রয়টার্স বিশ্লেষণ: গাজা হাসপাতাল বিস্ফোরণের বিষয়ে আমরা কী জানি?

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এবং হামাসের সংঘর্ষের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েল সফর করার ঠিক আগে গাজার একটি হাসপাতালে বিস্ফোরণের ঘটনায় কয়েকশ ফিলিস্তিনি নিহত হন।

হাসপাতালে হামলার নেপথ্যে কে?

হাসপাতালে বোমা হামলার জন্য ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা একে অপরকে দায়ী করে আসছে। সংঘাত শুরুর পর থেকেই বাইডেন ইসরায়েলের পক্ষে তার প্রশাসনের সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। আর এবারে তিনি বলছেন, হাসপাতালের বিস্ফোরণটি দেখে মনে হচ্ছে এটি "সন্ত্রাসী গোষ্ঠী" দ্বারা নিক্ষেপ করা একটি ভুল রকেটের শিকার।

আর অন্যদিকে কিছু পশ্চিমা দেশ সরাসরি কোন মন্তব্য না করে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। আর আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।

হাসপাতাল সম্পর্কে কিছু তথ্য

অ্যাংলিকান গির্জা পরিচালিত ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত আল আহলি আরব হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে "বিশ্বের সবচেয়ে সমস্যাযুক্ত স্থানগুলোর মধ্যে একটি শান্তির আশ্রয়স্থল" হিসাবে এটিকে বর্ণনা করেছে। তারা বলছে, এখানে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত ও বিনামূল্যে রোগীদের সেবাদানসহ গ্রামের  বয়স্ক মহিলাদের জন্য একটি ভরসার কেন্দ্র ছিল এটি। এমনকি আশেপাশের শহরগুলোতে বিনামূল্যে পরিষেবা প্রদানকারী একটি মোবাইল ক্লিনিকের মতো এটির কার্যক্রম চলে আসছিল যেখানে নানা পরিষেবাসহ ৮০টি শয্যা রয়েছে।

হাসপাতালটি এটি গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে গাজা শহরের জেইতুন এলাকায় অবস্থিত।

হামলার সময় কতজন লোক ছিল?

যদিও এটিতে সীমিত সংখ্যক শয্যা ছিল তথাপি ইসরায়েলের অভিযানের পর গাজার হাসপাতাল এবং অন্যান্যস্থানগুলোয় ধারণ ক্ষমতার বাইরে হতাহত মানুষ দিয়ে ঠাসা ছিল।

মূলত নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে এই হাসপাতালে গাজাবাসীরা অবস্থান করছিলেন। এ সময় এখানে আসা আহত মানুষদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি হাসপাতালের মাঠেও আশ্রয় নিয়েছিলেন। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল ইসরায়েলের বিমান হামলা থেকে বাঁচতে এটি তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

অর্থোপেডিক সার্জারির প্রধান ডাঃ ফাদেল নাইম বলেছেন, মঙ্গলবার সকালে আল আহলি আরব হাসপাতালে প্রায় ১ হাজার লোক ছিল এবং তার পরের দিন আরও বেশি লোক সেখানে ছুটে আসে। 

তিনি জানান, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জেইতুনসহ আশপাশের বাসিন্দাদের তাদের বাড়িঘর খালি করার জন্য বার্তা পাঠালে এখানে আসা লোকের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। করেছে।

ইব্রাহিম আল-নাকা বলেন, বিম্মান হামলার সময় ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে আশ্রয় চেয়েছিল।

হামলার আগে কী হয়েছিল?

হামলার সময় গাজাসহ শরটির উত্তরের ফিলিস্তিনিদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দক্ষিণে সরে যেতে বলেছিল ইসরায়েল বাহিনী। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বিশেষভাবে জেইতুন বাসিন্দাদের মঙ্গলবার দক্ষিণে সরে যাওয়া সংক্রান্ত এক সতর্ক বার্তা পোস্ট করে।

১৬ অক্টোবর গাজার দক্ষিণে রাফাহ শহরের কুয়েতি স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা দুটি ইসরায়েলি সতর্কবার্তা পেয়েছিল, কিন্তু এটির পরিচালক নিজে জানিয়েছিলেন, তার কর্মীরা হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যাবেন না। 

হামলার বিষয়ে বিস্তারিত কতটা প্রকাশিত?

ডা: নাইম বলেন যে, তিনি একটি অস্ত্রোপচার শেষ করে আরেকটি শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এ সময় তিনি একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। আর ডক্টর নাকা জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বিস্ফোরণটি ঘটে। 

কেমন ক্ষতি হয়েছিল?

হাসপাতালের ভিতর থেকে রয়টার্সের প্রাপ্ত ফুটেজ এবং চিত্রগুলো থেকে দেখা যায়, হামলার ফলে ওখানে থাকা প্রায় ২৪ টি গাড়ি ধ্বংসবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ সময় ভবনটির দেয়ালে ও মাটিতে রক্তের দাগ লেগে ছিল।

ফিলিস্তিনিরা কী বলেছে?

ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা এ হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছেন। ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠী, যা হামাসের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে তারা জানায়, তাদের কোনো রকেট এই বিস্ফোরণের সঙ্গে  জড়িত ছিল না। কারণ সে সময় গাজা শহর বা তার আশপাশে তাদের কোনো কার্যক্রম ছিল না।

হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহ বলেছেন, ওয়াশিংটন পর্দার আড়াল থেকে ইসরায়েলকে এ হামলা চালানোর উসকানি দিয়েছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইসরায়েলকে দায়ী করে এটিকে "গণহত্যা" বলে অভিহিত করেছেন।

ইসরায়েল কি বলছে?

ইসরায়েল অবশ্য এ হামলায় তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, বিস্ফোরণটি ইসলামিক জিহাদের ব্যর্থ রকেট উৎক্ষেপণের কারণে হয়েছিল।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেন, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর অপারেশনাল সিস্টেমের বিশ্লেষণে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে গাজায় জঙ্গিদের দ্বারা রকেটের একটি ব্যারেজ নিক্ষেপ করা হয়েছিল, আর সেটি আঘাতের সময় হাসপাতালের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।

"আমাদের হাতে থাকা একাধিক সূত্র থেকে গোয়েন্দা তথ্য এমন ইঙ্গিত করে যে, গাজার হাসপাতালে আঘাত করা ব্যর্থ রকেট উৎক্ষেপণের জন্য ইসলামিক জিহাদ দায়ী।"

একজন সামরিক মুখপাত্র বলেছেন যে, হাসপাতালের আশেপাশের ভবনগুলির কোনও কাঠামোগত ক্ষতি চোখে পড়েনি এবং বিমান হামলার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনও গর্ত দেখা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে এদিকে ইসরায়েল সামরিক বাহিনী একটি অডিও ফাইল প্রকাশ করেছে যেখানে শুনা যায়, দুজন হামাস সদস্য তাদের মধ্যে কথোপকথনের সময় ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠীর ভুল  রকেট হামলার বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন। যদিও এটির সঠিক তদন্ত এখনও রয়টার্স করতে পারেনি। এ সময় অডিওটি বেশ অস্পষ্ট ছিল এবং বিপ শোনা যাচ্ছিল। 

তবে হামাস অবশ্য  তাৎক্ষণিকভাবে অডিওটির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি বলছে?

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে কথা বলার সময় বাইডেন বলছেন: "গতকাল গাজায় হাসপাতালের বিস্ফোরণে আমি গভীরভাবে শোকাহত এবং ক্ষুব্ধ হয়েছি, এবং আমি যা দেখেছি তার উপর ভিত্তি করে মনে হচ্ছে এটি অন্য দলের দ্বারা করা হয়েছে যার সঙ্গে ইসরায়েল জড়িত নয়।"

অ্যাংলিকান চার্চ কি বলছে?

ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ এবং অ্যাংলিকান চার্চের প্রধান জাস্টিন ওয়েলবি বলেছেন, "এটি নিরীহ মানুষের প্রাণহানির একটি ভয়াবহ এবং ধ্বংসাত্মক ক্ষতির সাক্ষী। আহলি হাসপাতাল অ্যাংলিকান চার্চ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই আমি আমাদের ভাই ও বোনদের সাথে শোক প্রকাশ করছি।"

তিনি বলেন, "এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য আমি আমার আবেদন রাখছি সবার কাছে। প্রভু ঈশ্বর করুণা করুন।"

এ অঞ্চলের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

এমন হামলা এই অঞ্চলের আরব সরকার ও গোষ্ঠীগুলোকে উত্তেজিত করে তুলেছে। এ সময় বেশ কয়েকটি আরব দেশের বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে।

এদিকে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ বিস্ফোরণের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছেন এবং একইসঙ্গে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং মিশরীয় ও ফিলিস্তিনি নেতাদের নিয়ে গাজা ইস্যুতে আলোচনার জন্য বুধবার আম্মানে আয়োজিত একটি শীর্ষ সম্মেলনও বাতিল করেছেন। অন্যদিকে মিশরও ইসরাইলকে দায়ী করেছে।

লেবাননের ইরান-ভিত্তিক হিজবুল্লাহ বাহিনী, যেটি ২০০৬ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, তারাও এটিকে ইসরায়েলের মারাত্মক আক্রমণ বলে নিন্দা জানিয়েছে। বুধবার তারা বিক্ষোভের ডাকও দেয়। হামলায় নিহতদের স্মরণে  বৈরুত সরকার জাতীয় শোক দিবসও ঘোষণা করে দেশটিতে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //