জয়তু রুনা লায়লা

গল্পটা স্বাধীনতার আগের। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি তখনো। সে সময় ঢাকার ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে। সব ঠিকঠাক থাকলেও গোলটা বাঁধে অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে। যে কণ্ঠশিল্পীর গান গাওয়ার কথা, তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারবেন না। আকস্মাৎ এমন খবরে আয়োজকদের তো মাথায় হাত! হল ভর্তি দর্শক অথচ শিল্পী আসবে না! এ যাত্রায় বুঝি আর রক্ষে নেই! 

অমন পরিস্থিতির কবল থেকে রক্ষা পেতেই সে সময় অসুস্থ কণ্ঠশিল্পীর ছোট বোনকে ঠেলে দেওয়া হয় মঞ্চে; কিন্তু এ তো ছয় বছরের এক বাচ্চা! ওর চেয়ে তো তানপুরাই বড়। আয়োজকদের দুশ্চিন্তা যায় না। মেয়েটি ততক্ষণে তানপুরায় হাত রেখে কণ্ঠে মেলে ধরেছে ক্ল্যাসিক্যাল রাগ। মুহূর্তেই দর্শকসারিতে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। অনুষ্ঠানের পুরোটা সময়জুড়েই ছোট্ট মেয়েটির কণ্ঠের জাদু সবাইকে যেন মোহাচ্ছন্ন করে রাখল। 

গান শেষ হতেই তুমুল করতালি আর অ্যাওয়ার্ড ও ক্যাশপ্রাইজে ভরে গেল ছোট্ট মেয়েটির দুটি হাত। সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটিই আজকের উপমহাদেশ কাঁপানো কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা। কণ্ঠ দিয়ে যিনি শাসন করেছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়, একটি নয় দুটি নয় তিন তিনটি ভূখণ্ড! 

উপমহাদেশের এই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সিলেটে জন্ম নিলেও বাবা সরকারি চাকুরে হওয়ার সুবাদে চলে যেতে হয় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। এরপর শৈশব, কৈশোর ও পেশাদার সংগীতশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ারের গোড়াপত্তন সেখানেই। গানের সাথে রুনা লায়লার পথচলা সেই ছোট বয়স থেকেই। বড় বোন দীনা লায়লাকে গান শেখাতে আসতেন গানের শিক্ষক। বড় বোনের পাশে ছোট রুনা লায়লাও বসে যেতেন, কণ্ঠে তুলে নিতেন সারেগামা। ছোট্ট রুনা লায়লার কণ্ঠে সেই সারেগামা শুনেই বড় বোনের গানের শিক্ষক হয়তো বুঝেছিলেন এই কণ্ঠ একদিন এ উপমহাদেশ শাসন করবে। সে কারণেই হয়তো রুনা লায়লার মা-বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তাকেও গানে দেয়ার জন্য। 


পেশাদার শিল্পী হিসেবেও রুনা লায়লার যাত্রা খুব কম বয়সে। পাকিস্তানের জুগনু নামক চলচ্চিত্রের একটি গানে কণ্ঠদানের মাধ্যমে সংগীতে অভিষেক ঘটে তার। সেসময় তার বয়স মাত্র ১২ বছর; কিন্তু ওই অল্প বয়সেই তার কণ্ঠে সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সংগীতজ্ঞরা। ফলে সিনেমার গানে নিয়মিত হয়ে যান তিনি এবং অল্প সময়েই পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রোতাপ্রিয় গায়িকায় পরিণত হন। 

স্বাধীনতা পরপর রুনা লায়লা যখন বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন তিনি পাকিস্তানে ক্যারিয়ারের তুঙ্গে অবস্থান করছেন। খোদ পাকিস্তান সরকারও তাকে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টায় রত থাকলেও নাড়ির টান পেয়ে বসেছিল রুনা লায়লাকে। আর তাইতো জনপ্রিয়তা, ক্যারিয়ার, সম্মান সব তুচ্ছ করে ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। দেশে এসেই প্রথম কণ্ঠ দেন সত্য সাহা পরিচালিত সিনেমার গানে। 

তারপর তো শুধু ইতিহাস, শুধু জয়ের গল্প। এককথায় বলতে গেলে তার ক্যারিয়ারজুড়েই ছিল শুধু সাফল্যের ভিড়বাট্টা। দামা দাম মাস্ক কালান্দার থেকে শুরু করে ওকি গাড়িয়াল ভাই সর্বত্র এক অপার মুগ্ধতা ছড়িয়ে গিয়েছেন এই গায়িকা। আর এই মুগ্ধতাই তাকে নিয়ে গিয়েছে সাফল্যের এতটা উঁচুতে, যতটা উঁচুতে রয়েছেন শুধুই রুনা লায়লা। বাকিদের সৌভাগ্য হয়নি সাফল্যের অতটা উঁচু চূড়া ছুঁয়ে দেখার।

মাত্র ৬ বছর বয়সে কণ্ঠের যে মায়াজাল তিনি বিছিয়েছিলেন, ঢাকার ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশনে পরবর্তীতে সেই মায়াজালের আগ্রাসন শুরু হয় করাচি থেকে, যার বিস্তৃতি ছিল একটি নয়, দুটি নয়, তিন-তিনটি ভূখণ্ড তথা পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ভারতজুড়ে। পৃথিবীর এমন কোনো বড় শহর নেই, যা তার কণ্ঠের আলোয় আলোকিত হয়নি। কি গাননি তিনি? 

বাংলা, উর্দু, হিন্দিসহ ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারেরও অধিক গান করেছেন, যার গান শুনে অতি বিচক্ষণ ঘোর সমালোচকও বনে গিয়েছে তার ভক্ত। তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল ভারতে।


ভারতের ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক খুশবন্তসিং ছিলেন রুনা লায়লার ঘোর সমালোচক। তিনি রুনা লায়লার প্রশংসাতো করতেনই না বরং সমালোচনা করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। তিনি একবার এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন রুনা লায়লার গান শুনতে। এর আগে সামনে থেকে রুনা লায়লার গান না শোনা সম্পাদক লোকটি তার গান ও নাচে সেদিন এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে পরের দিন খবরের কাগজে তিনি শিল্পীর অজস্র প্রশংসা করার সঙ্গে সঙ্গে লিখে দিলেন রুনাকে দিয়ে দাও, বিনিময়ে ফারাক্কার সব পানি নিয়ে যাও। সম্পাদক সাহেবের এক লাইনই বলে দেয় কি মুগ্ধতা ছিল রুনা লায়লার জাদুকরী কণ্ঠের মায়াজালে। 

১৭ নভেম্বর এই কিংবদন্তি গায়িকার জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে এই কিংবদন্তির জন্য রইল ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //