রুপালি গিটারের জাদুকর: শুরুটা গোল্ডেন বয়েজের মাধ্যমে

১৯৬২ সালে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জন্ম নেন আইয়ুব বাচ্চু। গান ও গিটারের সাথে সখ্য ছোটবেলা থেকেই। গোল্ডেন বয়েজ ও স্পাইডার নামে দুটি ব্যান্ড গঠন করেছিলেন তিনি। সেই ব্যান্ড নিয়ে সেসময় বিয়েবাড়ি, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বেড়াতেন। 

দীর্ঘদিন এভাবেই গান গাইতে গাইতে যোগ দেন দেশের বিখ্যাত ব্যান্ড সোলসে। তবে গায়ক হিসেবে নয়, সোলসে যোগ দেন গিটারিস্ট হিসেবে। 

গিটারিস্ট থেকে গায়ক

গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু কীভাবে গায়ক হয়ে গেলেন, এ বিষয়ে কথা হয় তার প্রথম মৌলিক গান রচয়িতা ও এলআরবির প্রথম গানের রচিয়তা বরেণ্য গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জংগীর সাথে। শহীদ মাহমুদ জংগী তখন আড্ডা দিতেন চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে। সেসময় একটি সংগঠন ছিল সৈকতচারী। সৈকতচারী নামের এই সংগঠনটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মৌলিক গান নিয়ে প্রথম দলগতভাবে কাজ শুরু করে। সৈকতচারীর সদস্যদের সঙ্গেই শিল্পকলা একাডেমিতে সময় কটাতেন গীতিকার শহীদ মাহমুদ। 

তার ভাষ্যমতে, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে আড্ডা দেয়ার সময় একদিন সম্ভবত কুমার বিশ্বজিতের সাথে ঝাকড়া চুলের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এক ছেলে আসে তার কাছে। নাম জানতে চাইলে সে জানায় তার নাম আইয়ুব বাচ্চু। সে পড়ালেখার পাশাপাশি গান করে।  জংগীর নিকট আবদার তাকে একটি গান লিখে দিতে হবে তিনি সেই গান সুর করবেন। জংগীর মতে, সে এমনভাবে আবদার করত, যা ছিল হৃদয়স্পর্শ করার মতো, ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব ছিল না; কিন্তু গান তিনি কিসে লিখে দেবেন? আশপাশে তখন কাগজ-কলমও ছিল না। মুহূর্তের মধ্যেই কোথা থেকে যেন ঝাকড়া চুলের সেই ক্ষ্যাপাটে ছেলেটি কাগজ কলমও এনে দিল। 

সাথে সাথে জংগী লিখে ফেললেন আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম মৌলিক গান, হারানো বিকেলের গল্প বলি, সাগর তীর ধরে এগিয়ে চলি, কাশবন পেছনে ফেলে। সেদিন থেকেই যেন গিটারের সাথে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে সুর তুলেছিল আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠও, যা পরবর্তীতে ছড়িয়ে যায় বাংলাদেশের কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর কণ্ঠে, যা হয়ে ওঠে এদেশের সংগীত পিপাসুদের প্রিয় কণ্ঠ। 

জার্নিটা এত মসৃণ ছিল না

তার জার্নিটা কিন্তু খুব মসৃণ ছিল না, এত ফুল বিছানো ছিল না। নিজের মৌলিক গান তৈরি করলেও তখনো কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু গায়ক নন গিটারিস্ট হিসেবে বাজাচ্ছেন সোলসে। সোলসের ভোকাল ছিলেন তখন বাংলাদেশের আরেক কিংবদন্তি গায়ক তপন চৌধুরী। সফট রোমান্টিক গানভিত্তিক ব্যান্ড সোলসজুড়ে তখন গায়ক হিসেবে শুধুই ছিলেন তপন চৌধুরী। কিন্তু তাই বলে তিনি থেমে থাকেননি। নিজের মতো সুর করে যাচ্ছিলেন, গান তৈরি করছিলেন। সোলসে থাকা অবস্থাতেই আইয়ুব বাচ্চু রক্তগোলাপ ও ময়না শিরোনামের দুটি একক অ্যালবাম বাজারে আনেন। তবে তার সেই গানগুলো সোলসের মতো ছিল না। অনবরত এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছিলেন বাচ্চু। এই এক্সপেরিমেন্টটা ছিল গতানুগতিক থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু করে দেখানোর এক্সপেরিমেন্ট। 

ঠিক সেসময় একদিন ভাগ্য দেবতা যেন বর নিয়ে আসেন তার জন্য। সেসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি ব্যান্ড সংগীতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। সেখানে গান করবে দেশের বড় বড় সব ব্যান্ড। সোলসও ডাক পেয়েছে সেখানে। আর এখানেই বাধে বিপত্তি। সোলসের সবাই আছেন কিন্তু ভোকাল তপন চৌধুরী তখন অনুপস্থিত।

আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হয় বিটিভিতে সোলসের ভোকাল হিসেবে গান করবেন আইয়ুব বাচ্চু; কিন্তু বাচ্চুতো রকার, আর সোলসের গানগুলো সফট রোমান্টিক। শহীদ মাহমুদ জংগীর ভাষ্যমতে, তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আইয়ুব বাচ্চুর জন্য নতুন গান তৈরি করা হবে। সময় মাত্র একদিন। শহীদ মাহমুদ তার বেশ ক’বছর আগে কয়েকটি লাইন লিখেছিলেন। লাইনগুলো হলো, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে, মায়াবী সন্ধ্যা, চাঁদ জাগা একরাতে, একটি কিশোর ছেলে, একাকী স্বপ্ন দেখে হাসি আর গানে’। লাইনগুলো মনে ছিল আইয়ুব বাচ্চুর।

সেদিন বিটিভির অনুষ্ঠানে যোগদানের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে গাড়িতেই গানটি শহীদ মাহমুদ জংগীকে লিখে দিতে বলেন আইয়ুব বাচ্চু। জংগী লিখতে থাকেন আর বাচ্চু সুর করতে থাকেন। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় নতুন গান একদিন ঘুম ভাঙা শহরে। পরদিন বিটিভিতে সোলসের হয়ে এই গানটি পরিবেশন করেন আইয়ুব বাচ্চু। এই গানটিই প্রথম বড় ফ্রেমে আইয়ুব বাচ্চুকে পরিচিতি এনে দেয় গায়ক হিসেবে। 

ঘুম ভাঙা শহরে এলআরবি ও আইয়ুব বাচ্চু

পরবর্তীতে আইয়ুব বাচ্চু সোলস ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ঘুম ভাঙা শহরে গানটি চেয়ে নিয়ে যান। আর এই গান দিয়েই তিনি শুরু করেন তার নতুন যাত্রা, গড়ে তোলেন নিজস্ব ব্যান্ড এলআরবি। এরপর প্রকাশ করেন এলআরবির প্রথম অ্যালবাম এলআরবি। দেশের সংগীতে শুরু হয় নতুন বিপ্লব। ভাটির দেশের ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ও আধুনিক গান শোনা শ্রোতাদের মস্তিষ্ক জোয়ারের মতো দখল করে নেয় গিটারের ঝংকার আর পাশ্চাত্য রক ধাঁচের বাংলা গান। 

১৯৯৫ সালটি ছিল আইয়ুব বাচ্চুর ক্যারিয়ারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সে বছরই তিনি বাজারে আনেন তার তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এই অ্যালবামটি বাজারে আসার সাথে সাথে তুমূল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। এই অ্যালবামের আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, অবাক হৃদয়, কষ্ট কাকে বলে, আমিও মানুষ গানগুলো জলোচ্ছ্বাসের মতো গ্রাস করে নেয় এদেশের তরুণদের। 

এই অ্যালবামটি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, এটিকে সর্বকালের সেরা অ্যালবাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই গায়ককে। সেই সঙ্গে তার জনপ্রিয়তাও প্রসারিত হতে হতে ছড়িয়ে যায় দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //