‘হিজাববিরোধী’ বিক্ষোভের বর্ষপূর্তি : কতটা বদলেছে ইরান

ইরানের সরকারি ‘হিজাব প্রথা’ অমান্য করায় ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সেখানকার ধর্মীয় নৈতিক পুলিশ ২২ বছরের তরুণী মাসা আমিনিকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের তিন দিন পর পুলিশি হেফাজতে রহস্যজনক কারণে এই তরুণীর মৃত্যু হয়। মাসা আমিনির মৃত্যুর খবর মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নিজ শহর সাকেজে জানাজা ও দাফন ঘিরে বিক্ষোভ হয়। একপর্যায়ে সে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। স্লোগান ওঠে— ‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতা’। এটা ছিল ইরানের ধর্মীয় শাসকগোষ্ঠীর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।

মাসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনা কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পর ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন বাড়িয়েছে শাসকগোষ্ঠী। কুর্দি এই তরুণীর মৃত্যু ঘিরে ছড়িয়ে পড়া গণবিক্ষোভের ফলে দেশটি ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর সবচেয়ে মারাত্মক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখে পড়ে। মাসা আমিনির পরিবার বলেছিল—মাথায় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, আগে থেকে থাকা অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যু হয়। কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্যে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, ওই বিক্ষোভে ইরানে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ সংখ্যা তিন শতাধিক বলে জানানো হয়েছে। এই বিক্ষোভের সম্মুখভাগে ছিলেন নারী ও তরুণরা। তারা ইসলামি রিপাবলিকের প্রতীকগুলোকে নিশানা করেন। তারা সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ছবি পোড়ান। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ বলে স্লোগান দেন। নারীদের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও নিজেদের হিজাব খুলে ও পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। নারীদের চুল ঢেকে রাখা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক করে প্রণীত আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তারা।

ইরানে হিজাব নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। ১৯৩৬ সালে রেজা শাহের শাসনামলে হিজাব পরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। পরে ১৯৪১ সালে তা প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হয়। এর পর ১৯৮৩ সাল থেকে ইরানে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে ইরানে ইসলামিক দ-বিধির ৩৬৭ ধারাকে হিজাব আইন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আইন ভঙ্গ করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ১০ দিন থেকে দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। জরিমানা করা হতে পারে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ ইরানি রিয়াল (বর্তমানে যা ১ দশমিক ১৮ ডলার থেকে ১১ দশমিক ৮২ ডলার)।

সংস্কারপন্থীদের পিছু হটা এবং ইরানের অর্থনৈতিক সংকট

সাবেক সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির দ্বিতীয় মেয়াদের শেষেই কট্টরপন্থীরা শক্তিশালী অবস্থান নেওয়া শুরু করে। ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রক্ষণশীল ইব্রাহিম রাইসি জয়লাভ করেন। তাকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির একান্ত অনুগত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ক্ষমতায় আসার পর রাইসির নের্তৃত্বাধীন প্রশাসন একদিকে যেমন আধুনিকপন্থী এবং সংস্কারপন্থীদের যেমন ক্ষমতার বলয় থেকে বিলীন করার প্রক্রিয়া শুরু করে, তেমনি পুরনো কট্টর আইনগুলো সক্রিয় করে তোলে। তারই ধারাবাহিকতায় নীতি পুলিশ বাহিনীকে আগের চেয়ে আরও ক্ষমতাসম্পন্ন করে তোলা হয়। 

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান এবং পশ্চিমা শক্তির মধ্যকার সংঘটিত পারমাণবিক চুক্তি অনেকটা অর্থহীন হয়ে উঠতে থাকে। ডলারের বিপরীতে ইরানি মুদ্রা রিয়ালের মূল্যমান আশঙ্কাজনক জায়গায় পৌঁছেছিল। ওই সময় দেশটি তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করছিল। দেশটির ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণদের বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছিল। এর মধ্যে ৪১ শতাংশই ছিল বিশ^বিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। ৩০ মিলিয়ন জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিল। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে চরম সংকটে ফেলেছিল। এরকম একটি সংকটজনক পরিস্থিতিতে পুলিশি হেফাজতে মাসা আমিনির মৃত্যু আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। 

বিক্ষোভ কেন ফল আনতে পারল না

ইরানে জনগণের এই বিক্ষোভ কেবল নারীদের পোশাকের স্বাধীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অসংখ্য তরুণ এই আন্দোলনে সামিল হলেও তারা অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে পারেনি। বিক্ষোভকারী এবং পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম এই আন্দোলনকে ‘নারীদের বিপ্লব’ তকমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। সুতরাং ইরানি নারী ও তরুণদের এই বিক্ষোভ সমাজের অন্য অংশগুলোকে এর মধ্যে টেনে আনতে পারেনি। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত সমাজের প্রান্তিক মানুষের মৌলিক দাবিগুলো বিক্ষোভে অনুপস্থিত থাকায় এর তেজটা ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারিনি। 

বিক্ষোভের পর কতটা বদলেছে ইরান

শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বল প্রয়োগের ফলে ক্ষমতাসীন অভিজাতরা ক্ষমতায় নিজেদের অবস্থান আরও পোক্ত করতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে। পুলিশি হেফাজতে মাসা আমিনির মৃত্যুর পর রাস্তা থেকে নীতি পুলিশ অনেকটাই উধাও হয়ে যায়; কিন্তু বিক্ষোভ স্তিমিত হতেই তারা আবার সক্রিয় হতে শুরু করে। চুল না ঢেকে চলাফেরা করা নারীদের চিহ্নিত করতে ও শাস্তি প্রদানে বসানো হয় নজরদারি ক্যামেরা। এমনকি হিজাব না পরা নারীদের শনাক্ত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারেরও চিন্তা করছে দেশটির সরকার। তারা এমন একটি আইন করার কথা ভাবছে, যাতে ইরানে যে নারী হিজাব পরতে অস্বীকৃতি জানাবেন, তার সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদ- দেওয়ার বিধান রাখা হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠোর শাস্তির আওতায় পড়তে পারে আইন ভঙ্গকারী তারকা ও ব্যবসায়ীরা। 

‘ইরান বিক্ষোভ’-এর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর নানাভাবে দমন-পীড়ন চালিয়েও বিরোধী কণ্ঠস্বরকে একদম স্তব্ধ করতে পারেনি দেশটির সরকার। মাসা আমিনির মৃত্যুর বর্ষপূর্তিতে কঠোর সতর্কতা নিলেও দেশটির বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদের খবর মিলেছে। বিশে^র নানা প্রান্তেও বিক্ষোভ হয়েছে। তাই চরম বল প্রয়োগ করার পরও মাসা আমিনি এবং তার জন্য জীবনদানকারী আন্দোলনকারীদের স্মৃতিসত্তা ও চেতনাকে ইরানের সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারা যায়নি। তাদের প্রেতাত্মারা এখনো বিক্ষোভের আতঙ্কে আতঙ্কিত করছে ধর্মীয় শাসকদের। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //