ফের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট; ঔদ্ধত্য থেকে অপমানে

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘে বেশ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে দেওয়া বক্তৃতায় ইসরায়েল এবং নতুন আরব অংশীদারদের নিয়ে নতুন মধ্যপ্রাচ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইসরায়েলের কল্পনাপ্রসূত আঞ্চলিক মানচিত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল ফিলিস্তিনকে। যা ইসরায়েলের জন্য রাজনৈতিক এবং কৌশলগতভাবে একটি মারাত্মক ভুল ছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

হামাস মূলত গাজা থেকে ইসরায়েলকে আকাশ, সমুদ্র ও স্থলপথে প্রতিরোধ করতে একটি সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত সামরিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এত দিন ধরে কাজ করে আসছিল। ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর দিকে হাজার হাজার রকেট ছোড়ার পাশাপাশি শত শত ফিলিস্তিনি যোদ্ধা দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি সামরিক ও বেসামরিক এলাকায় হামলা চালিয়েছে, যার ফলে অন্তত ৯০০ ইসরায়েলি নিহত, ২৬০০ জন আহত হয়েছে এবং বেশ কিছু সংখ্যক ইসরায়েলি সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিককে আটক করেছে। 

এবারের অভিযানে হামাসের উদ্দেশ্য কোনো গোপন বিষয় নয়। তাদের লক্ষ্য হলো প্রথমত ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, নিপীড়ন, অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধ করা এবং পবিত্র স্থানগুলো রক্ষা করা; দ্বিতীয়ত ইসরায়েলের সঙ্গে আরবদের স্বাভাবিকীকরণের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সবশেষে, বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে ইসরায়েলি কারাগার থেকে যতটা সম্ভব ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করে আনা। এটি স্মরণযোগ্য যে গাজা উপত্যকায় হামাসের নেতা ইয়াহিয়া আল-সিনওয়ার, যিনি ইসরায়েলি কারাগারে দুই দশকেরও বেশি সময় কাটিয়েছিলেন, বন্দি বিনিময়ে মুক্তিলাভ করেছিলেন। হামাসের সামরিক বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ দেইফ, যিনি কিনা অন্য ফিলিস্তিনিদের মতো ইসরায়েলি সহিংসতায় তার প্রিয়জনদের হারিয়েছেন। অতএব এই অভিযানের দৃষ্টিভঙ্গির আড়ালে শাস্তি দেওয়া ও প্রতিহিংসামূলক মনোভাবও রয়েছে হামাসের। 

ইসরায়েলি সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বও হামাসের ব্যাপক অভিযানে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে হামাসের এই সাফল্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা এবং সামরিক ব্যর্থতার দিকেই ইঙ্গিত করে। ইসরায়েলের গুপ্তচর, ড্রোন ও নজরদারি প্রযুক্তির অত্যাধুনিক নেটওয়ার্ক সিস্টেম থাকা সত্ত্বেও এমন আক্রমণ শনাক্তে ব্যর্থতারই আভাস। কিন্তু ইসরায়েলের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীর কৌশল ব্যর্থ করার চেয়েও রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবেও দেশটিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অপরাজেয় রাষ্ট্রটি বেশ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলেই আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। যা একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নেতা হওয়ার যোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে বলেও বিশেষজ্ঞদের মত। 

হামলায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ইসরায়েলিরা তাদের বাড়িঘর এবং শহর ছেড়ে কীভাবে পালিয়ে যাচ্ছে- এসব ছবি হয়তো স্মৃতিতে বহু বছর ধরেই গেঁথে থাকবে। সম্ভবত ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ দিনটি ছিল এ হামলার ক্ষণটি। নেতানিয়াহু যাকে স্পিন ডাক্তার বলা হয়ে থাকে তিনিও এ হামলার বিষয়টিকে যেভাবেই ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন না কেন তা হয়তো খুব বেশি আলোর মুখ দেখবে না। ইসরায়েলে ৭ অক্টোবর সকালে বিশ্ববাসী যা দেখেছে তা পূর্বাবস্থায় ফেরানোর সুযোগ পাবেন না তিনি। 

ইসরায়েল ইতোমধ্যেই হামাসের এ হামলার জবাব দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। গাজায় একের পর এক বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজার সরকারি কর্মকর্তাদের বরাতে বিবিসি বলছে, গাজায় এ পর্যন্ত ৬৫০ জনের বেশি নিহত এবং আহত হয়েছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ গাজার সাতটি এলাকার বাসিন্দাদের ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলেছে। হামাস ও ফিলিস্তিনি অন্য উপদলগুলোকে ধ্বংস করতে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি শহর এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে সামরিক বাহিনী পুনরায় মোতায়েন করার বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে পারে। আর এই ধরনের পূর্ণ অধিগ্রহণ মূলত ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন জোটের ধর্মান্ধ সদস্যদের ঐতিহাসিক ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। যারা একসময় ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করে ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন বা যাকে তারা ‘ইসরায়েলের বৃহত্তর ভূমি’ বলে অভিহিত করে থাকে; অনেকটা সেটির পূর্ণ বাস্তবায়নের দিকেই তাদের নব যাত্রা হতে পারে বর্তমান এই সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে। 

তবে এটা একটা বড় ভুল হবে বলে মনে করছেন কূটনীতিক বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধারণা এমন হলে তা একটি পূর্ণাঙ্গ অপ্রতিসম যুদ্ধের দিকে ধাবিতের সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রক্রিয়া ইসরায়েলকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। এমনকি পশ্চিমা নেতারাও যারা এতদিন ধরে নেতানিয়াহুকে সমর্থন করে আসছিলেন ও ইসরায়েলি বর্ণবাদের সঙ্গে একই রকম ভ-ামিপূর্ণ সংহতি প্রকাশ করার মনোভাব ব্যক্ত করে থাকতেন তারা ইসরায়েলি সরকার থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিতে পারেন।

ইসরায়েলের কলঙ্কজনক অপমান এই অঞ্চলে তার কৌশলগত ও রাজনৈতিক অবস্থানকে ক্ষুণœ করছে। যে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে এবং নেতানিয়াহু সরকারের সঙ্গে অংশীদারত্বের নানা বিষয়ে সহমতে পৌঁছেছিলেন তারাও অনেকটা বোকা বনে গেছেন। নেতানিয়াহুর তার ব্যর্থতা ঢাকতে ও জোট যেন ভেঙে না যায় সেদিকে দৃষ্টিপাত করে যেভাবেই হোক না কেন তিনি যে তীব্র প্রতিক্রিয়াময় পথেই হাঁটবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এমনটা হলে নেতানিয়াহু তার প্রতিপক্ষ ফিলিস্তিনের মাহমুদ আব্বাসের মতোই ইতিহাসের তলায় তলিয়ে যেতে পারেন। 

আব্বাসও রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের নিন্দা এবং নিরাপত্তা সমন্বয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধতার চেষ্টা করে আসলেও ভারসাম্যমূলক অবস্থায় তিনি পৌঁছাতে পারেননি। কিন্তু যে পরিবর্তন সামনে আসছে তা ব্যক্তিত্বের অবস্থানকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। এটি সামগ্রিকভাবে দুজনের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর এখানেই স্পষ্ট হবে যে, তারা শান্তিতে বাঁচতে চান নাকি লড়াইকেই বেছে নেবেন মৃত্যুর মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে। এরই মধ্যে সময় ও স্থানের নানা দৃশ্যপটের পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে অনেকটাই। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা আজ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা অপমানে হাঁটু গেড়ে বসে থাকার চেয়ে ন্যায় ও স্বাধীনতার জন্য নিজ পায়ে ভর দিয়ে লড়াই করেই বেঁচে থাকাই শ্রেষ্ঠ পথ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //