দেশের সংগীতের বাজার অপরিণত এখনো

গল্পটি এক যুগ আগের। এ শহরে এক তরুণ গায়িকা এসেছেন। তিনি নিজেই লিখেন, সুর করেন আর নিজেই সে গান কণ্ঠে তুলে নেন। বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত মহলে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে তার গানগুলো। তিনি মনস্থির করেন গানগুলোকে ছড়িয়ে দেবেন সবার মাঝে। কথা বললেন বাংলাদেশের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে; কিন্তু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মনপুত হলো না তার গানগুলো। কেননা তার গানগুলো নাকি গানের মতো না।

কারণ ওতে গতানুগতিক ফুল পাখি পাতার কথা নেই। আছে মানুষের কথা, সময়ের কথা, জীবনবোধের কথা। আজীবন স্বাধীনচেতা এই গায়িকা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি গানগুলো বাংলাদেশের মানুষকে শোনাবেনই। ততদিনে এগিয়ে এসেছে তার বন্ধু মহল। সবার এক কথা তোমার গান হবে। আমরা বাজারজাত করব তোমার গান। শুধু তার গান বাজারজাতের উদ্দেশ্যে জন্ম নিল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, আবার নতুন করে রেকর্ড করা হলো সব গান।


অবশেষে বাজারে এলো হার না মানা গায়িকাটির প্রথম অ্যালবাম। সেদিনের সেই স্বাধীনচেতা অপরাজেয় গায়িকার গান আজ দেশ-বিদেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের নিকট অতি সুপরিচিত। ভক্তদের অনেকে তাকে বাংলাদেশের নচিকেতা বলেও ডাকেন। তিনি সায়ান। নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কালো পোশাক পরা ছোট করে ছাঁটা চুলের অবয়বটি। যার হাতে গিটার আর গলায় ঝুলানো হারমোনিকা। 

সংগীতের শুরুটা তার শৈশব থেকে। সংগীত সায়ানের রক্তে ছিল বলাটাই উচিত। কেননা মা-বাবা উভয় পরিবারের মানুষেরই সংগীতের সঙ্গে ওঠাবসা। বিশেষ করে তার বাবার পরিবারের লোকজনতো এদেশের সংগীতাঙ্গন শাসন করে আসছেন। বাবা খসরু ওয়াহিদ ছিলেন কণ্ঠশিল্পী, চাচা ফেরদৌস ওয়াহিদ লিভিং লিজেন্ড, আর চাচাতো ভাই হাবিব ওয়াহিদতো গতানুগতিক বাংলা গানের মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছেন। অনেকের ধারণা সায়ান হয়তো বাবার দিক থেকে গানে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

তবে সায়ানের মতে এটা একদমই ভুল। বাবা চাচারা তাকে যতটুকু প্রভাবিত করেছেন, তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন সায়ানের মা। মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে পাঁচ বছর বয়স থেকে মায়ের কাছে বড় হন তিনি। এই সময়গুলোতে সায়ানকে জীবন অনেক কিছু শিখিয়েছে, অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়েছে। আর সে অভিজ্ঞতাই বদলে দিয়েছে সায়ানের গানের ধারা, বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে গানের কথায়। এটাকেই চাচা, চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে নিজের গানের তফাতের মূল কারণ হিসেবে দেখেন তিনি। সায়ানের মায়ের বাড়ির সবাই গান অনুরাগী ছিলেন। রাতে ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেই মামা, খালা, কাজিন সবাই মিলে শুরু করতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মুঙ্গেশকরের গান।

তাছাড়া সায়ান রাতে যখন ঘুমোতে যেতেন তখন তার মা গান শুনতেন, সঙ্গে গুন গুন করে গাইতেনও। মামা, খালা, মায়ের কণ্ঠে সেসব গান শুনতে শুনতেই সায়ানের গানের শুরু। এরপর প্রথম স্টেজ পারফর্মের সুযোগ আসে ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলে পড়াবস্থায়। পরিবেশন করেন খালাতো বোনের কাছে শিখে যাওয়া মন শুধু মন ছুঁয়েছে গানটি। ওটাই ছিল সায়ানের শেখা প্রথম গান। তার জীবনে একটি বড় ভূমিকা রাখে ক্লাস সেভেনে পড়াবস্থায় মায়ের নিকট থেকে পাওয়া একটি ক্যাসেট প্লেয়ার। ক্যাসেট পেয়ারটি পেয়ে সায়ানের গান শোনার পরিধি আরও বেড়ে যায়।


মাথায় ঢুকে পড়ে ক্যাসেট কেনার নেশা। শুনতে থাকেন লতা, হেমন্ত, ভুপেন হাজারিকাসহ বিখ্যাতসব শিল্পীদের গান। এ সময়ই সায়ান পরিচিত হন বাংলাদেশের কিংবদন্তি গায়িকা শাহনাজ রহমতুল্লাহর গানের সঙ্গে। শাহনাজ রহমতুল্লাহর গানগুলোকে তার নিকট যেন আশ্রয়ের মতো মনে হতে থাকে। এভাবে গানের সঙ্গে সখ্যতা করে যখন বেড়ে উঠছিলেন তখনও সায়ানের মনে হয়নি যে তিনি গান করবেন, তিনি কখনো গায়িকা হবেন।

প্রশ্ন থেকে যায় সায়ান কখন থেকে ভাবতে শুরু করেন তিনি শিল্পী হবেন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সায়ান তার সেই গল্পের ঝাঁপি খোলেন। ১৯৯৭ সালে সায়ান উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান কানাডায়। আইন পড়ার ইচ্ছে থাকলেও সময়ের দৈর্ঘের কথা ভেবে সায়ান ভর্তি হন মনোবিজ্ঞানে; কিন্তু প্রবাস জীবনেও মনটা তার পড়ে থাকত ঢাকায়, যে শহরে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর। ভীষণভাবে দেশকে অনুভব করতে থাকেন তিনি। সায়ানের পড়াশোনা শেষ হতে আর মাত্র এক সেমিস্টার বাকি; কিন্তু তর সইলো না সায়ানের। প্রবাসজীবনের অধ্যায়ে যবনিকা টেনে তিনি ফিরে এলেন সেই প্রিয় শহর ঢাকায়। কানাডায় পড়ার সময় সায়ানের পরিচয় ঘটে বব ডিলানসহ বিখ্যাত সব শিল্পীর গানের সঙ্গে। সায়ান খেয়াল করেন তাদের গানগুলোতে কথার বিস্তর বৈচিত্র্য রয়েছে। একেকটি গান যেন একেকটি গল্প। সেখানে আছে সময়ের কথা, আছে জীবনের কথা, আছে অধিকারের কথা।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে যে মেয়েটি (সায়ান) গান লেখা শুরু করেছিল এক গীতিকারের সাথে প্রেমে মত্ত বন্ধুকে কাছে রাখতে। কেননা মেয়েটির মনে হয়েছিল প্রেমিকের কারণে বন্ধুটি তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই হিংসায় পুড়ে নিজেও গান লেখা শুরু করেছিল মেয়েটি। তবে সেসব ছিল প্রেমের গান। বব ডিলানরা এবার সেই মেয়েটির গানের কথায় এক দারুণ বৈচিত্র্য এনে দেয়। সায়ানের গানে তখন উঠে আসতে থাকে প্রতিবাদ, অধিকার আর জীবনবোধের কথা।

বন্ধু-বান্ধবদের চেষ্টায় সায়ানের অ্যালবাম আলোর মুখ দেখলেও এবার বাধল নতুন বিপত্তি। বাজারজাত করা যাচ্ছিল না অ্যালবামটি। যে সব দোকানে সিডিগুলো দেওয়া হয়েছিল তারাও রাখতে অনীহা প্রকাশ করছিল। এসব প্রতিবন্ধকতা যখন সায়ানের গান নিয়ে তামাশা করছিল, সায়ানকে উপহাস করছিল, ঠিক তখনই সায়ান ডাক পান একুশে টেলিভিশন থেকে।


একুশে টিভিতে প্রিয় মানুষ আলিফ আলাউদ্দিনের উপস্থাপনায় এক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন সায়ান। এই একটা অনুষ্ঠানই সায়ানের শিল্পীজীবনে এনে দেয় আমূল পরিবর্তন। দুই ঘণ্টার সেই প্রোগ্রামটি চলতে থাকে সাড়ে তিন ঘন্টা পর্যন্ত। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে সায়ানের জীবনমুখী গান এখানেই সুখ ছিল একদিন, আমি তাজ্জব বনে যাই, রবীন্দ্র-নজরুল। একদিন যে কথাগুলোর জন্য সায়ান কাছের মানুষের কাছে বাহবা পেতেন, সেই গানের কথাগুলো এবার সারাদেশের মানুষের কাছে থেকে বাহবা এনে দিতে থাকে তাকে। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

এসব নিয়ে কণ্ঠশিল্পী সায়ানের সঙ্গে কথা বলার শেষের দিকে আরেকটি প্রশ্ন করব বলতেই সায়ান প্রশ্ন করেন ‘কালো জামা?’ শুধু কালো জামা না, সায়ানের প্রসাধনীর প্রলেপ না মাখা চেহারা, ছোট করে ছাঁটা কাঁচা-পাকা চুল, কালো পুরুষালী পোশাক দেখে অনেকেরই কৌতূহল জাগে, মানুষ ভাবে সায়ান হয়তো পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই বেছে নিয়েছেন এমন বেশ! তবে সায়ানের উত্তর একেবারেই ভিন্ন।

তার এই প্রসাধনী বিহীন চেহারার কারণ হলো, তিনি কখনোই মেকি রঙে নিজের আসল রূপ আড়াল করতে চান না। আর শার্ট-প্যান্ট ও ছোট চুল তার সময় বাঁচায়। শাড়ি গয়না কিংবা অন্য কোনো মেয়েলি পোশাকে তৈরি হতে একটি মেয়ের যেখানে লাগে আড়াই ঘণ্টা আর সায়ানের সেখানে লাগে মাত্র আড়াই মিনিট। এতে সময় নষ্ট হয় না, তাছাড়া তিনি কমফোর্ট ফিলও করেন। আর কালো জামা? ওটা বেছে নেওয়ার কারণ ভালো লাগা থেকে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //