‘আমিস’ ক্যানিব্যালিজম, সম্পর্কশাস্ত্র এবং ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণের দৃশ্যকাব্য

সিনে ডিস্টার্বিয়া : মনোজাগতিক অভিঘাতের সিনেমা 

‘আমিস’ একটি সিনেমা। অহমিয়া ভাষায় ‘আমিস’ সেটিই বাংলাদেশে যাকে ‘আমিষ’ বা প্রোটিন লিখি। মূলত প্রাণিজ প্রোটিন- ‘মিট’। গত বছর মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি দর্শক-সমালোচকদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলেছিল। এক দল বলছেন- ‘ওয়াক থু, নরমাংস ভক্ষণ নিয়ে এ কেমন সিনেমা?’ অনেকে আপত্তি তুলছেন- ‘এটি একটি মনোবিকৃতির সিনেমা। তা না হলে দু’জন অসমবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকা, তাও আবার নিষিদ্ধ প্রেম- সেখানে মাংস কীভাবে সম্পর্কের বীজ হয়ে থাকতে পারে? অবাস্তব, অরুচিকর!’ কেউ কেউ বলছেন- ‘সিনেমা বানানোর জন্য আর কোনো বিষয় পাওয়া গেল না?’

আবার আরেক দল সিনেমাটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। কারণ, ছবিটি আসামের। একে তো অহমিয়া চলচ্চিত্র, তার ওপর স্বল্প বাজেটের। মূলধারার সিনেমা বাজারে অহমিয়া একটি ব্রাত্য ধারা। ভারতের মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা বিশ্ববাজারের দামি বিনোদন-ভোগ্যপণ্য হলেও, আসামের সিনেমা মাত্র শৈশবকালে পড়েছে। দরিদ্র রাজ্য। নন্দনজগতেও দারিদ্র্যের নিত্য অনুষঙ্গ- ভালো গল্প-সংকট, বাজেট সংকট, প্রযুক্তি ও কৃৎকৌশলের সহজ জোগান না থাকা ইত্যাদি বহু কিছু। বোম্বের অনুরাগ কাশ্যপ প্রযোজনায় এগিয়ে না এলে বাজেট সংকটে পরিচালক ভাস্কর হাজারিকা হয়তো নির্মাণই করতে পারতেন না ছবিটি। তবুও সামাজিক ট্যাব্যু ভেঙে অসাধারণ সাহসী একটি গল্প বলা হয়েছে। গল্পটি বিকৃতিরও নয়, নরমাংস ভক্ষণেরও নয়। বরং ছবিটি প্রেমের। সুগভীর হৃদয়বৃত্তির। সবকিছু ছাড়িয়ে মানব-মানবীর সম্পর্কের গূঢ়গভীর মনোসমীক্ষণের। 

একান্তজনের সত্তায় অন্তর্লীন হয়ে পড়া ক্যানিব্যালিজম হতে যাবে কেন?

মানুষ কি নরমাংসভোজী হতে পারে? অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন- ‘আমিস’ সিনেমাটি ক্যানিব্যালিজমকে বৈধতাদানের কোনো চেষ্টা কি না? প্রেমিক প্রেমিকাকে, প্রেমিকা প্রেমিককে নিজেদের যার যার শরীরের মাংস রান্না করে খাইয়ে চলছে- এটি একটি বীভৎস বিষয় নয় কি? 

বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী মারভিন হ্যারিসের গবেষণায় ব্যাখ্যা আছে- কেন মুসলমানরা শূকরের মাংস খায় না। হিন্দুরাই বা কেন গরুর মাংস খায় না। বাস্তবের অসংখ্য উদাহরণ আছে মুসলমান ভুলে শূকরের মাংস খেয়ে বমি করতে করতে মরেছে। হিন্দুকে ভুলে গো-মাংস পরিবেশন করায় দাঙ্গা লেগেছে। মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। চীনারা সব খায়- এমন অনুসিদ্ধান্তের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কোরীয়রা কুকুর খায়- আমরা ভাবতেও পারি না। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের একটি বড় পাঠ আছে মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে। সেখানে মূল কথা হলো- মানুষের শরীরবৃত্তি অভিযোজন ব্যবস্থাটিই এমন যে, তাকে কোনো না কোনো আমিষ গ্রহণের উপযোগী হয়ে উঠতেই হবে। গো-মাংসভোজী যদি এমন পরিবেশে আটকা পড়েন যেখানে শুধুই ঘোড়ার মাংস আছে, প্রথম দিকে প্রতিক্রিয়া হলেও সহসাই তার শরীর ঘোড়ার মাংস ভক্ষণের অভিযোজনের দিকে যাবে। বাদুরপ্রধান এলাকায় আটকা পড়লে বাদুর খাওয়া একসময় শরীরে মানিয়ে যাবে। নৃবিজ্ঞানের সরল অনুধ্যান- আমিষ ছাড়া জীবন অচল করে দেওয়া কোয়াশিওকর রোগ হয়। তাই, মানুষের জন্য প্রোটিন গ্রহণের কোনোই বিকল্প নেই। আমিষ মানুষের লাগবেই।

সে অর্থে খুব প্রয়োজন পড়লে মানুষ নরমাংসভোজী হলেও হতে পারে। উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইস’ সিনেমায় এ রকম একটি অনুজ্ঞা দেখি আমরা। সত্যজিত রায়ের শেষ সিনেমার নাম ‘আগন্তুক’। সেই সিনেমায় উৎপল দত্তও নৃবিজ্ঞানী। ফলে ঘুরে ফিরেছেন বিচিত্র সব গোত্র ও কৌম সমাজে। খেয়েছেন বিচিত্র সব খাবার-দাবার। সেখানেও সবিশেষ প্রয়োজনে মানুষের ক্যানিব্যাল হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়- কথাটি এসেছে। হিন্দুর গো-মাংস বিষয়ে, বা মুসলমানের শূকর বিষয়ে যে রকম ধর্মীয় স্টিগমা, ক্যানিব্যালিজম প্রসঙ্গটিও আমাদের সে রকমই একটি স্টিগমা হয়ে থাকার কারণে ‘আমিস’ সিনেমাটি নিয়েও বিবমিষা অনুভূতির কমতি নেই।

প্রকৃতপক্ষে মানুষের ক্যানিব্যাল হওয়ার কোনোই প্রয়োজন পড়ে না। স্পেনীয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা মেক্সিকো এবং গুয়াতেমালার আজটেকদের মেরে কেটে সাফ করে তাদের সভ্যতা তছনছ করে দিয়েছিল। তারপর নিজেদের ইচ্ছে মতো ইতিহাস লিখেছিল- ‘আজটেকরা ছিল নরমাংসভোজী। জীবন্ত মানুষের বুক চিরে তাজা কলিজা বের করে খেয়ে ফেলত।’ নৃবিজ্ঞানীরা বললেন, খোঁড়া অজুহাত। আজটেক সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার পাপ ও অপরাধবোধ কাটাতে উপনিবেশবাদীরা আত্মপক্ষ সমর্থনে এই বানোয়াট অজুহাতটি তৈরি করেছিল।

এরিক উলফ লিখলেন, বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সন্স অব দ্য শেইকিং আর্থ’ বা কম্পমান ভূমির সন্তান-সন্ততিরা। লিখলেন- আজটেকরা ধন-সম্পদে এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে, বর্বর জাতিগুলো মুহুর্মুহু চেষ্টা চালাত আজটেক রাজ্য দখলের; কিন্তু আজটেকরাই জয়ী হতো। বিজয়ের উচ্ছ্বাসে-উল্লাসে আজটেক রাজপুরোহিত সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবন্দিটিকে পিরামিডের মতো উঁচু বেদির শীর্ষে নিয়ে যেত। উদ্দেশ্য- জীবন্ত যুদ্ধবন্দির বুক চিরে কলিজা টেনে ছিঁড়ে বের করে ফেলা এবং সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা। এই সময় ধূপ-ধূনা-মন্ত্রপাঠ ও গগণবিদারী ঢোল-বাদ্য কাড়া-নাকাড়ার শব্দে ভীতিকর ও ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হতো। রাজপুরোহিত কলিজার এক টুকরা কামড়েও খেত; কিন্তু সেগুলো মোটেই নরমাংস ভক্ষণের উৎসব ছিল না। ছিল জমজমাট প্রদর্শনী। শত্রুপক্ষকে ভয় দেখানোই থাকত এসব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য। শত্রুদের বুঝিয়ে দেওয়া- ধরা পড়েছ কী মরেছ! দেখ, আমরা কী রকম হিংস্র ও নৃশংস হতে পারি। সুতরাং, আর কখনো আজটেক রাজ্য দখলের দুঃসাহস দেখিও না বাছারা!’

‘আমিস’ সিনেমাটি কি এরকম কোনো ভয় দেখানোর জন্য? কিংবা ক্যানিব্যালিজমই প্রতিপাদ্য কি? যদি সেসব না হয় নৃবিজ্ঞান টানা কেন? সিনেমাটি ভয় দেখানোর জন্যও নয়। ক্যানিব্যালিজমও প্রতিপাদ্য নয়। সিনেমাটি নর-নারীর স্বাভাবিক সম্পর্কের সুগভীর মনোদৈহিক সামাজিক জটিলতায় নতুন করে আলো ফেলার জন্যই নির্মিত। যেন ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণের অসাধারণ নতুন ব্যঞ্জনা তুলে ধরার জন্যই নিবেদিত। এখানে নৃবিজ্ঞান টানার কারণ- মূল পুরুষ চরিত্রটিই একজন নৃবিজ্ঞানের পিএইচডি গবেষকের। তার গবেষণার বিষয়ও মানুষের শরীর বিভিন্ন প্রাণীজ প্রোটিন গ্রহণে কীভাবে প্রতিক্রিয়া করে- গভীরভাবে সেই অনুসন্ধান চালানো। প্রটাগনিস্ট নিজেই আমিষাশী। বিচিত্র ধরনের আমিষ সেইসব আমিষভোজী গোত্রের মানুষদের মতো রান্না করে খাওয়ার চর্চা করা তার গবেষণার পেশাদারিত্বেরও অংশ। নিজে আমিষ ক্লাবের সদস্য। তার বিভাগে আমিষ পরীক্ষার ল্যাবও আছে। তাই প্রাণীর শরীরের ছোট্ট একটি টুকরা ল্যাবরেটরির পরীক্ষণের জন্য কেটে নেওয়া যেমন সহজ কাজ তার জন্য, নিজের শরীর হতেও অর্ধেকটি বিস্কুটের সমান মাংসের টুকরা অন্য সহ-গবেষককে দিয়ে কাটিয়ে নিতে পারাও কঠিন কাজ নয়।

প্রশ্ন থেকে যায়- এমনটি কেন করতে হলো তাকে? সেই উত্তর পেতে বরং গল্পে ফেরা যাক।

নৃবিজ্ঞানের পিএইচডি গবেষক গভীর প্রেমে পড়েছে একজন নারীর। নারীটি বয়সে তার চেয়ে বড়। তদুপরি বিবাহিতা। একটি কন্যা সন্তানের জননী। পেশায় শিশুচিকিৎসক। শহরে নাম-যশও আছে। সেই নারীটিও যুবকটির মাঝেই খুঁজে পেয়েছে তার হৃৎজোড়। কৌতুহলবশত নারীটি যুবকের রান্না করা বিচিত্র আমিষ খাবার চেখে দেখতে দেখতে একই রকম আমিষাশী হয়ে পড়ে। যুবক সোৎসাহে ভালোবাসার মানুষটির জন্য নিত্যনতুন আমিষ রান্না করে রাখে। টিফিন ক্যারিয়ারে দু’জনেই রান্না করা মাংস বিনিময় করে। সে এক বিচিত্র আমিষভোজ-নির্ভর পরস্পর-নির্ভরতা। তবুও দু’জনের সম্পর্কটি রয়ে যায় প্লেটনিক। 

শরীরি সম্পর্ক হতে দূরে থাকার সতর্কতার কমতি নেই কারও। দু’জনের কেউই বিস্মৃত নন নারীটির সমাজ-সংসার-স্বামী-সন্তান সামাজিক মূল্যবোধের সুকঠিন দেয়াল হয়ে তাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সেই দেয়াল ভাঙতেও চায় না দু’জনের কেউই। ফলাফল- সব প্রেমানুভূতি ও একাত্মবোধের অবদমন। দু’জনেরই। দুই প্রান্তেই। যুবকের সব স্বপ্ন, সত্তা ও অস্তিত্বজুড়ে বিস্তৃত হয়ে পড়ে নারীটি। অবদমনের সুকঠিন চাপ তার স্বপ্নঘোরময়তা ও হ্যালুসিনেশনে রূপ নেয়। যুবক স্বপ্নালু তন্ময়তা অথবা আচ্ছন্নতার ঘোরে অনুভব করে যে সে নারীটির দেহাতীত অস্তিত্বের গভীরে বিলীন ও অন্তর্লীন হয়ে যাচ্ছে। এই তমসাঘোর, এই অবসেশনে সে উপায় খুঁজতে থাকে, যাতে সে যে কোনোভাবেই হোক প্রিয়তম নারীর সত্তার ও অস্তিত্বের গভীরে আমৃত্যু চিরস্থায়ী জায়গা করে নিতে পারে। তাহলে উপায়? নিজের শরীরের ছোট্ট এক টুকরা মাংস সহযোগে রান্না একটি ডিশ প্রেমিকাকে খেতে দেওয়াই আপাতত সেরা উপায়। সে তেমনটি করেও বসে। ফলাফল- সে প্রিয় মানুষটির শরীরের অংশ হয়ে যেতে থাকে। 

তারপর গল্প ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোবে জানা কথা। প্রেমিকা যখনই জানল রান্না করা প্রেমিকের মাংসই খেয়েছে, তার গভীর অস্বস্তি ও বিবমিষা হলো। একজন সুস্থ মানুষের যে রকম অসুস্থ শারীরিক প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা সেরকমই হল। কিন্তু সম্পর্কটির সমাপ্তি ঘটল না। কারণ, সম্পর্কটি আত্মিক। নিত্যদিনের মতোই প্রেমিকাও তার রান্না করা খাবার বিনিময় করে যেতে থাকল প্রেমিকের সঙ্গে। প্রেমিক বুঝল না প্রেমিকাও ঠিক একই কাণ্ড করে চলেছে। প্রেমিকের মতোই নিজের শরীরের মাংসের রান্না পাঠিয়ে চলেছে। প্রেমিক যেদিন জানল সেদিন তারও গভীর অস্বস্তি ও বিবমিষা হলো। তার বেলায়ও একজন সুস্থ মানুষের যে রকম অসুস্থ শারীরিক প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা সে রকমই হলো। ইতিমধ্যে দুই একান্তজনই পরস্পরের শরীরের অংশ হয়ে গেল খাবার হয়ে। দু’জনের শরীরের ভেতর মিশে গেল দু’জনের শরীর। সুফিরা যেমন আত্মায় অন্তর্লীন হয়ে দুই শরীরি সত্তার এক হয়ে যাওয়ার কথা বলেন, সে রকমই এক অদ্ভুত একাত্মতার গল্প দেখাল ‘আমিস’ সিনেমাটি। ঠিক কোনো অর্থেই এই দার্শনিক একাত্মতাকে ক্যানিব্যালিজম বলা সম্ভব কি? কিংবা উচিত কি? উত্তর- না।

এই গল্প দুর্বলচিত্তের দর্শকদের জন্য অস্বস্তিকর হওয়া স্বাভাবিক। প্রথাগত গল্পপ্রধান বা বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রের দর্শকরাও হতাশ হবেন সন্দেহ নেই; কিন্তু যারা সিনেমার গল্পে দর্শন এবং দর্শন প্রদর্শনের মুন্সিয়ানার অনুসন্ধানী- তাদের কাছে মনে হতে পারে, ফ্রয়েডীয় দর্শনে উল্লিখিত ড্রিম, অবসেশন, সাপ্রেশন, রিপ্রেশন এবং ডেভিয়েশনের এ রকম নান্দনিক প্রকাশ সম্ভবত আগে আর কোনো সিনেমায় এতটা শক্তিমত্তার সঙ্গে দৃশ্যবন্দি করা যায়নি।

 অবসেশন, সাপ্রেশন, রিপ্রেশন, ড্রিম, ডেভিয়েশন

‘আমিস’ সিনেমার ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণের যে রকম অসাধারণ প্রয়োগ ঘটেছে, সে রকমটি চলচ্চিত্রে বিরল। এ রকম মনে হওয়ার কারণ আছে। ফ্রয়েড নিজে মনোসমীক্ষণ-নির্ভর সিনেমা বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। পারেননি। ১৯২৮ সালে ফ্রয়েডীয় ‘ড্রিমস্কেইপ’ বা ‘স্বপ্নজগৎ’কে উপজীব্য করে লুই বুনুয়েল বানালেন ‘উঁ শি্যঁ আন্নাল্যু’। ছবিটি হয়ে পড়ল স্যুররিয়াল সিনেমা। আলফ্রেড হিচকক ১৯৪৫ সালে বানালেন মুভি-মাস্টারপিস ‘স্পেলবাউন্ড’। তাতে আবার সালভাদর দালির শিল্পকর্মের ব্যাপক মন্তাজ যুক্ত করায় সিনেমাটি শিল্পকর্ম-প্রধান হয়ে পড়ল। গল্প হয়ে পড়ল গৌণ। অ্যামনেসিয়াক গ্রেগরি পেকের স্মৃতিবিলোপ-ভ্রমযুক্ত চরিত্রটিতে ফ্রয়েডীয় অচেতন, অবচেতন ব্যাখ্যার চেষ্টা থাকলেও ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণকে ‘স্পেলবাউন্ড’ সিনেমাটি সঠিকভাবে ধরতেও সক্ষম হয়নি।

জ্যঁ পল সার্ত্রে ১৯৬২ সালে ‘দ্য সিক্রেট প্যাশন’ নামে একটি চিত্রনাট্য লেখেন। পরিচালনায় ছিলেন জন হাস্টন; কিন্তু হাস্টন ও সার্ত্রে বিবাদে লিপ্ত হলেন। সার্ত্রে বললেন ফ্রয়েডকে না এনে হাস্টন নিজের সাইকোঅ্যানালাইসিস প্রকল্প এনেছেন সিনেমায়। প্রতিবাদে ক্রেডিট লাইন হতে নিজের নামও প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণকে ঠিকমতো ধরতে না পারার অভিযোগ হতে মুক্ত হতে পারেনি ‘দ্য সায়েন্স অব স্লিপ’, ‘ব্ল্যাক সোয়ান’, ‘অ্যা ক্লকওয়াইজ অরেঞ্জ’, ‘অ্যানি হল’, ‘ইটারনাল সানশাইন অব স্পটলেস মাইন্ড’ এর মতো আলোড়ন জাগানো সিনেমাগুলোও।

‘আমিস’ আলোচনা প্রসঙ্গে বলতে হয়- ছবিটির শক্তির মূলেই রয়েছে ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণকে চমৎকারভাবে ধরতে পারার মতো অত্যন্ত সহজ একটি গল্প। গল্পের শুরুটি আমাদের চিরচেনা চারপাশের নিত্য ঘটে যাওয়া সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কের বিন্যাসে বিন্যস্ত। তারপর? প্রেমে আচ্ছন্ন (অবসেশন) থাকাও বাস্তবতাই। সামাজিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কারণে ইচ্ছা, কামনা-বাসনা, অনুভব-অনুভূতির প্রকাশ না ঘটিয়ে অবদমিত করে রাখার যে মানসিক চাপ (সাপ্রেশন ও রিপ্রেশন), তা আচ্ছন্নতাকে যে আরও বাড়াতে পারে, সেই আলাপটিও ফ্রয়েড আগেই করে গেছেন। পরিণতিতে ফ্রয়েডীয় ‘অচেতন’ (আনকনশাস) ও ‘অবচেতন’ (সাবকনশাস)-এর যৌথ-প্রতিক্রিয়া যে স্বপ্নঘোরময়তা (ড্রিমস্কেইপ, হ্যালুসিনেশন) তৈরি করতেই পারে, তাও তো ফ্রয়েডীয় অনুধ্যানই।

সমাজবিজ্ঞানে সামজিক অসঙ্গতি ব্যাখ্যার একটি চিরচেনা ফ্রয়েডীয় মডেল হলো- ‘সাপ্রেশন টু ডেভিয়েশন’। যত বেশি অবদমন, তত বেশি কুপথগমন। ‘আমিস’ সিনেমায় সেটিই দেখানো হলো- পরস্পরকে পাওয়ার অন্তহীন আকুলতাকে সামাজিক নৈতিকতা দিয়ে দাবিয়ে রেখে দু’জনেই বেপথু হয়ে পড়ল। অন্যদের জন্য ক্ষত ও ক্ষতির কারণ হওয়ার বদলে নিজেরাই ভাগাভাগি করে নিতে থাকল আত্মবিধ্বংসী ক্ষত ও ক্ষতি।

মেটাফোর ও জেন্ডার-সম্পর্ক

নির্মলীর আরও মাংস চায়, শেষ দিনের মতো নির্মলীর আরও মাংস চায়। এই দৃশ্যটি ছিল একটি বিশুদ্ধ মেটাফোর। আসলে সুমনকেই চাওয়ার আকুতি। আরও গভীরভাবে, একান্তভাবে পাওয়ার আকুলতা; কিন্তু সামাজিক অনুশাসনের বাধার তীব্র মানসিক চাপে উদভ্রান্ত হয়ে পড়া নির্মালির চোখে-মুখে তার প্রকাশ ঘটেছে ‘আরও মাংস চাই’ অনুভূতির রূপকে। সুমন তখনো দায়িত্ববিস্মৃত নয়। এই দুঃসহ অবস্থায় নির্মলীকে সে-ই টেনে এনেছে। তাই এই যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটানোর দায়িত্বও তারই। পরিণতি একটি রক্ত হিম করা খুন এবং মাংস কর্তনরত সুমনের পুলিশের হাতে ধরা পড়া। নির্মলীর গ্রেফতার হওয়া।

মুখ ঢাকা দু’জন আসামিকে আনা হয় সাংবাদিক দঙ্গলের সামনে। এর আগে সুমন কতবার ভেবেছে নির্মলীর হাতে হাত রাখবে; কিন্তু একটি আঙুল ছুঁতে গিয়েও ছোঁয়নি সমাজ-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চাপে। আজ দু’জন মুখ ঢাকা আসামি- নির্ভয়, নিঃশঙ্ক। গভীর নির্ভরতায় ও প্রেমে অতীতের সব সংস্কারের অবদমনের চাপকে ঝেড়ে ফেলে একজন হাত রাখে অন্যজনের হাতে। ছবির সমাপ্তি ঘটে। মানব-মানবীর সম্পর্কশাস্ত্রকে উপজীব্য করে এমন হৃদয়গ্রাহী ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণের দৃশ্যকাব্য গত দু’চার দশকে দেখার সুযোগ হয়নি চলচ্চিত্র দর্শকদের। সেই অর্থে ছবিটি অনন্য। 

জেন্ডার মেটাফোরে ভরপুর ছবিটি। ছবির শেষ দৃশ্যেই টিভিতে ও মিডিয়ায় আলোচনা- এই প্রথম ‘নারী নরমাংসভোজীর’ সন্ধান মিলেছে ভারতে। ‘প্রথম’, এবং ‘নারী মাংসভোজী’ শব্দ দুটিতেই জ্বলজ্বলা পুরুষতন্ত্রকে হাজির করা হয় ‘আমিস’ সিনেমায়। স্বামীর সঙ্গে নির্মলীর শীতল দাম্পত্য-সম্পর্কের মেটাফোর আনা হয়েছে টেবিলভর্তি আমিষবিহীন সবজি ছড়াছড়ির মাধ্যমে। নির্মলীর উষ্ণতা-কামনার মেটাফোর এক মিনিটের জন্য উঠে যাওয়া এবং আড়ালে গিয়ে গোগ্রাসে মাংস খাওয়া। স্বামীর অবাক হয়ে চেয়ে দেখায়ও নির্মলী তখন আর বিব্রত নয়।

সম্পর্ক-শীতলতার আরেক মেটাফোর সুমনের হিমায়িত মাংসবিরোধী আন্দোলন। এই মেটাফোরে প্রকাশ ঘটেছে যে বিশ্বায়ন মানুষের সম্পর্ককে, স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক জৈবিক সম্পর্ককেও সুপার শপে হিমায়িত মাংসের মতো শীতল করে তুলছে। নির্মলীর দাম্পত্য-শীতলতার শুরুর ইঙ্গিত দেওয়া হয় এই মেটাফোরের মাধ্যমে। নির্মলীর স্বামীর বন্ধুরা আড্ডায় যখন শুধু তার স্বামীকেই পেশাগত উন্নতির জন্য বাহবা দেয়, নির্মলীর ফাঁপা প্রশংসায় উচ্চারণ করে- ‘প্রত্যেক পুরুষের উন্নতির পেছনে থাকে একজন নারী’- এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নির্মলীর মতো উচ্চশিক্ষিতা ও সুপ্রতিষ্ঠিতা চিকিৎসককেও গৃহবধূর অধিক সম্মান দিচ্ছে না পুরুষতন্ত্র। নির্মলীও যে সমভাবেই প্রতিষ্ঠিত, এই সত্যের অপলাপ, অস্বীকার ও নেতিকরণ স্পষ্ট এখানেও। আরও মেটাফোর আছে। আলোচনা সীমিত রাখতে এখানেই থামা বাঞ্ছনীয়।

সিনেমা ভাবাতে পারে; কিন্তু কতটা? কালোত্তীর্ণ ও মানোত্তীর্ণ শিল্পকর্ম হয়েই বা ওঠতে পারে কতটা? ‘আমিস’ অবশ্যই নর-নারীর সম্পর্কশাস্ত্র ছিঁড়েখুঁড়ে দেখাতে পারার মতো একটি চিন্তা-উত্তেজক এবং কালোত্তীর্ণ ও মানোত্তীর্ণ ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণ বিশ্লেষণের দৃশ্যকাব্য। 


চলচ্চিত্র : আমিস (২০১৯)
ভাষা : অহমিয়া
পরিচালক : ভাস্কর হাজারিকা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : আমিস সিনেমা

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //