হামাসের টানেল ফাঁদ কতটা বিস্তৃত

গাজা শহরের মাটির নীচে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের তৈরি করা গোপন টানেল নেটওয়ার্কের একাংশে আক্রমণের কথা জানিয়েছে ইসরায়েল।

ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) একজন মুখপাত্র গতকাল বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, গাজা উপত্যকার একটি স্তর বেসামরিক নাগরিকদের এবং আরেকটি স্তর আছে হামাসের জন্য। আমরা হামাসের তৈরি করা সেই দ্বিতীয় স্তরটিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।

তাদের দাবি, এসব বাংকার গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জন্য নয়। এটা শুধু হামাস আর অন্য সন্ত্রাসীদের জন্য, যাতে করে তারা ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে রকেট হামলা বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম কিংবা এ ধরণের অপারেশনের পরিকল্পনার জন্য ব্যবহার করতে পারে।

এই টানেল নেটওয়ার্কের আকার সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন, যাকে ইসরায়েল বলছে ‘গাজা মেট্রো’, কারণ মনে করা হয় এটা এমন একটা এলাকার নীচে বিস্তৃত, যা লম্বায় প্রায় ৪১ কিলোমিটার আর প্রস্থে ১০ কিলোমিটার।

২০২১ সালের সংঘাতের পর আইডিএফ বিমান হামলা করে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি টানেল ধ্বংসের দাবি করেছিল। হামাস তখন বলেছিল যে তাদের টানেল ৫০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং এর মাত্র পাঁচ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে।

টানেল সংক্রান্ত এসব তথ্য বোঝার জন্য যেটা উল্লেখ করা যায়, তা হলো পুরো লন্ডন শহরের আন্ডারগ্রাউন্ডের দৈর্ঘ্য ৪০০ কিলোমিটারের মতো।

চোরাচালানের পথ থেকে যুদ্ধকৌশলের হাতিয়ার

গাজায় টানেল নির্মাণ শুরু হয় ২০০৫ সালে ইসরায়েল সৈন্য ও বসতি স্থাপনকারীদের প্রত্যাহারের আগে থেকেই। তবে এর গতি বাড়ে দু বছর পর হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর। ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণে ইসরায়েল ও মিশর পণ্য পরিবহন ও মানুষের আসা-যাওয়ার ওপরে কড়াকড়ি আরোপ শুরু করে।

এক পর্যায়ে মিশর সীমান্তে প্রায় আড়াই হাজার টানেল হামাস ও অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠী ব্যবহার করেছে বাণিজ্যিক পণ্য, তেল ও অস্ত্র চোরাচালানের জন্য।

২০১০ সালের পর গাজায় চোরাচালানের গুরুত্ব কমে যায় কারণ ইসরায়েল তাদের ক্রসিং ব্যবহার করে বেশি পণ্য আমদানির সুযোগ দেয়া শুরু করে। পরে মিশর কিছু টানেল ধ্বংস করে বা বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেয়।

হামাস ও অন্য গ্রুপগুলোও তখন ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর হামলার জন্য নতুন করে টানেল খনন শুরু করে।

২০০৬ সালে ইসরায়েল সীমান্তে এমন টানেল ব্যবহার করে দুজন ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করে এবং আরেকজনকে তুলে নেয়া হয়, যাকে পরে পাঁচ বছর জিম্মি রাখা হয়েছিলো।

২০১৩ সালে আইডিএফ ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার লম্বা ও ১৮ মিটার গভীর টানেল আবিষ্কার করে, যার ছাদ ও দেয়াল ছিলো কংক্রিটের তৈরি। এটি গাজা উপত্যকা থেকে শুরু করে ইসরায়েলের কিবুতয এলাকার কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। স্থানীয় অধিবাসীরা বিচিত্র শব্দ শোনার পর ইসরায়েলিরা এটিকে চিহ্নিত করে।

পরের বছর নিজেদের প্রতি হুমকি দূর করতে এ ধরণের টানেলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়োজন বোধ করে ইসরায়েল।

আইডিএফ পরে ৩০ কিলোমিটারের বেশি টানেল ধ্বংস করে দেয়ার দাবি করে। কিন্তু তারপরেও একটি সশস্ত্র গ্রুপ এমন একটি টানেল থেকে হামলা চালিয়ে চার জন্য ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করে।

ভূপৃষ্ঠ থেকে অন্তত একশ ফুট গভীরে

ইসরায়েলের রিচম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ারফেয়ার বিশেষজ্ঞ ড. ডাফনে রিচমন্ড বারাক বলেন, আন্ত:সীমান্ত টানেলগুলো অনেকটা দুর্গের মতো। মূলত ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালাতে একবার ব্যবহারের জন্য এগুলো খোঁড়া হয়। 

তিনি বলেন, নেতারা সেখানে লুকিয়ে থাকে। তাদের কমান্ড-কন্ট্রোল সেন্টার আছে। তারা এগুলো ব্যবহার করে ট্রান্সপোর্ট ও যোগাযোগের জন্য। এগুলোতে রেল ট্রাক, আলো ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকে।

তার মতে হামাস সিরিয়ার আলেপ্পোতে বিদ্রোহী যোদ্ধা ও মসুলে ইসলামিক স্টেট জিহাদিদের কৌশল পর্যবেক্ষণ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টানেল নির্মাণ ও যুদ্ধ কৌশলে আরও দক্ষতা অর্জন করেছে।

ধারণা করা হয় যে, গাজায় যে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে অন্তত একশ ফুট গভীরে এবং এর প্রবেশপথগুলো সাধারণ ঘরবাড়ি, মসজিদ, স্কুল কিংবা এমন ভবনে যেখানে সাধারণ মানুষের সমাগম হয়। মূলত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের যেন চিহ্নিত করা না যায় সেজন্য এগুলো ব্যবহার করে তারা।

স্থানীয় মানুষজনকেও এমন নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য মূল্য দিতে হয়। আইডিএফের অভিযোগ গাজার মানুষের জন্য ত্রাণ হিসেবে দেয়া মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার টানেল তৈরি ও আগের যুদ্ধগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলে যে হামলা হয়েছে তাতেও টানেল ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। ওই হামলায় এক হাজার তিনশ মানুষ মারা গেছে, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। জিম্মি করা হয়েছে আরও অন্তত দেড়শ।

কাফার আজা’র কাছে একটি টানেলের বের হওয়ার পথের সন্ধান পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ওই এলাকাতেই অনেকে বেসামরিক মানুষ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে।

এটি সত্যি হলে ওই টানেলটি নির্মাণ করা হয়েছে এন্টি টানেল সেন্সরসহ নির্মিত ভূগর্ভস্থ দেয়ালেরও নীচ দিয়ে। ২০২১ সালে এ ধরণের দেয়াল তৈরির কাজ শেষ করেছিল ইসরায়েল।

রিচমন্ড বারাক বলছেন, টানেল চিহ্নিত করার কোন পদ্ধতিই পুরোপুরি প্রমাণিত নয়। এজন্যই যুদ্ধে সবসময় টানেল ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই, কারণ এটা ঠেকানোর উপায় নেই।

তিনি বলেন, ইসরায়েল গাজায় হামাসের পুরো টানেল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করতে পারবে এটা বিশ্বাস করাটা হবে অবাস্তব বিষয়। নেটওয়ার্কটির কোন কোন অংশ থেকে নানা কারণে অনেককে সরানো যাবে না। আবার কিছু অংশ থাকবে অজানা। আবার কিছু অংশের জন্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক বেশি।

টানেল ধ্বংস হলে ব্যাপক প্রাণহানির শঙ্কা

টানেল ধ্বংস করতে গিয়ে ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনাও আছে- যার মধ্যে ইসরায়েলি সেনা, ফিলিস্তিনের বেসামরিক নাগরিক ও জিম্মিরাও থাকতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।

রিচমন্ড বারাক বলেন, হামাস মানব ঢাল ব্যবহারে খুবই দক্ষ। আক্রমণ অনিবার্য হলে তারা এটি করতে জানে। নিরীহ বেসামরিক মানুষজনকে তারা ভবনের ওপরে রাখে। এগুলো অনেকবারই ইসরায়েলকে আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছে।

তার মতে, কৌশলটিতে ব্যাপক দক্ষতা অর্জন করা হামাস এটিকে টানেলের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারে এবং যেসব আমেরিকান ও ইসরায়েলিদের জিম্মি করা হয়েছে তাদেরও সেখানে রেখে দিতে পারে।

আইডিএফ বলেছিলো যে ভূগর্ভস্থ টানেলগুলো ছিলো তাদের লক্ষ্য। কিন্তু যখন এসব টানেল ধ্বংস হয় তখন যেসব ভবনের নীচের এই টানেল সেগুলোর ফাউন্ডেশনও ধ্বংস হয়ে যায়।

বারাক বলেছেন, শহরাঞ্চলে যুদ্ধের কঠিন বাস্তবতা ও ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্য করে প্রাণঘাতী হুমকি ছাড়াও টানেল নেটওয়ার্কের কাছে অনেক সময় অকার্যকর হয়ে পড়ছে আইডিএফের প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা কার্যক্রমও।

প্রথমত পুরো নেটওয়ার্ককে ফাঁদে পরিণত করার মতো অনেক সময় হামাসের আছে। তারা এমনকি সৈন্যদের টানেলে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে তারপরও পুরোটাই উড়িয়েও দিতে পার।

তার মতে, এমনকি টানেলের ভেতরে না গিয়েও একটি এলাকা চিহ্নিত করলেন যেখানে মনে করা হচ্ছে যে টানেল থাকতে পারে। সেখানেও আপনাকে এমন কিছু পেতে হবে যা মূলত অদৃশ্য।

ইসরায়েলি সেনাদের অবশ্য এসব ঝুঁকি মোকাবেলারও কিছু পদ্ধতি থাকবে। সৌফান গ্রুপ সিকিউরিটি কনসালটেন্সির গবেষণা পরিচালক কলিন ক্লার্ক এর মতে এ ক্ষেত্রে ড্রোন কিংবা মানববিহীন কিছু পাঠিয়ে টানেলের ম্যাপ কিংবা ফাঁদ সম্পর্কে ধারণা নেয়া সম্ভব হতে পারে।

যুদ্ধবিমান থেকে বাংকার বিধ্বংসী বোমা ফেলা হতে পারে, যেগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই মাটির অনেক গভীরে যেতে সক্ষম। তবে শহরে ঘনবসতির কথা চিন্তা করলে এগুলোতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা থাকে।

সূত্র- বিবিসি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //