরার আগেই অর্ধেক মরে যাচ্ছে। তারা মিডিয়ার এত সব সঠিক-বেঠিক খবর না জানলে ভেতরে ভেতরে ভয়ে এতটা কুঁকড়ে যেত না। তাদের ইমিউনিটি শূন্য হয়ে যেত না। 

জাতিসংঘের ফাঁস হওয়া একটি আন্তঃসংস্থা নথিতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের বিস্তার, প্রশমন ও অবদমনে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া না হলে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ‘জাতীয় প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা’ (সিপিআরপি ভি১) শীর্ষক ওই নথিতে এই সংখ্যাকে ‘ভয়াবহ’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের এই নথিটি দেয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশ প্রতিনিধি বারদন জং রানা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, ওই নথিটি ডব্লিউএইচওর নেতৃত্বে প্রস্তুতকৃত আন্তঃসংস্থা নথি। এই খবরটি প্রিন্ট এবং টিভি মিডিয়া প্রচার করার আগে ভাবেনি এটি কী ভয়ানক প্রভাব ফেলতে পারে! আমরা বিভিন্ন সময়ে বলতে শুনি- মিডিয়া নিরপেক্ষ। কথাটি সম্পূর্ণ ভুল। সংবাদমাধ্যম কখনো নিরপেক্ষ হয় না। হতে পারে না। লেখকরা যেমন মনের অজান্তেই সম্মানীয় ব্যক্তির সম্বোধনে ‘চন্দ্রবিন্দু’ ব্যবহার করেন, তেমনি মিডিয়াও অজান্তেই ‘সে’ আর ‘তিনি’কে আলাদা করে ফেলে!

মিডিয়া অবশ্যই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা লাভজনকভাবে চালাতে হলে তাকে যা যা করতে হয় তার সবই সে করবে। এটা তার অধিকার। তবে জগতের কোথাও কেউ নিরপেক্ষ না হলেও ‘নৈতিকতা’ আর ‘অনৈতিকতা’র বিভাজন আছে। থাকেই। থাকবেও। করোনাভাইরাস নিয়ে খবর প্রচার করা মিডিয়ার ব্যবসায়িক কাজ হলেও এটি নৈতিকতা। আর সেই খবর প্রচার করে সাধারণ মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়া অনৈতিকতা। সারাদিন ঘরে বন্দি মানুষের এখন অন্যতম কাজ টিভি খুলে বসে থাকা আর আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা দিয়ে ভূত-ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, তা ভেবে ভেবে কুল-কিনারা খোঁজা। সেই সময়ে মিডিয়াকে অবশ্যই আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //