আল জাজিরা: হামাসের ইতিহাস ও লড়াইয়ের কারণ

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন গ্রুপ হামাসের মধ্যে চলমান উত্তেজনায় ১ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর আগে শনিবার ভোরে হামাসের ছোঁড়া রকেটের ফলে ইসরায়েল ও গাজা সীমান্তের সবচেয়ে গুরুরত্বপূর্ণ সীমানা বেড়া ভেঙে গিয়েছে। আর এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু ‘দীর্ঘ ও কঠিন যুদ্ধ আসন্ন’ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণও করেছেন। এরইমধ্যে ইসরায়েল জঙ্গি বিমানগুলো গাজা উপতক্যায় সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনাসহ নাগরিকদের ওপর হামলাও শুরু করেছে।  

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কারা এই হামাস গোষ্ঠী? আসুন জেনে নেয়া যাক তাদের বিষয়ে কিছু তথ্য: 

কারা এই হামাস ও তাদের দাবি কী? 

ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড রক্ষায় ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য গড়ে ওঠা সবচেয়ে বড় দল হচ্ছে হামাস। আরবিতে যাকে বলা হয় ‘ জিল’। 

এ গ্রুপটি রাজনৈতিকভাবেই ফিলিস্তিনের ২০ লাখ লোকের বসবাসের গাজা উপতক্যার ৩৬৫ কিমি (১৪১ বর্গ মাইল) নিয়ন্ত্রণ করে আসছে যা কীনা   ইসরায়েলের দখলে রয়েছে। 

২০০৭ সাল থেকে হামাস দেশটির প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের প্রতি আনুগত্যে থাকা ফাত্তাহ ফোর্সেসের বিরুদ্ধে এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে জয়লাভের পর তারা এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে নিয়ে নেয়। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন) প্রধান হিসেবেও দায়িত্বে রয়েছেন। 

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করতে ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরুর পর ১৯৮৭ সালে কট্টর ইসরায়েলবিরোধী আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমাদ ইয়াসিন ও আবদেল আজিজ আল-রান্তিসির হাতে হামাস গঠিত হয়। পরে ২০০৪ সালের মার্চে গাজায় ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আহমাদ ইয়াসিন ও এপ্রিলে নিহত হন আজিজ আল-রান্তিসি।

ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে হামাস মিশরে তাদের সামরিক শাখার কার্যক্রম চালু করে। পাশপাশি নানা সামাজিক কাজের সঙ্গেও তাদের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে তোলে এই হামাস। 

হামাস ইসরায়েলের এই দখল মেনে নেয়নি বলে ফিলিস্তিনকে আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে। 

এ প্রসঙ্গে ২০১৭ সালে নির্বাসিত প্যালেস্টাইন নেতা খালেদ মিশাল বলেন, আমরা আমাদের ভূমির এক ইঞ্চিও ছাড়ব না। তার জন্য যত চাপ আসুক না কেন কিংবা যতদিন লাগুক এই সংঘাত চালিয়ে যেতে হলে তাই করব। 

১৯৯০ সালের মধ্যসময়ে ইসরায়েল ও পিএলও’র মধ্যে আলোচিত ওসলো শান্তি চুক্তিরও বিরোধিতা করে হামাস। 

হামাস প্রাথমিকভাবে দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। প্রথমত, এর সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাশেম ব্রিগেডসের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত রাখা ও দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি পরিচালনার মধ্যদিয়ে ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনিদের কল্যাণে কাজ করা।

সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী, তারা ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে তাদের চাওয়া হলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একটি একক ইসলামিক রাষ্ট্র।

যাদের সমর্থনে চলছে হামাস 

হামাসের আঞ্চলিক সমর্থকদের মধ্যে ইরান, সিরিয়া ও লেবাননের হিজবুল্লাহর নাম রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইসরায়েল সংক্রান্ত মার্কিন প্রশাসনের নীতির বিরোধিতা করে হামাস ও তার মিত্ররা। 

হামাস ও ইসলামিক জিহাদ হলো মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম সশস্ত্র গোষ্ঠী। যাদের উভয়ের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব  বিরাজ করায় একযোগে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এই সংগঠন দুটি। 

শনিবারের হামলা কী বার্তা দিচ্ছে ? 

হামাসের মুখপাত্র খালেদ কাদোমি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দশকের পর দশক ধরে চরম নৃশংসতার শিকার হয়ে আসছেন ফিলিস্তিনিরা। আর এই প্রতিক্রিয়া থেকেই এমন হামলার পরিচালনা। 

খালেদ কাদোমি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চলমান নৃশংসতা বন্ধের পাশপাশি পবিত্র স্থান আল-আকসায় সংঘাত বন্ধ করবে,  এটাই আমাদের চাওয়া। এসবই এবারের হামলার নেপথ্যের মূল কারণ।’

গত শনিবারের হামলাকে ‘কেবল সূচনা’ বলে উল্লেখ করেছে হামাস। সেই সঙ্গে এ লড়াইয়ে অন্য সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলোকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

হামাসের লক্ষ্যবস্তু বেসামরিক মানুষ? 

হামাসের জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র ওসামা হামদান বলেন, হামাস কখনও বেসামরিক মানুষের ওপর আক্রমণ করা হয়নি।

অবশ্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, হামাসের সদস্যরা ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করেছেন।

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে ওসামা হামদান বলেন, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে যেসকল ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেবল তারাই হামলার শিকার হয়েছেন। আমরা জানি, বসতি স্থাপনকারী ও বেসামরিক লোকজনের মধ্যে পার্থক্যটা কী? যেসব বসতি স্থাপনকারী ব্যক্তিরা ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ করে আসছেন তারা বেসামরিক নাগরিক নন।

হামলা হয়েছিল কীভাবে? 

হামাস বলেছে যে তাদের যোদ্ধারা ছিটমহল থেকে বেশ কয়েকজন ইসরায়েলিকে বন্দীর পাশপাশি রক্তাক্ত সৈন্যদের টেনে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেছে। এতে দেখানো হয়, বন্দিদের মধ্যে ইসরাইলি সামরিক কর্মকর্তারাও রয়েছেন।

যদিও এসব ভিডিও যাচাই করা যায়নি তবে বর্ণনাকৃত অঞ্চলের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে মিল পাওয়া গেছে৷ এদিকে ইসরায়েলের হাতে হামাসের ১ হাজারেরও  বেশি ফিলিস্তিনি বন্দীর বিনিময় না হওয়া পর্যন্ত হামাস ইসরায়েলের সেনাসদস্য শালিতকে ছাড়বে না বলেও জানিয়েছে। গিলাদ শালিত ২০০৬ সালে হামাসের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। 

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, হামাস ইসরায়েলে উড়ন্ত প্যারাগ্লাইডারও পাঠিয়েছে। এ আক্রমণটি ১৯৮০ দশকের শেষ দিকের একটি বিখ্যাত হামলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা লেবানন থেকে উত্তর ইসরায়েলে প্রবেশ করে হ্যাং-গ্লাইডারের মাধ্যমে ছয় ইসরায়েলি সেনা হত্যা করেছিল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //