কোথায় হেরে গেল ইসরায়েল

দীর্ঘ ১৫ মাসের ধ্বংসযজ্ঞ শেষে গাজা উপত্যকায় ‘আপাতত’ স্বস্তি ফিরেছে। আপাতত বলতে হচ্ছে, কারণ বিশ্লেষকরা এই যুদ্ধবিরতিকে ‘মোস্ট ফ্র্যাজাইল সিজফায়ার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এরই মধ্যে যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও কারাগারে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া শুরু হলেও পশ্চিম তীরে ধরপাকড় ও গুলি অব্যাহত রয়েছে। ফলে যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়তে পারে। দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, জুলুমের জবাবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর বিশ্বের অন্যতম সামরিক পরাশক্তি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে অভিযান চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস। গোষ্ঠীটি সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা করে এবং আরো ২৫১ জনকে গাজায় জিম্মি করে নিয়ে যায়। এক সপ্তাহ পরে ইসরায়েল স্থল অভিযান শুরু করলে বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেছিলেন যে এই যুদ্ধ হয়তো কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হবে। তবে এটি ১৫ মাস ধরে চলেছে, ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যা ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ। 

৭ অক্টোবর নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক। তবে এই হামলার মাত্রা এবং তীব্রতা ছিল নজিরবিহীন। যেভাবে কঠোর নিরাপত্তা ও সামরিক শক্তি অর্জনের মাধ্যমে ইসরায়েল নিজেকে ‘অস্পর্শ্য’ অহমের ভাবমূর্তি দাঁড় করিয়েছিল, এই হামলা তাতে চপেটাঘাত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ইসরায়েলের পাল্টা হামলার প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও তীব্রতাও একইভাবে নজিরবিহীন ছিল। গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যায় অন্তত ৪৬ হাজার ৭০০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩ হাজার ৩১৯ জন শিশু। হতাহত ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এ ছাড়া নিখোঁজ বা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে অন্তত ১০ হাজার। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও হাসপাতালসূত্রে আহতদের সংখ্যা এক লাখ ১০ হাজারেরও বেশি। অব্যাহত বোমা বর্ষণে গাজার ৯২ শতাংশ বাড়িঘর, ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। মোট জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশের বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। হাসপাতালসহ ৬৫৪টি স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনার ওপরে পরিচালিত হামলায় এক হাজার ৬০ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুলের সংখ্যা ৫৩৪টি (মোট স্কুলের ৯৫ শতাংশ)। ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। এই পরিসংখ্যান ইসরায়েলের নৃশংস হামলার চিত্র তুলে ধরে, যা গাজার মানুষের জীবন, অবকাঠামো এবং ভবিষ্যৎকে গভীরভাবে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এই যুদ্ধে জিতল কে? 

যুদ্ধের সূচনা যদি ৭ অক্টোবর ধরা হয়, তাহলে হামাস দলগতভাবে ব্যাপক মূল্য দিয়েছে। দলটি শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকে হারিয়েছে। ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ার, হামাসের সামরিক উইং আল কাসাম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মদ দেইফকেও হত্যা করে ইসরায়েল। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, এই যুদ্ধে ১০ থেকে ১৫ হাজার যোদ্ধা হারিয়েছে হামাস। সুতরাং হামাস এই ‘যুদ্ধ’ জয়ী তা বলার সুযোগ নেই। 

তাহলে কী জয় ইসরায়েলেরই? এই প্রশ্নের সরল কোনো উত্তর নেই। তবে কয়েকটি বিষয় খতিয়ে দেখলে পরাক্রমশালী ইসরায়েলের গর্ব-অহংকার ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে এই যুদ্ধবিরতি। এর আগেও যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে সমঝোতার কাছাকাছি পৌঁছেছিল দুই পক্ষ। ২০২৩ সালের নভেম্বরে এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন এবং হামাসের বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেন। তার ভাষায়, এই সম্পূর্ণ বিজয় বলতে ইসরায়েলি জিম্মিদের উদ্ধার এবং হামাসকে নির্মূল করা বোঝায় তা বলাই বাহুল্য। 

তবে হামাসের ইসরায়েলের চার নারী সেনাকে মুক্তি দেওয়ার ভিডিওতে দেখা যায়, কতটা সুনিপুণ পরিকল্পনার আলোকে এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছে প্রতিরোধ যোদ্ধারা। যুদ্ধের মধ্যেই হামাস আরো ১৫ হাজার নতুন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ ছাড়া নির্বিচারে হামলা চালিয়ে জিম্মিদের জীবিত উদ্ধারের স্বপ্ন ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় দখলদার রাষ্ট্রটির। নেতানিয়াহুর এই যুদ্ধ জয়ের দাবি যে অমূলক তা তার সেনাপ্রধানের পদত্যাগেই স্পষ্ট। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হালেভি স্বীকার করেছেন, ‘আইডিএফ ইসরায়েলের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মিশন ব্যর্থ হয়েছে। এই ভয়াবহ ব্যর্থতা প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা আমাকে তাড়া করে এবং আমার জীবনের বাকিটা সময়ে এটা থাকবে।’ নেতানিয়াহু ও দেশটির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গত বছরের ২১ নভেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। বিশ্বব্যাপী গাজায় সাধারণ মানুষের ওপর ইসরায়েলের এই গণহত্যার প্রতিক্রিয়াও নজিরবিহীন। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোতে এই গণহত্যার প্রতিবাদ হয়েছে, স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি উচ্চকিত হয়েছে। 

ইসরায়েলি সাংবাদিক ইটাই রোমের মতে, ৭ অক্টোবরের হামলার প্রায় দুই মাস পর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে নেতানিয়াহুর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি গাজা যুদ্ধ শেষ করার জন্য তিনটি মৌলিক ‘পূর্বশর্ত’ উল্লেখ করেন। এগুলো হলো হামাসকে নির্মূল করা, গাজা নিরস্ত্রীকরণ এবং ফিলিস্তিনি সমাজকে উগ্রপন্থা থেকে মুক্ত করা। একই পত্রিকা কিছুদিন আগে একটি বিস্তৃত প্রতিবেদনে বলেছে, নেতানিয়াহু তার এসব লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন। হামাস এখনো সক্রিয় এবং তারা হাজার হাজার নতুন যোদ্ধা নিয়োগ দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh