গাজায় স্থল অভিযান
হামাসকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল। এই লক্ষ্যে দেশটি এবার গাজায় স্থল অভিযান শুরু করেছে। ইসরায়েল বলেছে, গাজা কখনোই আর আগের মত থাকবে না।
ইসরায়েল এ অভিযানের নাম দিয়েছে ‘দ্য সোর্ডস অব আয়রন’। গাজায় এতটা ব্যাপক অভিযান পরিচালনার কথা গত শনিবারের আগে খোদ ইসরায়েলও হয়তো কল্পনা করেনি।
গত শনিবার ভোরে গাজা থেকে হামাসের নজিরবিহীন হামলায় ইসরায়েলে ১৩শ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। যার জবাব দিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু হুঙ্কার, হামাসের প্রত্যেক সদস্যকে মৃত মানুষ চাই।
আসলেই কী ‘অপারেশন সোর্ডস অব আয়রন’ এর লক্ষ্য পূরণ বাস্তবে সম্ভব? সামরিক কমান্ডাররা কীভাবে এটিকে সফল করে তুলবেন?
বেসামরিকদের প্রাণনাশের ঝুঁকি
গাজায় স্থল অভিযানে হামাস যোদ্ধাদের খোঁজে ইসরায়েলের সেনাদের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালাতে হবে। এতে সেখানকার বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণনাশের ঝুঁকি অনেক বেশি।
এরইমধ্যে গাজায় ইসরায়েলের আকাশ হামলায় ২,২০০ বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে চার লাখের বেশি মানুষ।
তবে ইসরায়েলি সেনাদের শুধু হামাস যোদ্ধাদের খুঁজে বের করলেই হবে না। বরং তাদের হামাসের হাতে জিম্মি অন্তত দেড়শ ইসরায়েলিকেও খুঁজে বের করতে হবে। যাদের গাজা জুড়ে অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তাই হামাসকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করা এতটা সহজ হবে না।
এ বিষয়ে ইসরায়েলের আর্মি রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সামরিক বিশেষজ্ঞ আমির বার শালম বলেন, আমার মনে হয় না ইসরায়েল হামাসের সব সদস্যকে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে। কারণ, এটা চরমপন্থি ইসলামের একটি মতাদর্শ।
তিনি বলেন, এভাবে হামাসকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা বরং অনেক বেশি বাস্তব সম্মত। কারণ, ইসরায়েল এর আগে হামাসের সঙ্গে চারবার লড়াই করেছে এবং প্রত্যেকবারই তারা হামাসের রকেট হামলা বন্ধ করাতে ব্যর্থ হয়েছে।
কতক্ষণ চুপ থাকবে আন্তর্জাতিক বিশ্ব
শনিবার ইসরায়েলে হামলা চালানোর আগে দীর্ঘ পরিকল্পনা করেছে হামাস। যার বিন্দুবিসর্গ আঁচ করতে পারেনি ইসরায়েলের গোয়েন্দারা। হামাস জানতো হামলার পর প্রতিপক্ষের জবাব কতটা ভয়ঙ্কর হবে এবং নিশ্চয়ই তা প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে তাদের যোদ্ধা বাহিনী ইজ্জেদ্বীন আল-কাসাম।
ইসরায়েলি পদাতিক বাহিনীকে প্রতিহত করতে হামাস নিশ্চয়ই বিস্ফোরক প্রস্তুত করে রেখেছে। সম্মুখ যুদ্ধের পরিকল্পনাও প্রস্তুত আছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর উপর হামলা চলাতে গাজা জুড়ে বিস্তৃত ভূগর্ভস্থ টানেলগুলোও হামাসের দারুণ কাজে লাগবে।
২০১৪ সালে গাজায় অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন, স্নাইপার এবং হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল ইসরায়েলের পদাতিক বাহিনীর। গাজায় সেবারের যুদ্ধে কয়েকশ বেসামরিক নাগরিকও নিহত হন।
হামাসের হামলার দিনই নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, তার দেশ যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে এবং এই যুদ্ধ যে দীর্ঘস্থায়ী হবে সে বিষয়েও দেশটি নাগরিকদের সতর্ক করেছে। ইসরায়েল সরকার রেকর্ড তিন লাখ ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনাকে ডেকে পাঠিয়েছে।
ইসরায়েল কত দিন গাজায় অভিযান পরিচালনা করতে পারবে, কত দিন চোখ বন্ধ করে থাকবে আন্তর্জাতিক বিশ্ব? এ প্রশ্নও উঠেছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা বলেছে গাজা দ্রুত ‘জাহান্নামের গর্তে’ পরিণত হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পানি, বিদ্যুৎ ও তেল সরবরাহ বন্ধ আছে। এখন মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেই গাজা ছাড়তে বলা হচ্ছে।
কিন্তু দ্রুত হোক আর বিলম্বেই হোক যখন ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি আসবে তখনই ইসরায়েলের সহযোগী দেশগুলো এর মধ্যে হাত দিবে।
বন্দি বিনিময়ে চ্যালেঞ্জ
ইসরায়েলের শীর্ষ সাংবাদিকদের একজন ইওসি মেলম্যান বলেছেন, সরকার ও সেনাবাহিনী ভাবছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের পক্ষে আছে; অন্তত পশ্চিমা নেতারা। তাই তাদের বর্তমান দর্শন হলো, আসুন চলুন, আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে।
তিনি বলেন, কিন্তু আজ হোক বা কাল, ইসরায়েলের মিত্রদের হস্তক্ষেপ করতেই হবে। বিশেষ করে যখন তারা গাজায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ও মৃত্যুর চিত্র দেখবে।
তার উপর আছে জিম্মিদের উদ্ধারের চিন্তা। হামাস শুধু ইসরায়েলিদেরই নয় বরং যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকজন বিদেশি ও দ্বৈত নাগরিককেও জিম্মি করে নিয়ে গেছে। ওই সব জিম্মিদের মুক্ত করতে তাদের সরকারকে ব্যবস্থা নিতেই হবে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এরই মধ্যে বলেছেন, ফ্রান্স কখনো তার সন্তানদের হাত ছেড়ে দেবে না। জিম্মিদের মুক্ত করতে দেশের ভেতরেও ইসরায়েল সরকারের উপর চাপ রয়েছে।
২০১১ সালে একজন মাত্র ইসরায়েলি সেনার বিনিময়ে ইসরায়েলকে এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিতে হয়েছিল। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন ইয়াহইয়া সিনওয়ার। যিনি বর্তমানে গাজায় হামাসের রাজনৈতিক নেতা।
তাই আবারও বন্দি বিনিময় করতে হলে ইসরায়েলকে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে।
প্রতিবেশীদের পর্যবেক্ষণ
স্থল অভিযানের সময় ও ফলাফলকে আরও একটি বিষয় প্রভাবিত করতে পারে। তা হলো- ইসরায়েলের প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া।
মিশরের কাছ থেকে দাবি ক্রমশ বাড়তে পারে। গাজার সাথে দেশটির সীমান্ত আছে। তারা ইতোমধ্যেই রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য চেষ্টা করছে।
ইসরায়েলের ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের অফির উইন্টার বলছেন, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান যত বাড়বে, মিশরও তত বেশি চাপে পড়বে এটা প্রমাণের জন্য যে তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেনা।
অন্যদিকে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত লেবাননের সাথে এবং সেটিও এখন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। হেজবুল্লাহর সাথে কয়েকটি সংঘর্ষ ইতোমধ্যেই হয়েছে। তবে তারা নতুন করে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
ইরান, হেজবুল্লাহর প্রধান পৃষ্ঠপোষক, অবশ্য নতুন ফ্রন্ট খোলার হুমকি দিয়ে রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন কোন দেশ বা সংগঠন যদি চলতি পরিস্থিতির সুবিধা নেয়ার চিন্তা করে তাদের প্রতি তার একটি শব্দ- করবেন না।
সূত্র- রয়টার্স, বিবিসি
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : ইসরায়েল ফিলিস্তিন রকেট হামলা গাজা
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh