‘সামনের মাসে তোমায় একটা নৌকা কিনে দেব’খ্যাত সংগীতশিল্পী পান্থ কানাই। শুরুতে নগর বাউল ও সোলস ব্যান্ডের সঙ্গে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পরে নিজেই একক ক্যারিয়ার নিয়ে শ্রোতাদের সামনে আসেন। ২০০১ সালে তার প্রথম অ্যালবাম ‘মা’ প্রকাশিত হয়। এরপর ‘আদম হাওয়া’, ‘মন কারিগর’ ও ‘নৌকা জমিন নাটাই’সহ বেশ কিছু অ্যালবাম দিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলেন।
বন্দর নগরী চট্টগ্রামে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তার মা একজন সংগীতশিল্পী। ছয় বছর বয়স থেকেই তিনি তার মায়ের সঙ্গে শাস্ত্রীয় তবলা বাজাতেন। উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি জ্যাজ ড্রাম বাজানো শুরু করেন। এরপর সোলস ও নগর বাউলের মতো ব্যান্ডগুলোতে ড্রাম বাজিয়ে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় গায়ক ও ড্রামবাদক হয়ে ওঠেন। ছোটবেলার স্মৃতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের চট্টগ্রামেই আজকের অনেক লিজেন্ড ও তারকাদের জন্ম। আমিও সেই নগরীর আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছি। প্রাণের শহর চট্টগ্রামকে সব সময় হৃদয়ে রাখি।’
ব্যান্ড দল থেকে বের হয়ে এ ড্রামবাদক একক গায়ক হিসেবে নিজেকে শ্রোতাদের সামনে নিয়ে আসেন ২০০১ সালে। তার ভাষ্য, ‘আমার ক্যারিয়ারের শুরু তো ব্যান্ড দিয়ে। কিন্তু কিছু বিষয়ের কারণে সে সময় আমি ব্যান্ড থেকে বের হয়ে যাই। আমার একক গায়ক হিসেবে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক ভূমিকা আছে। প্রথম অ্যালবামের গানগুলো শ্রোতারা গ্রহণ করায় আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’
দীর্ঘ সময় ধরে গান করছেন পান্থ। লম্বা এ পথচলা নিয়ে তিনি বলেন, ‘পথটা যত লম্বা, সেখানে তত বাধা-বিপত্তি থাকে। কেউ বন্ধু হয়, কেউ আবার শত্রুও হয়। এর মধ্যে দিয়েই নিজের সঠিক লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছতে হয়। আমার এ লম্বা জার্নিটা খুব সহজ ছিল বলব না। বিশেষ করে আমাদের সেই সময়ে প্রতিযোগিতার শেষ ছিল না। নিজেকে প্রমাণ করাও এখনকার মতো এত পথ ছিল না। এখনো নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই সামনে হাঁটতে হচ্ছে। তবে বলতে হয়, শ্রোতারা আমার গান শোনেন, ভালোবাসেন বলেই এত দূর আসতে পেরেছি। চলার পথে কিছু মানুষকেও পেয়েছি যাদের অবদান অস্বীকার করা যাবে না।’
চলতি সময়ের অনেক তারকা শিল্পীর মতো পান্থ কানাইও স্টেজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও আছে তার ব্যস্ততা। এ বছর জুলাইয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়াতে কয়েকটি শো করবেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের শিল্পীদের প্রাণের জায়গা হলো স্টেজ। এখানে শ্রোতাদের সঙ্গে সরাসরি গান করাতে অন্য রকম আনন্দ থাকে। তবে আমার খুব আফসোস হয়, দেশে এখন আর আগের মতো শো আয়োজন করা হয় না। একটা সময় যেভাবে ওপেন কনসার্ট হতো সেটি এখন আর খুব বেশি দেখা যায় না। গেল কয়েক বছর আগেও একটি প্রোগ্রামে একাধিক তারকা শিল্পীকে দেখা যেত। এখন কোথাও শো হলেই একজন শিল্পী দিয়েই সেটি শেষ করছেন।’
একটা সময় ব্যান্ড শিল্পীদের নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে অন্যরকম উন্মাদনা দেখা যেত। কিন্তু এখন আর তেমনটা নেই। চলতি সময়ে অনেক ব্যান্ড আসলেও তারা সব শ্রেণির শ্রোতার মনে জায়গা পাচ্ছে না। কেন এমনটা হচ্ছে, এসব নিয়ে কথা হয় এ তারকার সঙ্গে। নতুন ব্যান্ডগুলো ক্রেজ তৈরি করতে না পারার কিছু কারণ আছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই ব্যান্ডের সঙ্গে যোগ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছি। নব্বই দশকে ব্যান্ডের যে জোয়ার ছিল সেটি এখন নেই। তবে এটি সত্যি এখন নতুন যে ব্যান্ডগুলো এসেছে তারাও ভালো কাজ করছে। কিন্তু আগের ব্যান্ডগুলোর মতো ক্রেজ তৈরি করতে পারছে না। এই ক্রেজ তৈরি করতে না পারার কয়েকটি কারণ আছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে বলতে হয় এখন মানুষের হাতে অনেক অপশন আছে বিনোদনের জন্য। ইউটিউবে একটি গান দেখার দুই মিনিটের মধ্যে সে আবার অন্য কোনো কিছুতে চলে যাচ্ছে। আগে এমনটা হওয়ার সুযোগ ছিল না। যার কারণে শ্রোতাদের পুরো একটি গান শুনতে হতো। পুরো গান শুনেই মন্তব্য করত গানটি ভালো নাকি খারাপ হয়েছে।’
সর্বশেষ পান্থ কোক স্টুডিওর গান করে নতুন করে আলোচনায় আসেন। কোক স্টুডিওর প্রথম সিজনে তিনি সবাইকে চমকে দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোক স্টুডিওর প্রথম সিজনে আমি কাজ করেছি। দ্বিতীয় সিজনে আমার কাজ করা হয়নি। আমি নিজ থেকেই সরে এসেছি। কারণ নতুনদের সুযোগ দিতে চাই। সব কাজ আমি একা করলে তো নতুনরা কাজ করতে পারবে না। তবে তৃতীয় সিজনে যদি আমাকে ডাকে তাহলে হয়তো আবার নতুন কিছু নিয়ে দর্শক-শ্রোতার সামনে আসব।’
বর্তমান সময়ের গানগুলো খুব বেশিদিন টিকে থাকছে না বলে অনেকের অভিমত। এখনকার গান নিয়ে এ তারকা শিল্পীর মন্তব্য কী? তিনি বলেন, ‘এখন ভালো ভালো গান হচ্ছে। চলতি বছরের বেশ কয়েকটি গানই শ্রোতাদের মুখে মুখে আছে। সলো শিল্পীদের বাইরে নতুন নতুন ব্যান্ডগুলোও ভালো কাজ করছে। এভাবে চলতে থাকলে গান আরও অনেক দূর যাবে। কিন্তু শিল্পীরা একক প্রচেষ্টায় গান নিয়ে কতদূর যাবে? এর জন্য প্রয়োজন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা। বিভিন্ন দেশে বড় বড় প্রতিষ্ঠান গানের জন্য স্পন্সর হয়ে থাকে। এটি আমাদের এখানে নেই। আমাদের আগের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অনেক শিল্পীর দূরত্ব হয়ে আছে। আমি মনে করি, এখনো যদি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্পীদের নিয়ে সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে বাংলা গানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’
গানের বাইরে ইতোমধ্যে অভিনয়েও নাম লিখিয়েছেন এই সংগীততারকা। ‘দাহকাল’ শিরোনামের একটি সিনেমাতে অভিনয় করেছেন তিনি। চলতি বছরেই এটি মুক্তি পাবে বলে জানান। এ সিনেমাটি করতে গিয়ে অভিনয়ের প্রেমেও পড়ে গেছেন তিনি। গায়ক বলেন, ‘এ কাজটি করার পর এখন বেশ ভালো লাগছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে ভালো গল্প ও চরিত্র পেলে অভিনয় করব। গানের পাশাপাশি অভিনয় করা যেতে পারে। আমাদের গানের অনেকেই তো অভিনয় করছেন। দর্শকও তাদের গ্রহণ করেছেন। কোনো নির্মাতা যদি আমাকে উপস্থাপন করার মতো গল্প ও চরিত্র নিয়ে আসেন তাহলে সেটি করতে আমি আপত্তি করব না।’
প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে ভয়ে ছিলাম। অনেকগুলো সংলাপ ছিল। আমি বলেছি এত সংলাপ দিতে পারব না। পরে কাজটি শুরু করার পর সবাই বেশ উৎসাহ দিল। একদিনেই আমার চারটি দৃশ্যের শুটিং শেষ করেছি। নির্মাতা ছাড়াও ফারিণসহ ইউনিটের সবাই বলতে লাগল ভালো অভিনয় করছি। পরে কাজটিতে সহজ হতে পেরেছি।’ অভিনয়ে আগ্রহী হওয়ার কারণ কী ছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেক দিন থেকে ‘দাহকাল’ সিনেমার নির্মাতা আমাকে নিয়ে কাজ করতে চেয়েছেন। আমি বেশ কয়েকবার না করেছি। কিন্তু তার কথা হলো আমি পারব। নির্মাতার কারণেই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। এখানে আমি একজন মিডিয়া এজেন্সির মালিক। মডেলরা আমার কাছে কাজ চাইতে আসে। ন্যাচারালি মিডিয়া এজেন্সিগুলোতে যা ঘটে সেটিই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। দর্শক এখানে অনেক কিছু দেখতে পাবে মিডিয়া এজেন্সির।”
সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা পরিচয়ের বাইরে ‘আদম হাওয়া’খ্যাত এ গায়ক লেখক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন। গেল বইমেলায় একটি বই প্রকাশ করেছেন‘আমি মুক্তি চেয়েছিলাম’। প্রথম বইয়ের কেন এমন নামকরণ? তিনি বলেন, ‘এটি আমার বায়োগ্রাফি। এখানে আমার বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে সব আছে। কীভাবে নগর বাউলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, কেনইবা আবার ছেড়েছি। কীভাবে নিজের একক ক্যারিয়ার শুরু করেছি। চলার পথে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি সব এই বইয়ে তুলে ধরেছি। আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অনেক গল্প এখানে তুলে ধরেছি। আমাদের শোবিজ অঙ্গনের অনেক অজানা বিষয়ও পাঠক এখানে পাবেন। সর্বশেষ কোক স্টুডিওর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার গল্পও এই বইয়ে লিখেছি।’
গান ও ক্যারিয়ারসহ নানা বিষয়ের বাইরে এ তারকার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়েও কথা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায়
আজকাল অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় আসে। এসব নিয়ে একজন সচেতন মানুষ হিসেবে পান্থ কানাই কী বলবেন? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সব কিছু মানুষের মুঠোয় চলে এসেছে। এ কারণে মানুষের আলোচনা-সমালোচনা করাও সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু কে কার সমালোচনা করবে এটা যদি কারও মধ্যে উপলব্ধি না হয় তাহলেই বিপত্তি। যার সমালোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই তারও সমালোচনা করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আবার অনেক অরুচিকর বিষয়কে নিয়ে মজা করতে গিয়ে তাকে সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আমি যাকে নিয়ে মজা করছি সে এটিকে মজা হিসেবে না নিয়ে উল্টো উৎসাহ পাচ্ছে। আমি মনে করি সোশ্যাল মিডিয়ায় কারও আলোচনা-সমালোচনা করতে হলে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।’
সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত রুচি বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। আমাদের কি আসলেই রুচির অবক্ষয় হচ্ছে? রুচির অবক্ষয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেন এ তারকাও। রুচির অবক্ষয় যদি না হতো প্রকৃত শিল্পমনের মানুষদের আড়ালে থাকতে হতো না বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, যে অভিনয় পারে না সেও অভিনয় শিল্পী, যে গাইতে পারে না সেও কণ্ঠশিল্পী। এগুলোকে তাহলে কী বলা যায়? এগুলো আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ বলব? নতুন প্রজন্ম এদের কাছ থেকে কী শিক্ষা নেবে? এভাবে অরুচিকর বিষয়গুলো যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে তখন মানুষ আর আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির দিকে থাকবে না। তারা অন্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়বে।
পান্থ কানাই তার শ্রোতা ও সাধারণ পাঠকদের জন্যও কথা বলেন। তার আহ্বান, মুঠোফোনের মধ্যে এখন বিশ্ব চলে এসেছে। আপনি নিমিষেই বিশ্বের যে কোনো দেশের গান সিনেমা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু দেশীয় গান-নাটক-সিনেমাকে উপেক্ষা করে ভিনদেশিকে নিয়ে পড়ে থাকবেন না। দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করুন। দেশকে ভালোবেসে উন্নত করুন। আমাদের সংস্কৃতির নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। বিশ্বের আর কোথাও ভাষার জন্য কেউ জীবন দেয়নি। আমরাই শুধু ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। তাহলে সেই ভাষার ঐতিহ্যকে ধরে রাখা আমাদের উচিত।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : সংগীতশিল্পী পান্থ কানাই ড্রামবাদক
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh