কেমন হলো ‘টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই’

সম্প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের একটি অংশের ওপর নির্মিত সিনেমা ‘টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই’ স্কুল-কলেজে প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দিয়েছে সরকার। বঙ্গবন্ধুর শৈশব, কৈশোর ও তরুণ জীবন নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এই সিনেমাটি। 

সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রটিকে মূলত ভাগ করা হয়েছে তিন ভাগে। প্রথম ভাগে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর শৈশবকাল, দ্বিতীয় ভাগ সাজানো হয়েছে কৈশোর মুজিবকে নিয়ে আর শেষ ভাগজুড়ে রয়েছে যুবক শেখ মুজিব। 

পর্দায় শৈশব ও কৈশোরে বঙ্গবন্ধুর স্থায়িত্ব কম হলেও তাতে তুলে ধরা হয়েছে শিশু বয়স থেকেই তার ভেতরে বাস করা মানবিকতা, প্রতিবাদী স্বভাব ও চারিত্রিক দৃঢ়তাকে। গল্পের শুরুতেই নিজে বৃষ্টিতে ভিজে বন্ধুকে ছাতা দিয়ে বাড়িফেরা এবং মায়ের অগোচরে ভিখারির ঝোলাতে চাল ও টাকা দিতে দেখা যায় শিশু মুজিবকে। অতটুকু বয়সেই মাস্টার মশাইয়ের কাছে স্বাধীনতা ও ক্ষুদিরাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে তার চিন্তা ভাবনার গভীরতা তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ফুটবলপ্রীতির কথা বিভিন্ন লেখা-ঝোখার মাধ্যমে জানা গেলেও চলচ্চিত্রটিতে বঙ্গবন্ধুর কৈশোর জীবনের অংশে সেটি তুলে ধরা হয়েছে। এর পরপরই সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির মুখোমুখি হতে দেখা গেছে কিশোর বঙ্গবন্ধুকে। অবহেলিত মুসলিম সমাজকে নিজ পায়ে দাঁড় করাতে অশিক্ষা ও দরিদ্রতা থেকে মুক্ত করতে সংগঠকের ভূমিকায় আবির্ভূত হতে দেখা যায় কিশোর মুজিবকে। অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করা এবং ঘোর বিপদেও মাথা নিচু করে না পালানো যে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম স্বভাব ছিল, তা উঠে এসেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের হাত থেকে আটককৃত মুসলিম ছেলেকে ছিনিয়ে আনা এবং সে অপরাধে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও তার না পালানোর দৃশ্যগুলো থেকে। 

ক্ষুদ্র দুটি ভাগে বিভক্ত শৈশব ও কৈশোর শেষ করেই নির্মাতা দর্শকদের নিয়ে গেছেন যুবক শেখ মুজিবের কাছে। যুবক মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখতে গিয়ে মনে হবে ভারতবর্ষ ইতিহাস ভাসছে চোখের সামনে। সেখানে উঠে এসেছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে শেখ মুজিবের তরুণ ছাত্রনেতা থেকে ধীরে ধীরে পরিপক্ব রাজনীতিক পরিণত হওয়ার গল্পের পাশাপাশি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সান্নিধ্যে আসার গল্প। এই পর্বে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার হিন্দু মুসলিমের দাঙ্গা বন্ধে শেখ মুজিবের আপ্রাণ চেষ্টা, তৎকালীন সময়ে চলমান দুর্ভিক্ষে ভুখা অনাহারিদের পাশে পার্টির ছেলেদের নিয়ে এগিয়ে আসা, এবং ছাত্রলীগ জন্মের গল্প উঠে এসেছে চলচ্চিত্রটিতে। তাছাড়া পাকিস্তান হাসিলে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন সংগ্রাম থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে মানুষের অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধুর লড়ে যাওয়া, ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্ততাসহ মানুষের তরে নিবেদিত বঙ্গবন্ধুর কলকাতা থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ফরিদপুরের সব গল্পই সিনেমাটিতে একসঙ্গে বেঁধেছেন নির্মাতা।

এবার আসি টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন চরিত্রে রূপদানকারী অভিনয় শিল্পীদের অভিনয়সহ আনুষঙ্গিক আলোচনায়। এই সিনেমাটি দেখতে গেলে একটি ঘটনার পরের ঘটনাটি কি ছিল, তা জানার আফসোস থেকে যাবে। কেননা নির্মাতা বঙ্গবন্ধুর শুরু থেকে ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত সময়কালকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে গল্প বলেছেন, যেখানে শুধু ওই সময়গুলোর চুম্বক অংশই তুলে ধরেছেন তিনি। তবে চলচ্চিত্রটি দেখতে বসলে যে প্রশংসাটি করতেই হবে, তা হলো কাহিনী ও চিত্রনাট্যের প্রশংসা। বিশেষ করে কিশোর মুজিবকে হামিদ মাস্টার কর্তৃক হিন্দু মুসলিমের বৈষম্যের উপযুক্ত কারণ দর্শানোটাকে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত মনে হয়েছে। বাকি গল্পগুলোও কাহিনীকার শামীম আহমেদ রনী বেশ মালা গাঁথার মতো গেঁথেছেন। তবে যেটা চোখে লেগেছে তা হলো শেখ মুজিব তার পরিবার ও গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলবেন তা নিয়ে যেন সংলাপ রচিয়তা বেশ দ্বিধান্বিত ছিলেন। আর সেকারণেই হয়তো পরিবার ও গ্রামের মানুষদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রটি কখনো আঞ্চলিক এবং কখনো শহুরে ভাষায় কথা বলেছে। যদিও তাকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন লেখায় পরিচিতজনদের সঙ্গে তার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার ব্যাপারটি সবারই জানা। 

এবার আসি অভিনয় শিল্পীদের অভিনয়ের সফলতা ও ব্যর্থতার কথায়। 

চলচ্চিত্রটি দেখতে বসলে প্রথমেই যে চরিত্রটির অভিনয় ভীষণভাবে বিরক্তির উদ্রেক সৃষ্টি করবে, সেই চরিত্রটি হলো শেখ মুজিবের যুবক বয়সের চরিত্রে রূপদানকারী শান্ত খানের অভিনয়। যান্ত্রিক অভিনয়ের পাশাপাশি তার সাজসজ্জা মিলিয়ে তাকে একগাদা মানুষের মাঝে অ্যানিমেশন চরিত্র বলে মনে হয়েছে। তার বিপরীতে বঙ্গমাতা রেনুর চরিত্র রূপদানকারী দীঘির পর্দায় স্থায়িত্ব কম থাকলেও তিনি যতটুকু ছিলেন ততটুকু ভালোভাবেই উতরে গেছেন। শেখ মুজিবের বাবা-মায়ের চরিত্রে গুণী অভিনেতা অভিনেত্রী দিলারা জামান ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় যতটুকু দরকার ছিল ততটুকু পাওয়া গেছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চরিত্রে মাজনুন মিজানকে ঠিক মেনে নেওয়া না গেলেও সুঅভিনয় দিয়ে তিনি নিজেকে উতরে নিয়েছেন; কিন্তু শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক চরিত্রে ভালো কাজ হয়নি শিবা শানুর, তেমনই বেমানান লেগেছে মওলানা ভাসানীর চরিত্রটিকেও। দাঙ্গাসহ বিভিন্ন জনসমাগমের দৃশ্যগুলো তৈরিতে যে নির্মাতা তেমন মনোযোগী ছিলেন না, তা অল্প লোকজন দিয়ে ওই দৃশ্যগুলোর, দৃশ্যায়ন দেখে বেশ ভালোই বোঝা যায়। তবে এই ত্রুটিগুলো বাদ দিলেও যে ত্রুটিটি এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, তা হলো যুবক মুজিবের চরিত্রে রূপদানকারী শান্ত খানের অভিনয়ের ভীষণ দুর্বলতা। আপনি যদি কষ্ট করে এই ত্রুটিটিও এড়িয়ে গিয়ে চলচ্চিত্রটি উপভোগ করতে পারেন তবে চলচ্চিত্রটি উপভোগ্য হতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //