সোলেইমানি-মোহসেন হত্যা একসূত্রে গাঁথা!

ইরানের শেষ রাজা মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে নিজের দেশে পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করেছিলেন, তাও আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। আর এখন ইরানের সেই কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন সরকারেরই সবচেয়ে মাথাব্যথা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিত্র ইসরায়েল। 

সময়ে সময়ে টানটান উত্তেজনা। ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ইরানের পাঁচ পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে গত ২৭ নভেম্বর, শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেহ হত্যার মধ্য দিয়ে। 

এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ইরানের অভিযোগের তীর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। আবার কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, মোহসেনকে হত্যা ও মার্কিন হামলায় ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলেইমানির মৃত্যু একইসূত্রে গাঁথা। ফখরিজাদেহর ওপর অবশ্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আক্রোশ পুরনো। ইরানের পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচির বিষয়ে অভিযোগ করতে গিয়ে ২০১৮ সালে এক অনুষ্ঠানে ওই বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করে নিজের বাহিনীকে তিনি বলেছিলেন- ‘সেই নাম মনে রেখো।’ 

তাই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও নানা হিসাব কষে ইসরায়েল-মার্কিন জোটের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে তেহরান। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, ‘ইরানের শত্রুরা মোহসেনকে ঘৃণা করত। ওকে থামানো যাচ্ছে না দেখে তারা চরম হতাশায় ভুগছিল। তাই এ হত্যাকাণ্ড; কিন্তু এতে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার গতি কমবে না।’ 

তবে এই ফাঁদে পা দিয়ে কোনো যুদ্ধে জড়াবেন না উল্লেখ করে রুহানি বলেছেন, ‘ইরান অবশ্যই এ হত্যার প্রতিশোধ নেবে; সেটি নিজেদের পছন্দমতো কোনো সময়ে।’ প্রতিশোধ নেয়ার কথা বলেছেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিও।

কে এই মোহসেন ফখরিজাদেহ

রাজধানী তেহরানের পূর্বাঞ্চলীয় আবসার্দ শহরে চোরাগোপ্তা হামলায় নিহত হন ৫৯ বছর বয়সী মোহসেন ফখরিজাদেহ। এরপর তাকে শুধু দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবনী সংস্থার প্রধান হিসেবে উল্লেখ করে ইরান। যদিও ইসরায়েলের চোখে তিনি ছিলেন ইরানের ‘পরমাণু কর্মসূচির জনক’। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমা দেশও তাকে গোপন পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। 

তবে অনেকটাই অপরিচিত মোহসেন ফখরিজাদেহর আসল পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকেরই। এমনকি নিজ দেশের অধিকাংশ মানুষেরও তার সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুযায়ী, মোহসেন ২০০৩ সালে স্থগিত হয়ে যাওয়া ইরানের পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচির সমন্বয়ক ছিলেন। পরবর্তীকালে তা স্থগিত হলেও অন্য প্রকল্পের আড়ালে সেই কাজ অব্যাহত রাখেন এই পরমাণু বিজ্ঞানী। 

তাছাড়া মোহসেন ফখরিজাদেহই একমাত্র বিজ্ঞানী, যার নাম ২০১৫ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার (আইএইএ) দেয়া চূড়ান্ত মূল্যায়নপত্রে উল্লেখ রয়েছে। ২০১১ সালের আইএইএর প্রতিবেদনেও তাকে ‘আমেদ’ (আশা) প্রকল্প পরিকল্পনার ‘কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যে প্রকল্পের আড়ালে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে বলে অভিযোগ ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের।

পরমাণু না-কি অন্যকিছু

একাধিক মার্কিন গোয়েন্দা নিশ্চিত করেছেন, হামলার নেপথ্যে ইসরায়েলই ছিল। এছাড়া কয়েক দিন আগে সৌদি যুবরাজ, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গোপন বৈঠকের সঙ্গেও এ হত্যাকাণ্ডের সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দুই মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও হোয়াইট হাউসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, মোহসেন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসরায়েল জড়িত। তবে ওই তিন কর্মকর্তা বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি। 

ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমির হাতামি বলেছেন, ‘মোহসেন ফখরিজাদেহকে এর আগেও একাধিকবার হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে।’ কাসেম সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডের সাথে এই হত্যাকাণ্ড ‘পুরোপুরি সম্পৃক্ত’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

ইউরোপীয় কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সদস্য এলি জারানমায়েহর অবশ্য মনে করেন, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করতেই মোহসেনকে হত্যা করা হয়েছে। জারানমায়েহ বলেন, ‘ইরানকে উস্কানি দিতে ও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতিকে বেকায়দায় ফেলাও একটা উদ্দেশ্য হতে পারে। কেননা কয়েক দিন আগেই সৌদি যুবরাজ, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোপন বৈঠক করেছেন।’ 

এই কূটনীতিকের মতোই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আয়াতুল্লাহ খামেনির সামরিক উপদেষ্টা হোসেইন দেহগান, ‘ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার আগে ইসরায়েলকে সাথে নিয়ে ইরানকে পুরোদমে যুদ্ধে জড়ানোর চেষ্টা করছেন।’ দেশটির প্রেস টিভির বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, মোহসেন ফখরিজাদেহকে হত্যায় যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তা ইসরায়েলের তৈরি। হামলার পর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের গায়ে রয়েছে নেতানিয়াহুর সামরিক কারখানার লোগো। এটি যে তাদের তৈরি, তাও বলা আছে সুনির্দিষ্টভাবে।

নাক কেটে হলেও বাইডেনের পথ রুখবেন ট্রাম্প!

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে আগামী ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের হাত থেকে ক্ষমতা বুঝে নিতে চলেছেন জো বাইডেন। এরই মধ্যে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্সি গ্রহণের পর তিনি ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে মন দেবেন। নির্বাচনি প্রচারের সময়ও এই ডেমোক্র্যাট নেতা  বিষয়টি পরিষ্কার করেছিলেন, ইরানের সাথে করা পারমাণবিক চুক্তিতে তিনি ফিরে যেতে চান। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ছিলেন ওই চুক্তির প্রধান উদ্যোক্তা। বাইডেন তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট। তবে ক্ষমতায় এসে সব ওলট-পালট করে দেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরানের সাথে করা চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে একতরফাভাবে নিজের দেশকে প্রত্যাহার করে নেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানও নতুন করে নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরুর ঘোষণা দেয়। ট্রাম্প ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। রণতরী পাঠানোর পাশাপাশি যুদ্ধবিমানও মোতায়েন করে ওয়াশিংটন; কিন্তু যুদ্ধের সেই ডামাডোলে ইরান পা ফেলেছে খুব মেপে মেপেই। 

অবশ্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ট্রাম্পের প্ররোচনায় এখন সংঘাত শুরু হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিএনএনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্পাদক নিক প্যাটন ওয়ালশ। এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘ট্রাম্পের শেষ ৫০ দিনের মধ্যে ইরানকে চাপে ফেলা বিরোধী রাষ্ট্রগুলোর আপাত লক্ষ্য। আমি মনে করি, ইরানের শত্রুপক্ষ ও সম্ভবত ইরান নিজেও এই মুহূর্তে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘ভবিষ্যতে ইরানের সাথে চুক্তি করাকে অসম্ভব করে তুলতে যতটা সম্ভব চেষ্টা করে যাবেন ট্রাম্প। তবে আমার বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত আমরা সবাইকে আলোচনার টেবিলেই বসতে দেখবো।’ চলতি বছর জানুয়ারিতে মার্কিন সেনাদের হাতে ইরানের জেনারেল কাসেম সোলেইমানি হত্যার ঘটনাতেও পুরাদস্তুর একটি যুদ্ধের রূপ না নেয়ায় ইরানের ধৈর্য্যরে প্রশংসা করেছেন এই বিশ্লেষক। মোহসেন ফখরিজাদেহর হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি মন্তব্য করেন, ‘শত্রুরা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। তারা বুঝতে পারছে, বিশ্বের পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। হাতের বাকি সময়টায় তাই তারা এ অঞ্চলে একটি অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

ইরানের শক্তি নিয়েও উঠছে প্রশ্ন

মোহসেন ফখরিজাদেহর ওপর যখন হামলা হয়, তখন তার সাথে ছিলেন বেশ কয়েকজন দেহরক্ষী। তাতেই বোঝা যায় তার নিরাপত্তাকে ইরান কতটা গুরুত্ব দিত। এই হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতারাও একের পর এক প্রতিশোধের বার্তা দিচ্ছেন। তবে দেশটির ভেতরের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা দুর্বলতা নিয়েও উঠছে কথা। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইরানের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার যখন তাদের সেনা ও গোয়েন্দা দক্ষতা নিয়ে এতটা বড়াই করে, তখন কীভাবে নিরাপত্তার আবরণে ঢাকা একজন বিজ্ঞানী দিন-দুপুরে এভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন? এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দেশের ভেতর নির্বিচারে ধরপাকড়েরও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। 

ইরানের রেভলিউশনারি গার্ড বাহিনীর প্রভাবশালী কমান্ডার মোহসেন রেজায়েই বলেন, ‘আমাদের ভেতরে ঢুকে পড়া গুপ্তচর, যারা বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে খবর দিচ্ছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে।’

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলারের মতে, উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থার মধ্যেই পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন হত্যাকাণ্ড ঘটল। মিলার বলেন, ‘এ রকম একটা উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা ও বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণ- এ দুয়ের মাঝখানের সময়ে ইরান খুব টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মোহসেন হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য এটিই যে মোক্ষম সময়, সেই হিসাব সূক্ষ্মভাবেই করতে পেরেছে ইসরায়েল।’ 

শুধু এটিই নয়, এ রকম আরো ঘটনা ঘটতে চলেছে আর এতে আগামী কয়েক মাসে উত্তেজনা বেশ বাড়বে বলেও আশঙ্কা মিলারের।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //