কা ফ কা র বি চা র

চেক লেখক ফ্রানৎস কাফকার ‘বিচার’ উপন্যাসটির তিনটি চিত্রায়ন আমরা দেখতে পাই। উপন্যাসের অর্থাৎ ‘দ্য ট্রায়াল’ নামে প্রথম সিনেমাটি নির্মাণ করেন আমেরিকান চিত্রনির্মাতা ওরসন ওয়েলস (১৯১৫-১৯৮৫) ১৯৬২ সালে, দ্বিতীয়বার ডেভিড টমাস এবং সাবরিভ বাবুটারের যৌথ পরিচালনায় প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয় ১৯৯০ সালে এবং তৃতীয়বার ব্রিটিশ নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টারের চিত্রনাট্যে এবং ব্রিটিশ পরিচালক ডেভিড জোনস (১৯৩৪-২০০৮) এর পরিচালনায় ১৯৯৩ সালে নির্মিত হয় দ্য ট্রায়াল সিনেমা।

এখান থেকেই আমাদের বুঝে নিতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, কাফকার দ্য ট্রায়াল উপন্যাসটির গুরুত্ব এবং তার অনিবার্যতা। প্রামাণ্যচিত্রটি ছাড়া (সেখানে কাফকার জীবনীসহ উপন্যাসটির চিত্রায়ন করা হয়েছে) বাকি দুটি সিনেমা আমরা যদি পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাই, ওরসন ওয়েলস এবং ডেভিড জোনস দু’জনই উপন্যাসের মূল বর্ণনা থেকে সরে যাননি। তবে ওরসন ওয়েলস নির্মিত বিচার সিনেমা শুরু হয় উপন্যাসের প্রায় শেষ অংশ থেকে, যা উপন্যাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদিও কাফকার উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু শেষের এই অংশটি উপন্যাসের মূল বক্তব্যকে যেন ধরিয়ে দেয়। যেখানে গির্জার যাজক ছবির নায়ক জোসেফকে একটি গল্প শোনায়। যে গল্পের কথা আমরা পরে আলোচনা করব। ছবিতে মিজ-অ-সিন টেকনিকে বিশাল বিশাল সেট ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিভিন্ন আদালত, আদালত প্রাঙ্গণ, ছবির নায়ক জোসেফ কে’র ব্যাংক, গির্জা ইত্যাদি। এখানে পরিচালক ওয়েলস ইচ্ছে করেই এসব বড় বড় সেটের আয়োজন করেছেন। কারণ মূল উপন্যাসটি যদি আমরা নিবিড় পাঠ করি, তাহলে বুঝতে পারব কতটা অসহায় একটি চরিত্র জোসেফ কে’র মাধ্যমে এঁকেছেন ফ্রানৎস কাফকা। কে’র এই অসহায়ত্ব বোঝাবার জন্য, এই ধরনের বিশাল সেটের খুব প্রয়োজন ছিল।

কেননা, মানুষ বিশালতার কাছে ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ে। বিশালতার কাছে মানুষের করার কিছুই থাকে না শুধু দুঃখ, যন্ত্রণা আর হতাশা ছাড়া। এই বিশালতা শুধু মামলা-মোকদ্দমার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। টোটালিটেরিয়ান বা সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের দৈত্যাকার প্রশাসনিক ব্যবস্থার এক বৈশ্বিক চিত্র খোলাখুলিভাবে দেখানো হয়েছে। এমনকি গির্জাকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। ওয়েলসের নায়ক জোসেফ কে’কে দেখে মনে হয়, আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা যেসব সাধারণ মানুষ আছে, যারা জোসেফ কে’র মতো নিত্য এক অসহায় অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে তাদেরই একজন প্রতিনিধি। সাদা-কালোয় নির্মিত হবার কারণে ওয়েলসের বিচার, কাফকার বিচারের মতো এক দুঃস্বপ্নতাড়িত গল্পের চিত্র আরও পরিচ্ছন্নভাবে ফুটে উঠতে দেখা যায়। যে কারণে ওয়েলসের সিনেমাটি দেখার সময়, উপন্যাসের উপলব্ধির সঙ্গে সিনেমার উপলব্ধি মিশে এককার হয়ে যায়। অন্য দিকে ডেভিড জোনসের বিচার ছবিতে, পরিচালক উপন্যাস থেকে এক কণা অন্যথা করেননি। জোনসের ছবিটি দেখলে মনে হয় উপন্যাসটি যেন পড়তে পড়তে যাওয়া হচ্ছে। তবে জোনসের নায়ক, ওয়েলসের নায়কের থেকে একটু বেশি গ্ল্যামারাস, আকর্ষণীয়। ওয়েলসের মতো সাদামাটা সাধারণ নয়। এটি হয়েছে সম্ভবত সময়ের ব্যবধানের কারণে। কেননা ওয়েলসের সময়ে সিনেমা তখন তার স্বর্ণযুগ পার করছে, অন্যদিকে জোনসের সময়ে মানুষ প্রচুর সিনেমা দেখে ফেলেছে, ফলে সিনেমার প্রতি আকর্ষণ ধরে রাখার জন্য খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন গ্ল্যামারাস নায়কের প্রয়োজন পড়েছে। তবে জোনসের কৃতিত্ব এখানেই, যে উনি উপন্যাসের প্রতিটি বাক্য চিত্রায়ন করেছেন। এবার আমরা মূল উপন্যাসের প্রতি বিস্তারিত পর্যবেক্ষণে যাব। তাহলে দুটি ছবির মর্মও একই সঙ্গে বোঝা যাবে। 

মেটামরফোসিসের মতো বিচার উপন্যাসেও কাফকা পাঠককে শুরুতেই একটি হোঁচট খাইয়ে দেন। উপন্যাসের শুরুতেই আমরা জানতে পারি, কোনো এক সুন্দর সুস্থ সকালে উপন্যাসের নায়ক জোসেফকে গ্রেফতার হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে; কিন্তু কে মামলা দায়ের করেছে এবং কিসের বিরুদ্ধে তার মামলা, অর্থাৎ জোসেফ কে’র কী দোষ, সারা উপন্যাস ঘেটেও আমরা আর জানতে পারি না। উপন্যাস যতই এগিয়ে যায়, পাঠক নিবিষ্ট মনে পড়তে থাকে এবং জানার চেষ্টা করে কে’র বিরুদ্ধে কিসের মামলা হয়েছে; কিন্তু উপন্যাস যতই এগিয়ে যায়, আমরা দেখতে পাই সেই ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’এর অ্যালিসের মতো, যে অ্যালিসকে কেউ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার রাস্তাটা বলে দেয় না।

অ্যালিস যার কাছেই যায়, তারা সবাই অ্যালিসের সঙ্গে গল্প করে, হাসিঠাট্টা করে, কিন্তু বাড়িতে যাবার রাস্তাটা বাতলে দেয় না। ঠিক এভাবেই সারা উপন্যাসজুড়ে কে যার কাছেই যায়, তারাও তার সঙ্গে নানা ধরনের গল্প করে, যেমন বিচার কী, আদালত কী, মামলা কী, প্রশাসন কী ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে, কিন্তু কে সেই মামলা থেকে কীভাবে নিষ্কৃতি পাবে বা আদৌ পাবে কি-না সেটি আর বলে না। কে যখন একজন চিত্রকর টিটোরেল্লির কাছে যায়, টিটোরেল্লি তাকে প্রশ্ন করে -

টিটো : আপনি কি নির্দোষ?

কে : আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। 

টিটো : আপনি যদি নির্দোষই হয়ে থাকেন, তাহলে তো ব্যাপারটা খুবই সহজ। 

কে : আমার নির্দোষিতার ব্যাপারটা মোটেও সহজ হয়ে উঠছে না। অনেক সূক্ষ্ম ছোটখাটো বিষয়ের বিরুদ্ধে আমাকে এমনভাবে লড়তে হয় যাতে শেষ পর্যন্ত আদালতই হারে; কিন্তু আমার সব চেষ্টার শেষেও, এমনকি একেবারে শূন্য থেকেই জোড়া দিয়ে দিয়ে অপরাধের বিশাল এক আস্তরণ যেন অলক্ষ্যে তৈরি হয়ে যায়।

চিত্রকার তখন কে’কে জানায়, কে যে নির্দোষ, এখানেই তার সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারণ আদালত যখন কাউকে অভিযুক্ত করে, তখন অপরাধ সম্পর্কে স্থির বিশ্বাস নিয়েই সেটি করে এবং কোনো মামলাতেই আদালতকে তার সেই বিশ্বাস থেকে সরানো যায়নি। এমনকি আদালতের কাছে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণের কোনো মূল্য নেই। মামলা থেকে 

নিষ্কৃতি পাওয়া আর না পাওয়া সবটা নির্ভর করে, আলোচনার ঘরে, লবিতে বা চিত্রকরের মতো ঘরে। ঠিক এখানে এসে কাফকার একটি ছোট গল্প ‘আইনের সমস্যা’র কথা আমাদের মনে পড়ে যায়। গল্পের শুরুতেই কাফকা লিখছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমাদের আইন-কানুনগুলো সব আমরা ঠিকমতো জানি না। এগুলো কিছুসংখ্যক মহাপুরুষের গোপন তথ্য। ’একটু পরেই আবার লিখছেন, ‘প্রাচীন যুগে আইন যখন সৃষ্টি করা হয়েছিল সেই তখন থেকেই মহান পুরুষদের স্বার্থরক্ষার সব অনুষঙ্গ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। মহান পুরুষেরা আইনের বাইরে, তারা আইনের গণ্ডীর ওপরের মানুষ।’

এই মহান পুরুষেরা তবে কারা? সমাজের সেইসব ব্যক্তি যারা খুন, ধর্ষণের মতো অন্যায় করেও আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায়। যে কারণে উপন্যাসের অনেক জায়গায় এই আইন-আদালত, মামলা ইত্যাদি নিয়ে কাফকাকে আমরা ব্যাঙ্গবিদ্রুপ করতে দেখি। 

এক

দ্বিতীয় দিন, যেদিন আদালত বন্ধ ছিল সেদিন আদালত ঘরে কয়েকটা বই দেখতে পায় কে। বইয়ের পাতা উল্টে দেখে, আইনের বইয়ের বদলে, সেখানে নগ্ন নারী-পুরুষের ছবি সম্বলিত বই রাখা হয়েছে। কে তখন আপন মনেই বলে ওঠে, ‘এসব আইনের বই এখানে পড়া হয়! আর এই লোকগুলোই আমার বিচার করবে?’ আদালতের নগ্ন-নোংরা মুখ এই ছবিগুলো দিয়ে প্রতীকীভাবে কাফকা বুঝিয়ে দেন। 

দুই

প্রশাসন যে কত বড় একটি ধাপ্পা এবং ক্ষমতার দাপট রাখে সেটিও আমরা দেখতে পাই। 

(ক) কে’কে গ্রেফতার করা হলেও, শর্ত থাকে, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কে তার দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। অর্থাৎ কে যে ব্যাংকে চাকরি করে সেখানে সে নিয়মিত অফিস করতে পারবে, মামলার আইনজীবী, বিচারক প্রভৃতির কাছে সে যাওয়া-আসা করতে পারবে ইত্যাদি; কিন্তু তার পেছনে লোক লাগিয়ে রাখা হবে নিয়মিত দশ ঘণ্টা করে তাকে পর্যবেক্ষণের জন্য। মামলার কারণে অফিসের কাজে প্রচণ্ড ঝামেলা সৃষ্টি ছাড়াও, কে তার মামলা থেকে উদ্ধার পাবার আশায় যার কাছেই যায়, যেমন আইনজীবী ড. হাল্ড, চিত্রকর টিটোরেল্লি, গির্জার যাজক, আরেক মামলায় ফেসে যাওয়া লোকট্র্যাভেলার ব্লক এমনকি দুই নারী চরিত্র আদালতের সেপাইয়ের বউ, হাল্ডের নার্স লেনি পর্যন্ত তার সঙ্গে প্রতারণা করে। সবার কাছে যাবার সময় এবং তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার সময়, সবাইকে কে’র খুব ভালো মনে হয়। সবাইকে সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। মনে হয়, এই বুঝি তার মামলা নিষ্পত্তির জিয়ন কাঠিটা হাতে পেয়ে গেল; কিন্তু প্রশাসনের লাল ফিতার দৈর্ঘ্য এবং জটিলতা সে ধরতে পারেনা। এই কারণে কে আদালতের বিষয়ে চিত্রকরকে বলে, ‘যেদিক থেকেই দেখা যাক না কেন, এটি একটি উদ্দেশ্যহীন প্রতিষ্ঠান’।

(খ) কে’র ধূর্ত ডেপুটি ম্যানেজার কে’কে তার অফিসে প্রচণ্ড চাপের মুখেই শুধু রাখে না, সেইসঙ্গে কে যেন তার মামলার কাজ ঠিকমতো করতে না পারে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখে। তাই সেই ডেপুটি যখন একবার কে’কে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, কে’র তখন তাকে দেখে মনে হয়, তার মুখের ওপরকার গভীর রেখাগুলি যেন তার ক্ষমতার চিহ্ন, বেশি বয়সের না। ক্ষমতা মানুষকে শুধু অহংকারী করেনা, কুৎসিতও করে ফেলে। 

তিন

ট্র্যাভেলার ব্লক কে’কে মামলার পিটিশন বা আবেদনের একটি কপির দুর্গতির ক্লান্তিকর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়, যেটা সে খুব কৌশলে একজন কর্মচারীর মাধ্যমে একবার দেখেছিল, সেসব পিটিশন কীভাবে লেখা হয়। প্রথমেই ল্যাটিন ভাষায় বড় একটি মুখবন্ধ লেখা হয়, তারপর একজন বিশিষ্ট পদাধিকারীর তোষামোদপূর্ণ কথা, তারপর অ্যাডভোকেটের নিজের সম্পর্কে স্তুতি এবং পিটিশন শেষ করা হয় নির্দিষ্ট সেই মামলার সঙ্গে প্রাচীন কোনো মামলার সাদৃশ্য দেখিয়ে ইত্যাদি। এই কারণেই উপন্যাসের এক জায়গায় বিচারকদের সম্পর্কে কাফকা লেখেন, আসলে এরা শূন্যগর্ভ অথচ অত্যন্ত দাম্ভিক। এর থেকে ব্যঙ্গাত্বক বাক্য আর কিসেই বা হয়। 

চার

বিচার ব্যবস্থার দুইমুখো সাপের নীতি কাফকা অ্যাভোকেট হাল্ডের মাধ্যমে চমৎকার করে ফুটিয়ে তোলেন, হাল্ড এক জায়গায় বলেন - ‘কে’র মনে রাখা উচিত যে মামলার ধারাবিবরণী প্রকাশ্যে গ্রহণ করা হয় না। আদালত যদি প্রয়োজন মনে করে, তবে তা প্রকাশ্যে অবশ্যই হতে পারে, তবে আইন তা কখনো জনসাধারণেরগোচরে আনা অনুমোদন করে না। ’এখানে দুটি বাক্যাংশ ‘আদালত যদি প্রয়োজন মনে করে’এবং ‘আইন অনুমোদন করে না’, একদিকে অনুমোদনের কথা বলা হচ্ছে আবার ঠিক তারপরেই আবার অনুমোদন করা হচ্ছে- দুটিই একসঙ্গে থাকে। একেই বলে বিচার ব্যবস্থার দুই মুখো সাপের নীতি। এর ফলে যা হয়, হাল্ড বলছেন, ‘ফলে, স্বাভাবিকভাবেই, মামলার আইন সংক্রান্ত রেকর্ড, তার ওপর প্রকৃত চার্জশিট বিচারাধীন অপরাধী অথবা তার আইনজীবীর কাছে অজ্ঞাতই থেকে যায় ... আসামি তার মামলার রেকর্ড দেখার সুযোগ কখনোই পায় না। ’ এই কারণে কাফকা আদালতের নাম দিয়েছেন- প্যালেস অব জাস্টিস। ঠিক রাজপ্রাসাদের মতই এই জাস্টিসের প্যালেসের শক্ত দেয়াল কেউ কোনোদিন ভাঙতে পারে না।

আসামি বুঝতেও পারে না, কী তার অপরাধ। আসলে কাফকা এই উপন্যাসে আদালতকে ধর্মের রূপক আকারে সাজিয়েছেন। ধর্ম যেমন অনড়, স্থির একটি বিষয়, আদালতও ঠিক তাই। কাফকার জন্ম যেহেতু ইহুদি পরিবারে, সেহেতু তার কাছে আদালত, বিচার, আইন-কানুন ইত্যাদির উৎপত্তি তার ধর্ম অর্থাৎ জুডায়িজম থেকে। যে কারণে চিত্রকর বলেন, আদালত যখন কাউকে অভিযুক্ত করে, তখন অপরাধ সম্পর্কে স্থির বিশ্বাস নিয়েই তা করে - এখানে অপরাধের বিশ্বাস এবং ধর্মীয় বিশ্বাস যেন এক হয়ে যায়। ট্র্যাভেলার ব্লকের মাধ্যমে কাফকা আমাদের জানিয়ে দেন, ‘মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন কি’ কেউ যদি সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ভাঙতে চায়, তবে সে নিজেই বিপদে পড়ে। এই কারণে ব্লক বলেন, ‘একমাত্র অর্থহীন কাজ হলো কোনো বিষয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবস্থা নেওয়া।’ কে তাই তার একার লড়াইয়ে, যে লড়াই বিচার বিভাগের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে করার ফলে পেরে ওঠে না। 

সারা উপন্যাস ঘিরে, কাফকা আমাদের একটি দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যান। নায়কের বিচারের জন্য পাঠক অস্থির হয়ে যায়। অথচ নায়ক যেমন কোনো বিচার না পেয়ে অস্থির হতে থাকে, পাঠকও অস্থির হতে থাকে পড়তে পড়তে বা সিনেমা দেখতে দেখতে। আমরা বুঝতে পারি, একটি মামলা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিকভাবে কতটা বিধ্বস্ত করে দেয়। উপন্যাসের শেষের দিকে গির্জার একজন যাজকের সঙ্গে কে’র দেখা হয়। যাজক তাকে দেখামাত্র চিনে ফেলে। কে বেশ অবাক হয় এই ভেবে যে তাকে এখন অচেনা মানুষরাও চিনে ফেলে। তার নিজের নামটা নিজের কাছেই একটি বোঝা মনে হয়। আসলে এই চিনে ফেলার বিষয়টিও বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ।

আদালত, মামলা, বিচার, প্রশাসন ইত্যাদির দুর্নীতিগ্রস্ত অবস্থার কথা সবাই জানে, কাউকে বিনাদোষে দোষী করার কথা সবাই জানে এবং বোঝে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। গির্জায় যাজকের সঙ্গে কথা বলে কে প্রথম দিকে বেশ খুশি হয়। ভাবে, অন্তত এখানে কিছু সমাধান পেলে পেতেও পারে; কিন্তু তাকে আবার নিরাশ হতে হয়। যাজক তাকে অদ্ভূত একটি গল্প বলে। যে গল্প দিয়ে ওরসন ওয়েলস তার ছবি শুরু করেছেন। গল্পটি ছোট্ট কিন্তু ভীষণ ধারালো এবং অর্থপূর্ণ। সেই গল্পে আমরা জানতে পারি, গ্রাম থেকে একজন লোক আসে বিচারের আশায়; কিন্তু আদালতের দরজার কাছে এসে থেমে যায়। দরজার দারোয়ান তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না। কেননা ঠিক সেই সময়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। যখন অনুমতি হবে, ঠিক তখনই সে ঢুকতে পারবে এবং শুধু সে-ই ঢুকতে পারবে, সেই দরজা শুধু সেই লোকের জন্যই নির্দিষ্ট। লোকটির শত অনুরোধেও দারোয়ান তাকে ভেতরে যেতে দেয় না। এভাবে বছরের পর বছর সেই লোক আদালতের দরজার বাইরে অপেক্ষা করে, বৃদ্ধ হয়। আদালতে ঢোকার অনুমতি আর পায় না এবং আদালতের দরজা শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। লোকটি মারা যায়।

যাজকের মুখে গল্পটি শোনার পর, কে রেগে যেয়ে বলে, দারোয়ান সেই লোকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কারণ দারোয়ান লোকটিকে ঢুকতে দেওয়ার জন্য আদালতের দরজায় দীর্ঘদিন অপেক্ষা করিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে ঢুকতে তো দেয়াই হয়নি, বরং লোকটিকে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করানো হয়েছে। উত্তরে যাজক যে দীর্ঘ ব্যাখ্যা দেন সেটি পড়ার পর, আমরা বুঝতে পারি, আসলে দারোয়ান এবং সেই লোক দু’জনই একসঙ্গে প্রতারিত হয়েছে। কারণ, দারোয়ানের ওপর শুধু আদেশনামা ছিল লোকটিকে ভেতরে প্রবেশ করানোর, এর বেশি না। আদালতের ভেতরে কী হয় সেটি দারোয়ান জানে না। লোকটি যখন ভীষণভাবে অনুরোধ করে ভেতরে যাবার জন্য, দারোয়ান তাকে জানায়, আরও ভয়াবহ দারোয়ান আছে সেখানে। যাদেরকে সে নিজেই ভীষণ ভয় করে। তাই ভেতর থেকে অনুমতি না এলে দারোয়ান তাকে ভেতরে যেতে দিতে পারেনি। দু’জনই অনুমতির জন্য অপেক্ষা করে; কিন্তু অনুমতির কোনো শব্দ আর ভেতর থেকে আসেনি। এই গল্পের সঙ্গে আমরা বুঝে যাই, কে’র শেষ পরিণতি কী হতে পারে। উপন্যাসের শেষে দেখা যায়, আদালত থেকে আসা দু’জন লোক কে’কে ধরে নিয়ে যায় এবং একটি বদ্ধ ভূমিতে নিয়ে তাকে মেরে ফেলে। গল্প শেষ হয় কিন্তু প্রচলিত আইন-কানুন, বিচার, আদালতের কার্যক্রম শেষ হয় না।

১৯২০-এর দিকে গল্পটি লেখা হলেও, ২০২১ সালেও আমরা আদালত, বিচার ইত্যাদির একইরকম কার্যক্রম চালিয়ে যেতে দেখি। বিশেষ করে টোটালিটেরিয়ান রাষ্ট্রে বাস্তবেই আমরা কে’র মতো এমন অনেক অসহায় মানুষকে দেখতে পাই, যারা অপরাধ না করেও আদালতের চোখে অপরাধী হয়ে শাস্তি ভোগ করে। বিচারের শীতল কঠিন দরজায় বারবার করাঘাত করেও ন্যায় বিচার পায় না। কাফকার এই উপন্যাস তাই চেকোস্লোভাকিয়া ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে পৌঁছে যায়। সময়কে অতিক্রম করে, সময়ের ঊর্ধ্বে চলে যায়। শুধু আদালতের ক্ষেত্রেই না, আমাদের দৈনন্দিন অনেক কার্যক্রমের মধ্যে আমরা কাফকার আদালতকে দেখতে পাই। যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের অপেক্ষায় রাখা হয়। সেটি অফিসের কোনো কাজ উদ্ধারের জন্য হোক অথবা যাত্রাপথের বিড়ম্বনাই হোক। কাফকার আদালত, আদালতের গণ্ডি ছাড়িয়ে আরও নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এসবকিছুর পরেও, কাফকা তার আরেক ছোট গল্প ‘উকিল’ এ আদালতের সেই কঠিন শীতল দরজা অতিক্রম করার জন্য চমৎকার আশার বাণী লিখে দেন, - ‘যদি এই বারান্দায় তুমি কিছুই না পাও, দরজা খোলো। সেখানেও কিছু না পেলে কোনো চিন্তা নেই। ওপরতলায় উঠতে শুরু কর। এইভাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি থামছো, সিঁড়িও থামবে না। তোমার উত্তরণশীল পায়ের নিচে সিঁড়ি, ক্রমেই ওপরের দিকে বাড়তে থাকবে।’ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //