ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের দুর্বল অবস্থান কেন

বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলো বরাবর ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন এবং ‘নিপীড়িত’ ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের সংহতি জানিয়ে আসলেও বড় সংকটের মুহুর্তে পুরো মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা জোরালো অবস্থান নিতে দেখা যায় না।

এমনকি মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি কিংবা আরব লীগও ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের সংকটকালে খুব জোরালো কোন ভূমিকা নিতে পারে না। এবার গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস কর্তৃক ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলার পাল্টা জবাবে নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। ফলস্বরূপ বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে।

আর যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের সর্বাত্মক সমর্থনে এগিয়ে এসেছে।

বিপরীতে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে ইরান ছাড়া আর কোন দেশকেই ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না। 

এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলিম বিশ্বের জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে একাট্টা হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে সরকারগুলোর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়া অনেকটাই অসম্ভব।

এদিকে সৌদি আরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া বা শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতার জায়গাটি হলো পশ্চিমাদের অবস্থান।

তিনি বলেন, “ইসরায়েল একা প্রতিপক্ষ হলে এতদিনে পরিস্থিতি অন্যরকম দেখা যেত। তবে ইসরায়েলেও অনেকে শান্তি চায়। সে কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সাথে এখন তাদের যোগাযোগ হচ্ছে। এমন নানা কারণে মুসলিম বিশ্বের এমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।” 

মুসলিম দেশগুলো কী বলেছে?

ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাস এমন এক সময় হামলা পরিচালনা করছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরনের কাজ করছিলো সৌদি আরব ও ইসরায়েল। গত সেপ্টেম্বরে এ নিয়ে রিয়াদে কথাও বলে গেছেন মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।

এর আগে আমেরিকার মাধ্যমেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছে আরব বিশ্বের আরেক প্রভাবশালী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত।

এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বেই সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি সমঝোতা বা চুক্তি স্বাক্ষরের সফলতার মুখও দেখতে চাইছে বাইডেন প্রশাসন।

তবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরুর পর সম্পর্ক স্বাভাবিকের প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে সৌদি আরব।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, তার দেশ "ফিলিস্তিনি জনগণের একটি স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার রক্ষা, তাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা এবং ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি অর্জনের জন্য সবসময় তাদের পাশে থাকবে।," 

সরকারি সৌদি প্রেস এজেন্সি এই তথ্য জানিয়েছে।

অন্যদিকে আরেক প্রভাবশালী আরব দেশ কাতার বরাবরই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিরুদ্ধাচারণ করে আসছে। দেশটি তাদের দেয়া বিবৃতি মারফত এমন উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য ইসরায়েলকেই দায়ী করেছে। দেশটি ফিলিস্তিনের জন্য পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের আগের ভূখণ্ডকে সমর্থন করে থাকে।

আর সংযুক্ত আরব আমিরাত হামাসের হামলার সমালোচনা করার পাশাপাশি তাদের এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি নাগরিকদের জিম্মির বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে। 

অথচ ইসরায়েলের প্রাণঘাতী হামলার বিষয়টি নিয়ে তারা কথা বলেনি। 

এদিকে বাহরাইনও হামাসের হামলার সমালোচনা করেছে। আর কুয়েত ও ওমানের প্রতিক্রিয়া ছিলো বেশ কৌশলী।

অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে ১৯৮০ সালেই চুক্তি করা মিসর উভয় পক্ষকে সংযত হওয়ার আহবান জানিয়ে আসছে। মরক্কো অবশ্য গাজায় সামরিক হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সিরিয়া অবশ্য হামাসের এই হামলাকে এক বড় অর্জন বলে অভিহিত করেছে। হুতি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনও হামাসকে সমর্থন দিয়েছে।

আর আরব বিশ্বের বাইরে অনেকটা একই সুরে কথা বলেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো।

স্বাধীনতার পর থেকেই এ পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি বিরোধে বাংলাদেশের অবস্থান খুব স্পষ্ট। ফিলিস্তিনিদের স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ অবস্থান শুরু থেকেই।

এর কারণ যতটা না আন্তর্জাতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি বাংলাদেশের জনমত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।

গণতন্ত্রহীন দেশগুলোয় জনমতের প্রতিফলন নেই

এসব দেশগুলোর গণতন্ত্র এবং প্রতিনিধিত্বশীল সরকার মুসলিম বিশ্বে খুবই কম এবং এ ধরনের দেশগুলোর সরকারকে ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখতে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় বলে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যাওয়ার খুব সুযোগ তাদের নেই।

আবার ফিলিস্তিনে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন পিএলও, গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাসের পাশাপাশি আরেক সংগঠন হেজবুল্লাহকেও বিভিন্ন প্রভাবশালী মুসলিম দেশ সমর্থন দিয়ে থাকে বলে প্রচার রয়েছে।

যেমন হামাস ইরান-সমর্থিত বলে বর্ণনা করে থাকছে পশ্চিমারা।

অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো প্রভাবশালী আরব দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক জোরদার করে আসছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে দুর্বল করে ফেলছে বলেও মনে করেন অনেকে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের মত অনেকটা এরকম- ‘’ মুসলিম বিশ্বে প্রভাবশালী আরব দেশগুলোর কেউ কেউ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে আবার কেউ কেউ স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। নিজেদের ক্ষমতাকে তারা চিরস্থায়ী ধরে রাখতে চায়। সংগত কারণেই তারা হয়তো মনে করে পপুলার সেন্টিমেন্ট যাই হোক ইসরায়েলকে ঘাঁটানো তাদের জন্য ঠিক হবে না। এ কারণেই তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত দেখা যায় না,” 

জার্মানি ভিত্তিক বিশ্লেষক ডঃ মারুফ মল্লিক বলছেন, ” মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী আরব বিশ্বে গণতন্ত্র বা নির্বাচনেরযেমন  বালাই নেই, অনুরূপ ইসরায়েলের সাথে সমঝোতা বা ভারসাম্য রক্ষা তাদের জন্য জরুরি।” 

মসনদ হারানোর ভয়

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসক পরিবারগুলোকে ক্ষমতার প্রশ্নে কখনও আপোষ করতে দেখা যায়নি। আবার এসব দেশে গণতন্ত্র বা জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থাও কাজ করে না।

তারপরেও অনেকেই মনে করেন লিবিয়া ও সিরিয়ার ঘটনার পর আরব দেশগুলোর রাজপরিবারগুলো নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বেশি উদ্বিগ্ন।

সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, “বেশিরভাগ দেশেই দুটি প্রবণতা—জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে বেশি কিন্তু সরকারগুলোর কথায় জোর কম। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার জটিলতার কারণেই তারা শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারে না।” 

তবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচনের সুযোগ কিন্তু ইরানের রয়েছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বলয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল শক্ত অবস্থান নিয়ে আসছে।

অন্যদিকে তুরস্ক বলারের সময় শক্ত ভাষা ব্যবহার করলেও ন্যাটোর সদস্যপদসহ বেশ কিছু বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে কৌশলী ভূমিকার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।

পশ্চিমাদের ক্ষেপিয়ে তোলার ভয়

বিশ্লেষক ডঃ মারুফ মল্লিক বলছেন মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্র নেই এবং সে কারণে এসব দেশের সরকারকে সমঝোতা করে চলতে হয়।

তিনি বলেন, “পশ্চিমাদের ক্ষেপিয়ে কেউ নিজের ক্ষমতাকে দুর্বল করতে চায় না। মিসর, তিউনিসিয়ার মতো দেশও এর বাইরে নয়। সবাই জানে সোচ্চার হলেই চাপ শুরু হবে। বরং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ইসরায়েলের সাথে তাদের সমঝোতা জরুরি।” 

আর ঠিক একই কারণে ওআইসি বা আরব লীগও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা হয়ত পালন করে বলেও মনে করেন তিনি। তার মতে রাজতন্ত্রের বাইরে থাকা  বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মত দেশগুলোর সোচ্চার হওয়ার মতো প্রভাবই নেই।

যদিও অনেকে মনে করেন ইসরায়েলকে ঘিরে আরব দেশগুলোতে চিন্তার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে।

সবমিলিয়ে এসব কিছুই মূলত ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম বিশ্ব এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে শক্ত অবস্থান নিতে বেশ দুর্বল বলেই মনে করে থাকেন বিশ্লেষকরা।

সূত্র: বিবিসি বাংলা 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //