সুয়েজ খাল আটকে যাওয়া কি দেখিয়ে দিচ্ছে?

অতিগুরুত্বপূর্ণ নৌপথ সুয়েজ খালে আটকেপড়া দৈত্যাকৃতির কনটেইনারবাহী জাহাজ ছাড়ানো সম্ভব হওয়ায় সারাবিশ্বের মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে বিশ্লেষকরা একমত যে, এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। 

মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০০ মিটার লম্বা জাহাজ ‘এভার গিভেন’ যখন খালের সরু জায়গায় আটকে যায়, তখন অনেকেই এর অর্থনৈতিক ক্ষতি হিসাব করতে শুরু করে। এই পথে প্রতিদিন গড়ে ৫০টি জাহাজ যাতায়াত করে। দৈনিক ৯.৬ বিলিয়ন ডলার বা বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ এই পথের মাধ্যমে হয়ে থাকে। 

সাপ্লাই চেইন কনসালট্যান্সি কোম্পানি ইনটেরোসের প্রধান নির্বাহী জেনিফার বিসেইলি বলেন, ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে হঠাৎ করেই অনেকে বুঝতে শুরু করল যে, সাপ্লাই-চেইনের বেশিরভাগই চীনে পুঞ্জীভূত হয়ে গেছে। তাই অনেকেই চীনের বিকল্প সাপ্লাই-চেইন তৈরি করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এখন সমুদ্রপথে এমন ঘটনার ফলে একটি বড় জাহাজে সব পণ্য তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে দু’বার চিন্তা করার সময় এসেছে। 

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, খুব বেশি সময়ের জন্য খাল না আটকানোর ফলে বিশ্ব বাজারে পণ্য মূল্যের ওপর এর প্রভাব খুব একটা হবে না। তাই আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে বিকল্প পথগুলো নিয়ে।

সুয়েজ খাল আটকানো অবস্থায় বিকল্প হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে পথটিকে কেউ কেউ ব্যবহার করেছে। তবে এতে দুই থেকে চার সপ্তাহ দেরি হবে ও কয়েক মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়াতে হবে। তেলের মূল্য কমে যাওয়ার সময়ে কেউ কেউ এই পথ ব্যবহার করলেও সময় কিন্তু বেশি লাগছেই। আরেকটি বিকল্প হলো- প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরকে যুক্ত করা পানামা খাল। তবে এই খাল দিয়ে এভার গিভেনের মতো বড় জাহাজ যেতে পারবে না। নতুন একটা বিকল্প পথ হিসেবে সামনে আসছে রাশিয়ার উত্তরে উত্তর মেরু ঘেঁষে ‘নর্দার্ন সী রুট’ বা এনএসআর। এই পথকে বড় কনটেইনারবাহী কোম্পানিগুলো এখনো উপযুক্ত মনে করছে না। তবে রুশরা এ ব্যাপারে এখন বেশ সরব। 

রাশিয়ার পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের বিশেষ প্রতিনিধি ভ্লাদিমির পানোভ রুশ বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্সকে বলেছেন, সুয়েজ খালের ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপ ও এশিয়ার মাঝে বাণিজ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিকল্প পথ হিসেবে এনএসআর কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এনএসআর বেশ প্রতিযোগিতামূলক খরচে পণ্য পরিবহন করার সুবিধা দিচ্ছে। 

নরওয়ের সংস্থা সেন্টার ফর হাই নর্থ লজিসটিক্সের হিসাবে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মাঝে এনএসআর দিয়ে জাহাজের যাতায়াত বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। পরিবাহিত পণ্যের পরিমাণ ৭৫ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ১০ লাখ টন। সুয়েজ খালের ১০০ কোটি টনের তুলনায় এটিা কিছুই নয়। তবে এনএসআরের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- চীন থেকে ইউরোপে যাতায়াত ৩৪ থেকে ৪০ দিনের বদলে মাত্র ২৩ দিনে সম্ভব। 

এছাড়াও রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে যাওয়া রেল সংযোগকে কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে চিন্তা করছেন; বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের ক্ষেত্রে। অনলাইন লজিসটিক্স প্ল্যাটফর্ম ওয়াইকিউএন লিঙ্কের প্রধান নির্বাহী ঝৌ শিহাও চীনা সরকারি মিডিয়া গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, রেলপথে চীন থেকে একটি কনটেইনারের ইউরোপ যেতে বর্তমানে ১৫ থেকে ২৫ দিন লাগে। আর বড় পরিসরে হিসাব করলে সমুদ্রপথ ও রেলপথে কনটেইনার পরিবহন খরচের মাঝে পার্থক্য খুবই কম। তবে একটি জাহাজের সাথে একটি রেলগাড়ির তুলনা দেয়া সম্ভব নয়। এভার গিভেনের মতো একটি দৈত্যাকৃতির জাহাজ বহন করতে পারে ২০ হাজার কনটেইনার; যা পরিবহনে লাগবে প্রায় ৫০টি রেলগাড়ি।

তবে সুয়েজ খাল বন্ধ হওয়া নতুন কিছু নয়। ১৯৫৬ সালে ও ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের কারণে খাল বন্ধ হয়েছিল। এর মাঝে ১৯৬৭ সালে বন্ধ হওয়ার পর তা আট বছর পর ১৯৭৫ সালে খুলেছিল। ব্রিটিশ পত্রিকা প্লাইমাউথ হেরাল্ড মনে করিয়ে দিচ্ছে, সুয়েজ খালে এর আগেও জাহাজ আটকে গিয়েছিল। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ার যুদ্ধ থেকে ফেরত আসা ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘ইউনিকর্ন’ খালে আটকে যায়। প্রায় চার ঘণ্টা আটকে থাকার পর দুটি টাগবোট দিয়ে প্রায় ২০০ মিটার লম্বা জাহাজটিকে টেনে বের করা হয়। তবে কেউ কেউ দুর্ঘটনা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ আটকে যাওয়ার কথা বলছেন। 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক র্যান্ড করপোরেশনের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার স্কট সাভিতজ প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ডিফেন্স ওয়ানে এক নিবন্ধে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের কারণে সরু সমুদ্রপথ বন্ধ হওয়া প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। 

তিনি বলেন, একটি পুরনো জাহাজকে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরের মুখে আড়াআড়ি রেখে দিয়ে বন্দর আটকে দেয়ার কৌশল অনেক পুরনো। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার দখল নেয়ার সময় বন্দরের মুখে দুটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে ইউক্রেনের নৌবাহিনীর জাহাজগুলোর পালানোর পথ রুখে দিয়েছিল রাশিয়া। স্কট সাভিতজের মতে, এই কাজটি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমেও সম্ভব। আবার সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কোনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও এটি করা সম্ভব।  

মার্কিন থিঙ্কট্যাক জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্সের এক লেখায় ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রিডম্যান বলেন, সুয়েজ খালের ঘটনা একটি দুর্ঘটনা হলেও তা মনে করিয়ে দিচ্ছে, যেকোনো যুদ্ধে কত সহজে এ রকম একটা সরু নৌপথ আটকে দেয়া যেতে পারে; কারণ এর আগেও যুদ্ধের কারণে নৌপথ আটকানো হয়েছে। সুয়েজ বা পানামা খালের মতো মানবসৃষ্ট খালগুলো সর্বদা সরুই হয়। তবে মালাক্কা প্রণালি, হরমুজ, বাব এল মান্ডেব বা জিব্রালটারের মতো প্রাকৃতিকভাবে তৈরি পথগুলো সে তুলনায় অনেক চওড়া। আর দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে বা আর্কটিকের এনএসআর বা মধ্য এশিয়ার রেলপথ হয়ে পণ্য পরিবহন কিছু ক্ষেত্রে সুয়েজ খালের বিকল্প হলেও খরচ, সময় বা অন্য কারণে সেগুলো সুয়েজের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারছে না। 

তাই মানবসৃষ্ট সুয়েজ খালের ওপর নির্ভরশীলতা যেমন কমে যাচ্ছে না, তেমনি ঐচ্ছিক বা অনৈচ্ছিক মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। এ কারণেই সরু এই পথগুলো সামনের দিনগুলোতে ভূরাজনৈতিক চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই থাকবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //