প্রফেসর আব্দুস সালাম
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২১, ০৯:২১ এএম
আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২১, ১১:৫৮ এএম
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২১, ০৯:২১ এএম
প্রফেসর আব্দুস সালাম
আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২১, ১১:৫৮ এএম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যেভাবে উজ্জীবিত করেছিলেন, জাতীয়তাবাদী কোনো আন্দোলনের ইতিহাসে অন্য কোনো নেতাই সে রকমটি করতে পারেননি। একটা আধুনিক সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করে বাংলাদেশে উপনিবেশবাদী শাসনকে উচ্ছেদ করতে এবং পরে দেশ পরিচালনায় তার কর্তৃত্বকে স্বেচ্ছায় মেনে নিতে বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। পাকিস্তানি কর্তৃত্বকে সম্পূর্ণ অমান্য করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে বাঙালি মেনে নেবার ফলেই বস্তুত বাংলাদেশ একাত্তরের মার্চেই এক স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সারাবিশ্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের বৈধ মুখপাত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
একটি স্বাধীন দেশের বোধ ও চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন- পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে নিজ স্বাধীনতার স্বার্থে। একাত্তর সালের মার্চে বাংলাদেশজুড়ে মুক্তির স্বাদের যে উত্তাল চেতনা সমগ্র বাঙালির মধ্যে পরিব্যপ্ত ছিল, সে সম্পর্কে একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম খুব একটা ভালো জানে না বলেই বঙ্গবন্ধুকে হেয় প্রতিপন্নকারী মন্তব্যগুলো তাদের বিক্ষুব্ধ করে না।
যার নির্দেশে বীর বাঙালি অস্ত্র ধরে বাংলাদেশকে স্বাধীন করল, সেই নেতাকে স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্য সপরিবারে হত্যা করে বেতারকেন্দ্রে গিয়ে সদম্ভে এক মেজর ঘোষণা করল ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ এবং গণআন্দোলনের সংগ্রামী ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ বেতারের বদলে পাকিস্তানি ধারায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ও ‘রেডিও বাংলাদেশ’ সেদিন থেকেই প্রচারণা শুরু হলো। অথচ কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের মানুষ এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল না। এসব চিন্তা করলে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এ প্রজন্মের সবাই একটা ধূম্রজালে নিক্ষিপ্ত হয়। সঠিক উত্তরের অভাবে সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় না। বিভ্রান্তির এ ধূম্রজাল ছিন্ন করে সব কিছুকে স্পষ্ট করার জন্য স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বোধের বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসন, ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় সবাই বাংলা ভাষাভাষী এবং জীবনাচরণে দেশজ বলে সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে গিয়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ মানসসম্পদ হিসেবে জনগণ অর্জন করে। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেও এই জনগোষ্ঠী জারিত হয়। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে দেশ পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে শেখ মুজিব কোনো অসঙ্গত কাজ করেননি। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই চার মূলনীতিকে যে কেটে- ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন করা হয়েছে, তাতে মনে হতে পারে বাংলাদেশের জন্য ওই চার মূলনীতি খুবই অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল। আসলে কি তাই? না। প্রকৃতপক্ষে অসঙ্গতি ছিল জাতি রাষ্ট্র গঠনের মূল নায়ক এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্রের ভেতরে।
সামন্তযুগে কোনো বুদ্ধিমান সামন্ত শাসক এদেশে কখনো ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে দেখা যায় না; কিন্তু পাকিস্তানি আমলে এদেশীয় মধ্যবিত্ত সামন্তদের চেয়েও পশ্চাদবর্তী মানসিকতা প্রদর্শন করেছে তারা। ফলে ধর্মীয় দোহাইয়ে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক রূপ জনগণের মানসভূমের গভীরে শিকড় গেড়ে বসে। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ফ্রাঙ্কনস্টাইন স্বাধীন বাংলাদেশেও পুনঃআবির্ভূত করার চেষ্টা সুকৌশলে চালাতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীচক্র। বিদেশি সহযোগিতাও তারা পায়। বাহ্যিক আচার আচরণে, শিক্ষা-দীক্ষায় একেবারে আধুনিক মানুষ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট বলে এদেশের মধ্যবিত্ত প্রতিভাত হলেও সামন্ত চেতনার অনেক অমানবিক চিন্তাধারায় এরা এমনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, আপন স্বার্থ প্রতিষ্ঠার তাগিদে সামন্তদের মতোই সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় সব কিছু একসঙ্গে মিশিয়ে একটি ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পোড়া মাটি নীতি গ্রহণের ফলে পুরো বাংলাদেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর একটি নবীন দেশকে গড়ে তুলতে সর্বাত্মক সহযোগিতার পরিবর্তে নিতান্ত স্বার্থগত চিন্তা-চেতনায় এদেশের মধ্যবিত্ত নিমগ্ন হয়ে পড়ে।
মুজিব হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একাংশ যে চরম নৃশংসতা ও অমানবিকতা দেখিয়েছিল, তাতে সে সময় নিরস্ত্র সাধারণ জনগণের ওপর পাকিস্তানি হায়েনাদের মতো বাঙালি সৈন্যরাও যে ঝাঁপিয়ে পড়ত না- তা না ভাবার কোনো যুক্তি ছিল না। ফলে যাদের ভেতর প্রতিবাদী স্পৃহা সে সময় জেগেছিল, তারাও নিস্পৃহ হয়ে যায়। তার ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বিস্ময়ে বোবা করে জাতিকে একটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় নিক্ষেপ করেছিল। তথাপি মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরে এদেশের মধ্যবিত্ত যে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেছে, তাতে একটি সত্য বেরিয়ে আসে যে, মধ্যবিত্ত ধারাটি পাকিস্তান সৃষ্টিতে মুসলিম সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় আবদ্ধ ছিল, তা একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিকশিত করার প্রয়াস চলে, পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ড তাকে নস্যাৎ করে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ ভাবধারার পুনঃপ্রবর্তন ঘটায়।
আমরা কি এখনও সেই সাম্প্রদায়িকতার কানাগলি থেকে বেরিয়ে বিস্তীর্ণ পথের পথিক হতে পেরেছি?
লেখক : রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh