সংগীতে ফিউশন কেন

সংগীতের বিকাশ লাভের পথে একেক সময়ে একেক বিষয় হয়ে উঠেছে তাৎপর্যপূর্ণ। তেমনই এক বিষয় ‘ফিউশন’। আজ এই ফিউশন নিয়েই কিছু কথা বলব। প্রথমেই বলা যাক ফিউশন কী এবং কেন এই ব্যাপারে। ফিউশন শব্দটি ইংরেজি, যা ল্যাটিন শব্দ ফিউজিও Fusio থেকে এসেছে, যার অর্থ মেলানো, মেশানো বা গলানো। ব্যাপক অর্থে ভিন্ন দুটি সত্তাকে এক করে নতুন কোনো রূপদানকে ফিউশন বলা হয়।

সংগীতের ক্ষেত্রে ফিউশন বলতে বোঝায় দুই বা ততধিক ধারার সংগীতকে মিশিয়ে নতুন কোনো সাংগীতিক ধারা সৃষ্টি করা, যা অভূতপূর্ব বা যার প্রয়োগ পূর্বে কোথাও হয়নি বা কেউ করেননি। যেমন- Jazz-Rock fusion। জ্যাজ এবং রক মিউজিকের ফিউজিং এ জন্ম জ্যাজ-রক ফিউশনের। এটি সংগীতের একটি প্রকার। এই প্রকার সংগীতের উদ্ভব হয় ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে।

কাজী নজরুল ইসলাম।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য সেটি হলো- দুই বা ততধিক সাংগীতিক ধারার মিশেলটি এমন হতে হবে যেন মিশ্রণের পর তা এক স্বতন্ত্র্য ধারায় রূপ নেয় এবং সেটিকে আর তার পূর্বের অবস্থানে ফেরানো যাবে না। যেমন গসপেল gospel, কান্ট্রি country জ্যাজ jazz থেকে রক এন্ড রোল rock and roll এর সৃষ্টি। rock and roll বর্তমান সংগীত জগতের একটি প্রসিদ্ধ ও স্বতন্ত্র্য ধারা। যার রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা; কিন্তু এর থেকে জ্যাজ বা কান্ট্রিকে পৃথক করে আর আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। 

এবার আসা যাক ফিউশন কেন সেই প্রসঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়টির উত্তর সরাসরি প্রদান করা সম্ভব নয়, কেননা এইরকম বহু বিষয়ই কেন উদ্ভব হয়েছে বা সৃষ্টি হয়েছে তার সঠিক কারণ জানা নেই। বিবর্তনের তত্ত্বানুসারে মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই সৃষ্টিশীল। নতুনকে জানা, আবিষ্কার করা, অনুসন্ধান করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। চিরকাল মানুষ আবিষ্কারের নেশায় মত্ত। আর মানবজাতির এই স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য থেকেই সভ্যতা বিকাশ লাভ করে আজ এই পর্যায়ে এসে উন্নীত হয়েছে।

সংগীতও এই বিবর্তন তত্ত্বের মতোই। সংগীতও উৎপত্তির পর থেকে বিকাশ লাভ হতে হতে আজ এই পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। সংগীতের বিবর্তনের ইতিহাসে যুগে যুগে সংগীত গুণীরা তাদের নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তারা বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন এবং বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতি বিনিময় করেছেন।

ফলে একজন আরেকজনের সংগীত সম্বন্ধে অবহিত হয়েছেন। সৃজনশীল সংগীত গুণীরা অপরজনের সংগীতের উৎকৃষ্ট দিকগুলো গ্রহণ করেছেন এবং তার সঙ্গে নিজেদের সংগীতের উপাদানগুলোর মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এই প্রক্রিয়াতেই সংগীতের বিভিন্ন প্রকারের সৃষ্টি। আর এই ধারাবাহিকতাতেই জন্ম নেয় ফিউশন মিউজিক। 

‘ফিউশন’ এই টার্মটি ইদানীংকালের হলেও মূলত এর প্রয়োগ নতুন কিছু নয়। বহু শতক পুরনো। সংগীতের প্রত্যেকটি ধাপের একেকটি বিকাশ লাভ কে-ই আমরা ফিউশন বলতে পারি। কারণ প্রত্যেকটি পরিবর্তনই সংগীতের একেকটি নতুন রূপ। আর লেখার শুরুতেই আমি বলেছি ফিউশন মানেই দুই বা ততধিক রূপ এর মিশ্রণে যে নতুন রূপ পায় তাকে বোঝায়।

উস্তাদ নিয়াজ মুহাম্মদ চৌধুরী

সেই হিসেবে তো বলা যায় ধ্রুপদ থেকে যখন খেয়াল এলো এবং খেয়াল থেকে যখন এলো ঠুমরি, সেটা ছিল তখনকার দিনের জন্য ফিউশন। ঠুমরি থেকে এই যে বিকাশ শুরু হলো, তারপর পঞ্চকবি হয়ে, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার-পুলক বন্দোপাধ্যায় হয়ে, আমাদের আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান হয়ে এই যে আজকের দিনে এসে হাজির হলো। 

আমাদের এই উপমহাদেশে এবং বহির্বিশ্বে যে ক’জন শিল্পী ফিউশন সংগীত পরিবেশন করেছেন তাঁরা হলেন- বি বি কিং, হারবি হ্যাংকক, চাক কোরিয়া, ইয়ানি, কার্লোস স্যান্তানা, আকাশা (ব্যান্ড), কেনি জি, জর্জ হ্যারিসন, জনম্যাকলাফলিন, স্টিভ মোর্স, ওয়েইন শর্টার, শংকর মাহাদেভান, এ আর রহমান, শাফকাত আমানাত আলি খান, ফারাজ আনোয়ার, মিকাল হাসান, শংকর-এহসান-লয়, উস্তাদ নুসরাত ফাতেহ আলি খান, তাঁর শিষ্য রাহাত ফাতেহ আলি খান, পণ্ডিত শিভ কুমার শর্মা, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, ক্যায়লাশ খের-নারেশ-পারেশ প্রমুখ। (ক্যায়লাসা ব্যান্ড)

ফিউশন এবং কনফিউশন- ফিউশন বলতে কি বোঝায় সে বিষয়ে অনেকেই ভুল করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে cooperation কেই অনেকে ফিউশন বলে থাকেন। বিষয়টি একটু বিশদভাবে আলোচনা করা যাক। fusion অর্থ বিশ্লেষণ করলে বলা যায় একটির সঙ্গে আরেকটির মিশেলে নতুন সৃষ্ট রূপকে ফিউশন বলা যায়; কিন্তু একটির সঙ্গে শুধু আরেকটি মিলল, নতুন কিছু পাওয়া গেল না, এইরকম হলে তো সেটিকে আসলে ফিউশন বলা যায় না।

দেখা যায় ইলেট্রিক গিটার, ব্যাজ গিটার, একুস্টিক তানপুরার সঙ্গে ইলেকট্রিক তানপুরা বাজলে, গিটার এর সঙ্গে তবলা বাজলে তাকে ফিউশন বলা হয় কিন্তু আসলেই কি তাই? যেমন উচ্চাঙ্গ সংগীত (কণ্ঠ) গিটার, ড্রামস, কিবোর্ড, বেজ গিটারের সঙ্গে পরিবেশন করলেই সেটি ফিউশন হয়ে যায় কি? তাত আসলে ফিউশন না, কনফিউশন। দুটি রূপ শুধু মিলালেই তো হবে না, সেই রূপের মিলিত চেহারাটি কেমন হলো, তার মানটা কি আসলেই সেইরকম উন্নত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারলো কি না, সেটাও তো বিবেচনার বিষয়। তবেই তো তাকে ফিউশন বলা যেতে পারে।

শচীন দেব বর্মণ।

কিছু বুঝলাম না, কি করলাম তা নিজেও জানলাম না, কোনো পরিমিতিবোধ নেই, শুধু কতগুলো যন্ত্র একসঙ্গে বাজিয়ে একটি কম্পোজিশন করে ফেললাম- সেটি তাহলে খিচুড়ি হবে, ফিউশন নয়। যেমন মিয়াঁ কি মালহার রাগে বহু গান সুরারোপ করা হয়েছে। কিন্তু সেসব গানে শাস্ত্রীয় যন্ত্রের মাধ্যমে সংগীতায়োজন করা হয়েছে। এখন এই গানের সংগীতায়োজনে বৈচিত্র্য আনতে চাইলে বা ফিউশন করার ইচ্ছা করলে এই গানের সঙ্গে ইলেট্রিক গিটার, ড্রামসের ব্যবহারের পাশাপাশি, তবলা, সেতারের ব্যবহার করা যায়।

এছাড়া গবেষণার মাধ্যমে আরও নতুনত্ব যোগ করে সেটিকে ফিউশনের আদলে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে; কিন্তু অবশ্যই সুরেলাভাবে এবং পরিমিতি রেখে। অর্থাৎ সেই সংগীতায়োজন থেকে ধ্বনি ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে হবে। সেই সংগীত যেন ধ্বনি অনৈক্য সৃষ্টি না করে। আবার এই বিষয়টিরই যদি কেউ পূর্বে প্রচলন করে থাকেন তাহলে তা ফিউশন হবে না। কারণ ফিউশন এর মূল শর্ত ‘অভূতপূর্ব’। মানে যার প্রয়োগ আগে কখনো কোথাও হয়নি। 

আর ফিউশন তো কেবল সংগীতের ক্ষেত্রে নয়, সৃষ্টিশীল অনেক কিছুতেই আজকাল ফিউশন টার্ম ব্যবহার করা হয়। যেমন, ফ্যাশনে, রান্নায়, স্থাপত্য নকশায়, চারু ও কারুকলায়, আরও অন্যান্য অনেক বিষয়েই ফিউশন করতে দেখা যায় আজকাল। 

সংগীতে রাগ-রাগিনীর ব্যবহারের মাধ্যমেও ফিউশন করতে শোনা যায়। যেমন-পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ সংগীতশিল্পী শাফকাত আমানাত আলি খান এর মোরা সাইয়া মোসে বোলে না, অ্যায় চান্দ যা কাহি ছুপ যা এই গান দুটি এই পর্যায়ের ফিউশনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। এই গানগুলোর সুরারোপ করা হয়েছে পুরোপুরিই রাগের চলনে, কিন্তু এর সংগীতায়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র। ‘অ্যায় চান্দ যা কাহি ছুপ যা’ গানটি কম্পোজ করা হয়েছে মাধুবান্তি রাগে।

কিন্তু এর সংগীতায়োজনে ডিস্টরশন টোন এ ইলেট্রিক গিটার, কিবোর্ড, ড্রামস, ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়েছে। আর সেসব বাজানোর স্তরটিও কোনো সাধারণ বিষয় নয়; এক কথায় ‘মাস্টারপিস’। আমাদের দেশের গানেও উস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী তাঁর স্বনামে প্রকাশিত সর্বশেষ গানের এলবামে ‘হারানো দিনের স্মৃতি’ গানটির সংগীতায়োজন করেছেন পুরোপুরি পশ্চিমা ঢংয়ে, যা অনায়াসেই হতে পারে ফিউশনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

এ গানটিও মাধুবান্তি রাগে সুরারোপিত। এই কাজটি উপমহাদেশে সর্বপ্রথম করেন ভারতীয় সংগীতজ্ঞ আর ডি বর্মণ। প্রাচ্য রাগ-রাগিনীর চলনে গানের সুরারোপ আর তার সংগীতায়োজনে করতেন পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র, হারমোনি, কর্ড এর ব্যবহার। তাকে উপমহাদেশে ফিউশন এর প্রবর্তক বলা যেতে পারে। 

আসলে বাংলা সংগীতে ফিউশনের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয় ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতের ফিউশন সম্বন্ধে। কেননা এই বাংলাদেশ তো আসলে এক সময় ভারতবর্ষেরই অন্তগর্ত ছিল। তো এই বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতে ফিউশন সর্বপ্রথম কে করেন সে ব্যাপারে আমি বলব জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর নাম। সেই ১৯৩৪ সালে রচিত তাঁর ‘শঙ্কা শূন্য লক্ষ কন্ঠ’ গানটিকে আমি ফিউশনের সুতিকাগার বলব।

একেবারে চিরাচরিত আমেরিকান ব্ল্যাকদের মতো সুর রচনার শৈলীতে তিনি গানটি কম্পোজ করেন। সুরের চলন, দোলা, ডাবল ব্যাজের মতো বেজগ্রুভ, কর্ড পাঞ্চিং, হারমোনাইজেশন, ট্রাম্পেট, একরডিওন, বিটের চলন, ছন্দ ঠিক যেন ১২ bar blues গানের মতোই। এ খাঁটি ফিউশন ছাড়া আর কি? গানটি শুনলে মনে হয় ঠিক কোনো মার্কিনি বাংলা ভাষায় জ্যাজ গাইছেন। কেন কাজী নজরুল ইসলামকে আমি ফিউশনের জনক বলবো তা আরেকটু পরিষ্কার করি।

সংজ্ঞামতে দুটি ভিন্ন জিনিস এর মিশেলে নতুন জিনিস তৈরি হলে তা ফিউশন হবে। তো এই কথার আওতায়রবীন্দ্রনাথ এর ধ্রপদভাঙা গানও পড়ে যায়। সেটিও ফিউশন, ধ্রুপদ এর সুরের আদলে রচিত গান। দুটি ভিন্ন জিনিসের মিশেলে প্রাপ্ত নতুন জিনিস। আংশিকভাবে হলেও তো সত্য। কিন্তু শুধু নতুন রূপ তৈরি হলেই তো হবে না। ওই যে চমক, বুকে ধাক্কা লাগা, চেনার মধ্যেও অচেনা, জানার মধ্যেও অজানা কিছু, শোনা মাত্রই মনে হওয়া হায় হায় কী শুনলাম, কী ঘটে গেল! আগে তো শুনিনি! আগে তো দেখিনি! এই এইটাই ফিউশন।  

বাংলা সংগীতে কাজী নজরুল ইসলাম শুধু ফিউশন নয়, আধুনিক গানেরও জনক। তাঁর সময় থেকেই বাংলা গান কাব্যের, ব্যাকরণের খোলস ছেড়ে মুক্ত হাওয়ায় বিচরণ করা শুরু করে। কাজী নজরুল ইসলামের সংগীতে এই আধুনিকতার মিছিলে পরে আমরা পাই আরও অনেক অনেক রথী, মহারথীদের। যেমন শচীন দেব বর্মণ, সলিল চৌধুরী, আর ডি বর্মণ প্রমুখ দিকপালদের।

সলিল চৌধুরী।

শচীন দেব বর্মণ, সলিল চৌধুরী তাঁরা প্রত্যেকেই সংগীতে নতুনত্ব এনেছেন। শচীন কর্তা তো পল্লী গান কে গ্রাম বাংলার রূপ থেকে একেবারে শহুরে ড্রয়িং রুমে এনে ছেড়ে দিয়েছেন। আবার ওইদিকে সলিল চৌধুরী ইউরোপীয় সিম্ফোনির আদলে, পশ্চিমা স্কেলিং পদ্ধতিতে গান কম্পোজ করতেন। তাঁর প্রসিদ্ধ ‘রানার’ এমনই এক গান যেখানে একের অধিক স্কেলে গান কম্পোজ করা হয়। 

তবে ফিউশন ব্যাপারটি মনে হয় আর ডি বর্মণের কাছে এসে একেবারে নিঃস্ব, রিক্ত, উন্মুক্ত হয়ে নিজেকে মেলে ধরেছে। ফিউশন পেয়েছে তার চূড়ান্ত গন্তব্য। আর ডি বর্মণ তাঁর সংগীতে যে কত রকমের, কত ধরনের ফিউশন করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। সংগীতায়োজনে হারমোনিকার ব্যবহার, রিদমে কংগোর, ক্রোমাটিক স্কেলে গানের সুরারোপ, আরব সুরের সঙ্গে ভারতীয় সুর... বলে শেষ করা যাবে না। 

এবারে কিছু কথা বলা যাক বাংলাদেশের ফিউশন নিয়ে। এদেশে ফিউশন এর প্রচলন কবে থেকে শুরু, তা বলা যায় ৬০ এর দশকে যখন ব্যান্ড মিউজিকের চর্চা শুরু হয় সেই সময়টা। কে প্রথম ব্যান্ড শুরু করেন বা কোনটি বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড এই ব্যাপারে আমরা জটিল আলোচনায় না গিয়ে এইটুকু বলতে পারি তথাকথিত আধুনিক গান এর বলয় থেকে বেরিয়ে যখন এদেশে রচিত বাংলা গানের সঙ্গে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার শুরু, ঠিক সেই সময়টাকেই বলা যায় বাংলাদেশে ফিউশনের সূচনাকাল। কীবোর্ড, গিটার, ড্রামস বাজিয়ে সংগীত পরিবেশন ছিল সেই সময়ের জন্য ‘ফিউশন’। 

পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর আজম খানের উচ্চারণ ব্যান্ড এর মাধ্যমে বাংলাদেশি সংগীত পেলো নতুন ধারার স্বাদ, আর যেটিকে বলা যায় ফিউশনের অগ্রযাত্রায় ভিন্নমাত্রা যুক্ত হওয়া। আজম খানের ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশের আরও অনেক পরে গিটার গুরু নিলয় দাশ বাংলাদেশে ফিউশন মিউজিকের অবস্থান আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। বাংলাদেশের ফিউশন মিউজিকে নিলয় দাশ এর অনস্বীকার্য অবদানকে এক কথায় মাইলফলক বলা যেতে পারে। তিনি তাঁর গানের সংগীতায়োজনে ফ্ল্যামেনকো গিটার এর বাদনশৈলী ব্যবহার করেন। 

বাংলা আধুনিক গানের ইন্টারলিউড মিউজিক, কিংবা সলো, বা কাউন্টার বাদনে তিনি ছোট ছোট পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সংগীতের টুকরা বাজিয়ে থাকতেন, তাও আবার ফ্ল্যামেনকো স্টাইলে। মানে এ যেন এক মুহূর্তের মধ্যে হাজার-লক্ষ ভোল্টেজ এর বিদ্যুতের চমক দেখানোর মতো। চোখের পলকে কত কী ঘটে গেল, অথচ তার তাৎপর্য বুঝতে বুঝতে, বিশ্লেষণ করতে করতেই আবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। 

আবার এর রেশ কাটতে না কাটতেই একটু পর আবারও তাঁর হাতের জাদু প্রদর্শিত হলো গানের অন্য কোনো চরণে। ঠিক যেন চোখে ধাধা লেগে যাওয়া। শ্রোতার কর্ণকুহরে যাদুমন্ত্র পাঠ করে তাকে সম্মোহন করে কল্পনার এক অন্য জগতে নিয়ে যাওয়া তারই অগোচরে। বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের উত্থানের পর নিলয় দাশের এমন অসাধারণ বাদনদক্ষতা বাংলাদেশে ফিউশনের অভূতপূর্ব অধ্যায়ের সূচনা করে। 

২০১১ সালে ফিউশনে নতুন মাত্রা যোগ করেন উস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী। তিনি ভূপালি রাগে একটি তারানা পরিবেশন করেন পুরোপুরি পশ্চিমা গায়নরীতি অনুসারে। এই পরিবেশনায় প্রচলিত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু গায়কীতে যোগ করা হয়েছে পশ্চিমা রীতি যেমন: 2nd, 4th note এর হারমোনাইজিং এর ব্যবহার। পুরো কম্পোজিশনে আলাপের শেষে এবং তারানা শেষ করার পর, এই দুই জায়গা ছাড়া আর কোথাও সা তে ন্যাস করা হয়নি।

এই তারানাটি অন্যান্য সাধারণ তারানার মতই কিন্তু শুধু কণ্ঠের কারুকার্য তারানাটিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তারানাটিতে যেরকম পাশ্চাত্য হারমোনাইজিং শোনা যায় তেমনটা আমরা শুনে থাকি কম্পোজার ‘বাখ’ এর রচিত সংগীতে। ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের সঙ্গে পশ্চিমা রীতিতে তারানা পরিবেশন এইরকমভাবে বাংলাদেশে এর আগে কেউ করেননি। 

বর্তমান বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে আলোচিত শব্দটির নাম ‘ফিউশন’। যদিও সংগীতের ক্ষেত্রে ফিউশন একটি পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, তথাপি বাংলাদেশের গানে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ছাত্রজীবনে বেশ কিছু সময় ব্যয় করেছি এই ফিউশন নিয়ে গবেষণা করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে এম এ অধ্যয়নকালীন এই বিষয়ে একটি অভিসন্দর্ভও রচনা করেছিলাম। সেই গবেষণার আলোকেই উক্ত লেখাটি সংক্ষিপ্তাকারে লিখবার সাহস করলাম।

এখনো এই বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক তথ্যের ব্যাপক অপ্রতুলতা রয়েছে। আমি নিজেও মনে করিনা আমার জ্ঞানও এই বিষয়ে পরিপূর্ণ। আশা করছি এবং আহ্বান করছি আমার এ লেখাটির মাধ্যমে ভবিষ্যতে সংগীত শিক্ষার্থীরা ও সংগীত পিপাসু ব্যক্তিরা ফিউশন বিষয়ে আরও সমৃদ্ধতর গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ হবেন। এ লেখাটি হতে পারে তাদের গবেষণার প্রারম্ভিক যাত্রা। 

লেখক: সংগীত শিল্পী ও প্রশিক্ষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //