হামাসের সহজে পরাজিত না হওয়ার পেছনে যে সুড়ঙ্গ

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে নির্বিচারে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এর সঙ্গে শুরু করেছে সীমিত আকারে স্থল হামলা। গাজার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও সদাপ্রস্তুত হামাসকে পরাজিত করা এত সহজ হবে না বলে আল জাজিরার সংবাদ বিশ্লেষণে মন্তব্য করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে হামাসের দুর্ভেদ্য সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক। 

গতকাল শনিবার (২৮ অক্টোবর) প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত শুক্রবার থেকে গাজায় নতুন করে স্থল ও আকাশপথে সমন্বিত ও জোরালো হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। শনিবারও তা অব্যাহত ছিল। তবে এখনো পরিষ্কার নয় যে এটাই ইসরায়েলের সেই 'পরবর্তী পর্যায়ের যুদ্ধ' নাকি এর মাধ্যমে তারা শুধু হামাসের সক্ষমতা যাচাইয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে।

গত বুধ ও বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী গাজায় দুইটি ছোট আকারের স্থল অভিযান চালায়। প্রচারণার অংশ হিসেবে এই দুই অভিযানের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ভোরের আগেই বাহিনীর সদস্যরা ইসরায়েলে ফিরে যায়।

বিশ্লেষকদের মতে, চলমান হামলাগুলো 'খুব একটা বড় নয়'। তবে এগুলো সর্বাত্মক হামলার আগে নেওয়া প্রস্তুতির অংশ হতে পারে।

ফিলিস্তিনি সূত্রগুলো দাবি করেছে, হামাস গাজা উপত্যকায় মাটির নিচে সুবিস্তৃত সুড়ঙ্গপথে 'ইসরায়েল-প্রুফ' যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরি করেছে। বাইরে থেকে কেউ যাতে তাদের যোগাযোগে আড়ি পাততে না পারে, সে জন্য হামাস প্রায় ১০ কিলোমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে বিশেষ আবরণযুক্ত তার বসিয়েছে।

এ ধরনের তার অত্যাধুনিক সুড়ঙ্গপথে বসানো হয়েছে। এই তারগুলো থেকে নূন্যতম পর্যায়ের তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ হতে থাকে, যা মাটির গভীরে সব ধরনের আড়ি পাতার প্রযুক্তিকে প্রতিহত করে। এই নতুন ধরনের সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই সম্ভবত হামাস ৭ অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনা ইসরায়েলের কাছ থেকে গোপন রাখতে পেরেছিল।

গত শনিবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউভ গ্যালান্ট জানান, তার বাহিনীর সদস্যরা সুনির্দিষ্টভাবে সুড়ঙ্গপথ লক্ষ্য করে হামলা চালাবে। 

ইসরায়েল দাবি করে, তারা মাটির নিচের ১৫০টি অবস্থানে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। তবে তাদের এই দাবি যৌক্তিক নয় বলেই মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, ইসরায়েল সম্ভবত সুড়ঙ্গের উপর ১৫০ ভবনে হামলা চালিয়েছে—১৫০ সুড়ঙ্গে হামলা চালানো এত সহজ হওয়ার কথা নয়।

হামাস যখন মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শুরু করে, তখন সেই সুড়ঙ্গগুলো খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের ছিল। সেগুলো মাটির নিচে মাত্র কয়েক মিটার গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু এখন তাদের আছে সর্বোচ্চ ২০ মিটার গভীর সুড়ঙ্গ। সেগুলোয় ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী প্রকৌশল প্রক্রিয়া ও কংক্রিটের মতো মজবুত উপকরণ।

এত গভীর সুড়ঙ্গ খুঁড়তে যথেষ্ট প্রকৌশলগত দক্ষতা ও জনবলের প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও হামাস তা করেছে, কারণ এর ফলে সহজেই ইসরায়েল সীমান্তের বাধাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যায়—যার মধ্যে আছে উঁচু কংক্রিটের প্রাচীর, যা মাটির নিচে ৮ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু আরও গভীরে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে হামাস বাড়তি সুবিধা আদায় করেছে এবং কার্যত এই সুড়ঙ্গপথ ইসরায়েলের বোমা থেকে বেশ নিরাপদ।

এখন পর্যন্ত ইসরায়েল যেসব বোমা ব্যবহার করছে, তা মাটির খুব বেশি ভেতরে পৌঁছাতে করতে পারে না। এক মিটারের বেশি গভীরে আছে এমন যেকোনো কিছুই এসব বোমা থেকে নিরাপদ। আরও নিচে থাকা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে প্রয়োজন বিশেষ ধরনের বোমা।

এ ধরনের একটি বোমা হলো—রকেট-অ্যাক্সালারেটেড বোমা। এগুলো বানানো হয়েছিল বিমানবন্দরের রানওয়ে ধ্বংস করার জন্য। এ ধরনের বোমা সুড়ঙ্গ ও মাটির নিচের বাঙ্কার ধ্বংসে ব্যবহার করা যায়। তবে গাজায় এর উপযোগিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। কারণ গাজার সুড়ঙ্গগুলো খোলা আকাশের নিচে নির্মাণ করা হয়নি বললেই চলে।

বিগত বছরগুলোয় অসংখ্য বোমা হামলা থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে হামাস তাদের সুড়ঙ্গপথের বড় একটি অংশ অন্যান্য অবকাঠামো, যেমন আবাসিক দালানের নিচে তৈরি করেছে। অর্থাৎ, সেসব দালান ধ্বংস না করে সুড়ঙ্গ ধ্বংস করা সহজ হবে না।

এর ফলে, হামাসের সুড়ঙ্গ অনেক ক্ষেত্রেই শক্তিশালী কংক্রিটের তৈরি বহুতল ভবন দিয়ে সুরক্ষিত। এগুলো ধ্বংস করতে ভিন্ন ধরনের অস্ত্রের প্রয়োজন। শক্তিশালী বোমা ও রকেটও কংক্রিটের তৈরি বস্তুতে আঘাত হানলে বিস্ফোরিত হয়। ফলে, হয়তো একটি তলা ধ্বংস হবে, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও সুড়ঙ্গপথের কোনো ক্ষতি হবে না।

তবে প্রথাগত অস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, 'ট্যানডেম ওভারহেড'যুক্ত রকেটও একবারে সর্বোচ্চ দুই বা তিন তলা ধ্বংস করতে পারে—চার পাঁচ তলা বা এর চেয়ে উঁচু দালান ধ্বংস করা এগুলোর পক্ষে সম্ভব না। এর চেয়ে বড় কথা, দালানের দুই তিন তলা ধ্বংস হলে যে ধ্বংসাবশেষ থাকে, সেই টুকরো টুকরো কংক্রিট, ইট ও পাথর সুড়ঙ্গপথকে দেয় বাড়তি সুরক্ষা।

বিশ্লেষকদের মতে, বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমা বলে যে সরঞ্জাম সামরিক বাহিনীর হাতে আছে তা গাজার ক্ষেত্রে তেমন কাজে লাগবে না। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ভূগর্ভস্থ সুবিশাল বাঙ্কারগুলো ধ্বংস করতে এগুলো তৈরি করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে  হামাসের গভীর সুড়ঙ্গপথের গুরুত্বপূর্ণ অংশ চিহ্নিত করে সেখানে হামলা চালানোর বিষয়টি শুধু জটিলই নয়, ব্যয়বহুলও হবে। প্রতিটি বোমার দাম ১০ লাখ ডলারেরও বেশি—এ ধরনের হাজারো বোমা মেরেও হয়তো হামাসের তেমন কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না ইসরায়েল!

শুরুতে পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত মার্কিন বাহিনী ইরাকে এসব বোমা ব্যবহার করেনি। ইসরায়েল এ ধরনের কিছু বোমা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কিনেছে। তবে আল জাজিরার বিশ্লেষণ মতে, এগুলো চলমান সংঘাতে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখবে না বা ইসরায়েলকে কৌশলগত সুবিধা দেবে না।

ইরাকের ছিল কয়েক ডজন মূল কমান্ড বাঙ্কার। সেগুলো ধ্বংস করলে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যেত। কিন্তু হামাসের বাঙ্কার আকারে অনেক ছোট ও সংখ্যা অনেক বেশি। সেগুলো মাটির গভীরে লুকানো।

সীমান্তে তিন লাখ সেনা ও রিজার্ভ সেনা মোতায়েন করলেও ইসরায়েল এখনো সেই 'বড় আকারের' স্থল হামলা শুরু করেনি।

গত চার দিনের হামলা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার যে, এখনো ইসরায়েল এমন কোনো বড় আকারের কৌশলগত সুবিধা বা উদ্যোগ নিতে পারেনি যা থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যে তারা স্থল যুদ্ধে হামাসের বিরুদ্ধে জয়ী হবে।

আগামী দিনগুলোয় জানা যাবে ইসরায়েল তাদের নিজেদের ও হামাসের হামলা থেকে কতটুকু শিখতে পেরেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //