সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ইসরায়েল

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্ভবত জানেন না, কোথায় থামতে হবে। কিংবা যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তাকে থামাতে চায় না। বিশেষ করে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন সরকার ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে গণহারে মানুষ হত্যায় কিঞ্চিৎ কষ্টানুভব করছে না। এ কারণে গাজা উপত্যকা থেকে লেবাননে বড় মাত্রায় সামরিক হামলা শুরু করতে পেরেছে যুদ্ধবাদী নেতা নেতানিয়াহুর বাহিনী। 

লেবাননে দেড় যুগের মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলা হয়েছে ২৩ সেপ্টেম্বর। ইসরায়েলের বিমান হামলায় অন্তত সাড়ে পাঁচশ মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দুই হাজারের বেশি। নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ শিশু রয়েছে। এই যুদ্ধের সূত্রপাত সাম্প্রতিক নয়। বিবাদ বেশ পুরনো। তবে, গত বছর ৭ অক্টোবর গাজায় সামরিক হামলা শুরু করলে লেবাননের সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েল সীমান্তে অনিয়মিত হারে হামলা শুরু করে। পরস্পরকে দোষারোপ ও হুমকি-ধমকির মধ্যে মধ্য সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল জঘন্যতম এক কৌশল গ্রহণ করে- হিজবুল্লাহর সদস্যদের ব্যবহৃত যোগাযোগযন্ত্র (পেজার ও ওয়াকিটকি) দূর-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় বিস্ফোরণ ঘটায়। এসব ঘটনায় অন্তত ৩৭ জন নিহত হয়েছেন; আহত প্রায় তিন হাজার। এমনকি লেবাননে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূতও এক চোখ হারিয়েছেন, অন্য চোখেও চোট পেয়েছেন গুরুতর। লেবানন, হিজবুল্লাহ এবং এই গোষ্ঠীর মিত্র ইরান এ ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। যদিও ইসরায়েল এর দায় স্বীকার করেনি, তবু অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলছেন, এটা ইসরায়েলেরই কাজ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পেজার ও ওয়াকিটকিগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার কয়েক মাস আগেই ইসরায়েল এসব যন্ত্রের ভেতর বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর লেবাননের নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের ফোনে ফোনে সতর্কবার্তা পাঠানো ও কল করার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল এ ইঙ্গিতই দিল- শত্রু হিজবুল্লাহই শুধু নয়, সাধারণ লেবাননিদের ব্যক্তিগত তথ্যে অনুপ্রবেশ করার সক্ষমতাও রয়েছে তার। গাজায় ইসরায়েলের হামলার কথিত লক্ষ্য ছিল উপত্যকার শাসকগোষ্ঠী হামাসকে নির্মূল করা, যা তারা পারেনি; কিন্তু এরই মধ্যে ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে তারা হত্যা করেছে। একইভাবে এখন ইসরায়েল বলছে, তারা হিজবুল্লাহকে সমূলে ধ্বংস কিংবা আজীবনের মতো শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে লেবাননে হামলা চালাচ্ছে; কিন্তু একদিনের হামলায় অর্ধসহস্র মানুষকে হত্যা করেছে তারা।

এই হত্যার বৈধতা ইসরায়েল কীভাবে পায়? পৃথিবী কি চোখ বুঁজে থাকবে? না, এরই মধ্যে কথা বলেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, যিনি এর আগে বহুবার গাজায় ইসরায়েলি হামলা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় কথা তুলেছেন। তিনি বলেছেন, লেবাননে ইসরায়েলি এই বর্বরতার বিচার অবশ্যই করতে হবে, এজন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; কিন্তু আদৌ তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিন্দা, উদ্বেগ ও হুশিয়ারির সুর শোনা যাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত বলছে, রাষ্ট্রের সম্পর্ক ও সার্বভৌমত্ব নিয়ন্ত্রণকারী আইনের প্রতি বিবেচনা না করেই লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এই হামলা নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটি। তারা বলছে, এই হামলা ‘সহিংসতাকে উসকে দেবে এবং এটি একটি বেপরোয়া পদক্ষেপ’। আঞ্চলিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে আবার সতর্ক করেছে সৌদি আরব। 

মিশর বলছে, লেবানন ও গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন এই অঞ্চলকে একটি বৃহত্তর সংঘাতে নিমজ্জিত করার হুমকি দিচ্ছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হস্তক্ষেপ করারও আহ্বান জানিয়েছে কায়রো। মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব-১৭০১ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। এই প্রস্তাব ২০০৬ সালে ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে যুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছিল। জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি মধ্যপ্রাচ্যকে ‘বিপর্যয়কর পরিণতি’ থেকে রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার ভাষায়- ‘লেবাননের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসন গাজার বিরুদ্ধে তার আগ্রাসন বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক অক্ষমতার কারণেই সম্ভব হয়েছে।’

গাজায় আগ্রাসন ও গণহত্যা চালিয়ে আগেই আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে ইসরায়েল। আর লেবাননে আগ্রাসন শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে বহুজাতিক সংঘাতের ঝুঁকি আরও বাড়াল তারা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh