ফেরদৌসী রহমান এক আলোকিত ব্যক্তিত্ব

“আমার ভাষা এখন থেবড়ো থেবড়ো পথের ওপর
জোড়া মহিষের জ্বালাধরা স্কন্ধদেশ মাত্র
ভাওয়াইয়ার মধ্যস্তবকে নামা ফেরদৌসীর গলা
তার ফুঁপিয়ে ওঠা তরঙ্গে একাধিক লাবণ্যময় মোচড়।
ও গাড়িয়াল ভাই
আমার ভাষা এখন তোর মোষের ফেটে যাওয়া লাল চক্ষু।
চার চারটি চোখের অন্তর্ভেদী রক্তিম দৃষ্টি
আমার ভাষা।”

প্রখ্যাত কবি আল মাহমুদ তার ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত একটি অতুলনীয় সুন্দর ও সমৃদ্ধ প্রেমের কবিতা ‘তুমি, আমার প্রথম উচ্চারণ’-এর উপসংহারে নির্ভেজাল ও সর্বজনীন শ্রদ্ধা আকর্ষণকারী আলোকিত ব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী রহমানকে এভাবেই মিথ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

ফেরদৌসী রহমান একজন কিংবদন্তি শিল্পী, একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং একজন আদর্শ মানুষ। সুর, মাধুর্য, সৌন্দর্য, সুশিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা-এই সাতটি গুণের সোনালি সমাহার যার মাঝে, তার নাম ফেরদৌসী রহমান। কোনো পদ বা পদবি নেই অথচ যাকে ভালোবাসে বাংলার আকাশ বাতাস মাটি ও মানুষ। তার পেশাগত জীবন ছুঁয়ে আছে সাফল্যের হিমালয়, তার ব্যক্তিগত জীবন ভরে আছে সুরুচি ও সুচরিত্রের আলোয়। জীবনের কোনো মোড়েই কালিমার কালি ছুঁতে পারেনি তার সুরভিত অস্তিত্ব। ফলে সাফল্য ছাড়িয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন জীবনের সার্থকতায়।

বেগম ফেরদৌসী রহমান জন্মগ্রহণ করেন এক স্বনামধন্য পরিবারে। বাবা আব্বাসউদ্দিন আহমদ, বড় ভাই ড. মোস্তফা কামাল এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসী সকলেই স্বনামে খ্যাত। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আধুনিক গানের সংগীতশিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন বাবা আব্বাসউদ্দিন আহমদ। আব্বাসউদ্দিন যখন গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন, তখন মুসলিম সমাজে গান ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। মুসলিম ছেলেমেয়েরা গান শিখবে একথা কেউ কল্পনায় আনতেন না। বিষয়টা এমন ছিল না যে, তখন কোনো মুসলিম শিল্পী গান গাননি। গেয়েছেন এবং জনপ্রিয় হয়েছেন। তবে নিজের মুসলিম নামটি পাল্টিয়ে নিতে হয়েছে। সেই প্রায় নিষিদ্ধ সময়ে মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়েও মুসলিম নাম ধারণ করে আব্বাসউদ্দিন গানের জগতে নাম লেখান এবং কালজয়ী শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নিজের সাধনা, অধ্যবসায় ও বিশেষ গায়কী ঢঙের সঙ্গে সুরেলা কণ্ঠ দিয়ে জয় করে নেন তখনকার প্রতিকূল পরিবেশ ও লাখো শ্রোতার হৃদয়। আব্বাসউদ্দিন হয়ে ওঠেন নবজাগরণের অমরশিল্পী। সেই সময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও সমকালীন মুসলিম কবি-সাহিত্যিকেরা তাদের রচনা দিয়ে মুসলিম চেতনা জাগিয়ে তুলছিলেন। নজরুলের সঙ্গে আব্বাসউদ্দিনের পরিচয় ঘটে কুচবিহারে। নজরুল তাকে স্নেহ করে পরিচয় করিয়ে দিতেন ‘আমার ছোট ভাই’ বলে। তত দিনে নজরুলের অসংখ্য গান রেকর্ড করে ফেললেও তার প্রথম রেকর্ডের গান ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল মরে গো’ ও অপর পিঠে ‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়’ বাজারে আসার পর পরই সাড়া পড়ে যায়। ‘আব্বাসউদ্দিন আহমদ’ নাম ব্যবহার করেই এইচএমভি থেকে গানের রেকর্ড বের করেন। সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে সফলতার মুখ দেখে। কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের অসংখ্য ইসলামিক ভাবধারার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি এবং গানগুলোও অমরত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে অভব্য গান বলে যারা ভাওয়াইয়া গান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতেন, তারাই আব্বাসউদ্দিনের মধুভরা কণ্ঠে সে গানের রসাস্বাদন করেছেন গোপনে ও প্রকাশ্যে।

বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছোট ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসী নিজেকে সমর্পণ করেন সংগীতচর্চা, গবেষণা ও অধ্যাপনায়। শিল্পী, সংগ্রাহক, উপস্থাপক, গবেষক, সাহিত্যিক, অনুবাদক ও দার্শনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। দক্ষতা অর্জন করেছিলেন বাংলা-ইংরেজি-উর্দু-এই তিন ভাষাতেই। এর বাইরে তিনি কাজ করছেন ইসলামি ও লোকধারার গানগুলো সংগ্রহ এবং তা জনপ্রিয় করতে। তিনি নজরুল সংগীতের কেবল প্রসারই নয়, সামগ্রিকভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে কাজী নজরুল ইসলামকে বিশেষভাবে জানাতে, বিশেষ করে তার সমগ্র রচনা পাঠে আগ্রহী করে তুলতে যে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন, এককথায় তা অতুলনীয়। পিতা আব্বাসউদ্দিন ও পিতৃব্য কাজী নজরুল ইসলামের ছবি ও পেইন্টিং সংগ্রহ, গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। ‘নজরুল-আব্বাসউদ্দিন স্মৃতিময় অ্যালবাম’ আমাদের জাতীয় জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ বই। নজরুল সংশ্লিষ্ট ৮০টি ও আব্বাসউদ্দিন সংশ্লিষ্ট ১২৫টি ছবি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ এ অ্যালবাম। 

বড় ভাই ড. মোস্তফা কামাল ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। ভালোবাসায় আর্দ্র, মমতাময়, স্নেহশীল বড় ভাইয়ের কথা জানা যায় মুস্তাফা জামান আব্বাসীর কথায়, ‘তার সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন পরিবারের জন্য। বিশেষ করে আমার ও বোনের জন্য। অসুখ হলে পরিচর্যা ও খোঁজখবর নিয়েছেন পরিবারের সবার। আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় দৃঢ় হলেও বিনয় তার ভূষণ।’ 

ফেরদৌসী রহমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৮ জুন, কুচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের বেদনা সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন আব্বাসউদ্দিন আহমদ। বসবাস শুরু করেন পুরান ঢাকার নারিন্দায় ধোলাইখাল পাড়ে ৭৭ নম্বর ঋষিকেশ দাস রোডে। ফেরদৌসী রহমানের শৈশবের অনেক স্মৃতি পুরান ঢাকাকে ঘিরে। এরপর ৬৮/১, পুরানা পল্টন, হীরামন মঞ্জিল।

কুচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামের যে বাড়িতে ফেরদৌসী রহমানের জন্ম তার বর্ণনা পাওয়া যায় ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসীর লেখায়। ছায়া সুনিবিড় বলরামপুরের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে সুমধুর, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মায়ার অঞ্জন ছড়ানো একটি নাম বলরামপুর।...একটি দক্ষিণমুখী বাড়ির আগদুয়ার ঘর, সুউচ্চ জামের সারি, আমের সারি, আমলকীর মৌ, গোলাব জামের শিষ। ভেতর বাড়িতে উত্তরের ঘর যেখানে আমার দাদু থাকেন, বড় রান্নাঘর, গোলাঘর, দক্ষিণের ঘর-ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য।....

শৈশব থেকেই ফেরদৌসী রহমান ছিলেন প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী। আব্বাসউদ্দিন আহমদের ছোট ভাই গীতিকার আব্দুল করীম ছোট্ট ফেরদৌসীর গুণে মুগ্ধ হয়ে লেখেন ‘যে নদী হয়ে আছে শীর্ণা/তাহার বক্ষ জুড়িয়া জাগাবে জোয়ার/ছোট্ট আমার মা-মণি মীর্ণা।’ ছোট্ট মীর্ণা ঠিকই বাংলাদেশের ‘মীর্ণা’ সুরের জগতে জাগিয়ে দিয়েছেন অপূর্ব সুরের জোয়ার। পড়াশোনা করেছেন বাংলাবাজার স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সবশেষে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিকে। বাল্যকালের প্রথম স্কুল সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স কনভেন্টে তিনি সর্বদা প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকতেন। বাংলাবাজার সরকারি স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত মেধা তালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করেন। দুই বছর পর ১৯৫৮ সালে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে ইউনেস্কো ফেলোশিপ নিয়ে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে স্টাফ নোটেশন কোর্স সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় হয় সৈয়দ আব্দুল হাদীর সঙ্গে। একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তারা দুজন। সৈয়দ আব্দুল হাদী বাংলায়, ফেরদৌসী রহমান সমাজবিজ্ঞানে। এরপর একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মঞ্চে অনেক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন তারা। 

ছোটবেলায় গানে হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার কাছে। খুব অল্প বয়সেই ওস্তাদ আব্দুল গফুর খান, মুহাম্মদ হুসেন খসরু, ওস্তাদ ইউসুফ খান কুরাইশি, ওস্তাদ কাদের জমিরি, ওস্তাদ মুন্সি রইসউদ্দিন, ওস্তাদ গুল-এর মতো মহান ওস্তাদের কাছ থেকে প্রাচ্য শাস্ত্রীয় সংগীতের পাঠ নিতে শুরু করেন। মোহাম্মদ খান, ওস্তাদ মুনির হোসেন, ওস্তাদ মাস্তান গামা এবং সবশেষে ওস্তাদ নাজাকাত আলী খান এবং সালামত আলী খানও গান শিখিয়েছেন ফেরদৌসী রহমানকে। মাত্র ৮ বছর বয়সেই রেডিওতে ‘খেলাঘর’ নামে একটি অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো গান পরিবেশন করেন। তখন তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। এরপর ১৯৫৬ সালে প্রথম বড়দের অনুষ্ঠানে গান করেন। পরের বছর ১৯৫৭ সালে করাচিতে এইচএমভি থেকে তার প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। প্রথম রেকর্ডের গান ‘প্রাণের প্রথম রেকর্ডের ‘বুঝিবে সই’ ও অপর পিঠে ‘আমায় ঘরছাড়া করিলি’ বাজারে আসার পরপরই দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ১৯৬০ সালে ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ নামের বাংলাদেশি নাট্য চলচ্চিত্রে প্রথম নেপথ্য কণ্ঠদান করেন তিনি। এর মাধ্যমে ৬০ ও ৭০-এর দশকের বহু চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত হন।

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিটিভি যাত্রা শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তান সরকার তখনো বাঙালির সংস্কৃতির ওপর ডাণ্ডা ঘোরানোর চেষ্টায় নামেনি। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় ফেরদৌসী রহমানের গানের পরিবেশনা দিয়েই যাত্রা শুরু হয় বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের। ‘ওই যে আকাশ নীল হলো আজ সে শুধু তোমার প্রেম’-গানটি ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম গান। দুদিন পর আবার ডাক পড়ে তার। বলা হলো, একটা অনুষ্ঠান শুরু হবে, সেখানে বাচ্চাদের গান শেখাতে হবে। গান শেখানোয় খুব আপত্তি ছিল ফেরদৌসীর। ততদিনে বেশ প্রতিষ্ঠিত এবং খুব জনপ্রিয় হয়ে গেলেও মনে হচ্ছিল ‘গানের ভুবনে নিজেই তো শিক্ষার্থী, অন্যদের শেখাব কী!’ কিন্তু মোস্তফা মনোয়ার আর কলিম শরাফীর মতো দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বের অনুরোধ অগ্রাহ্য করা তো সম্ভব নয়, অগত্যা রাজি হতেই হলো। ক্ষতি হয়নি তাতে, ‘এসো গান শিখি’-ফেরদৌসী রহমানের এ আহ্বানে আজও বাংলাদেশের শিশু সংগীত শিক্ষার্থীরা ছুটে গিয়ে বসে টেলিভিশনের সামনে। ততদিনে ‘খালামণি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে গেছেন নবীন, প্রবীণ সকলের কাছে।

অথচ কত কী হয়েছে! পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের চরম বৈষম্যমূলক শাসননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে, তাদের লেলিয়ে দেওয়া সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজের পরও পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে মুক্তিকামী বাঙালি। ১৯৬৪ সালের শিশুদের অনেকেই এখন ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ। গান গাইতে গেলে অনেকের কণ্ঠ কাঁপে, বেসুরো শোনায়। তবে এখনো বাড়িতে আছে ‘এসো গান শিখি’।

‘এসো গান শিখি’র সঙ্গে কয়েক প্রজন্মের এমন সুরের বন্ধন সম্পর্কে ফেরদৌসী রহমান বলেছিলেন, ‘অনেকটা সময়। এ সময়ের মধ্যে কয়েকটা প্রজন্ম ধরে এ গানের অনুষ্ঠানের শ্রোতা তৈরি হয়েছে। কিছু ছেলেমেয়ে আছে যারা ভালো গান করছে এখনো, আবার অনেকে গান গাইছে না, অন্যদিকে চলে গেছে। যেমন একটা ছেলে আছে ডালিম কুমার, সে আমার কাছে গান শিখত এখন অনেক ভালো অ্যাকুইস্টিকস বাজায়। তারপর হুমায়ূন আহমেদ সাহেবের স্ত্রী শাওন আছে যে ভালো গান করে। এসো গান শিখি থেকে আরও অনেক শিল্পী বেরিয়েছে।’

‘এসো গান শিখি’র শুরুটা হয়েছিল অবশ্য অন্য নামে। প্রথম দু বছর নাম ছিল ‘সংগীত শিক্ষার আসর’, তারপর দু বছর বন্ধ থাকার পর আবার যখন শুরু হলো তখন থেকেই নাম ‘এসো গান শিখি’ সময়ের দাবিতে পরিবর্তন এসেছে কিছু। শিশুদের খেলার ছলে, মজা করে করে গান শেখাতে অনুষ্ঠানে যোগ হয়েছে পাপেট ‘মিঠু’ আর ‘মন্টি’। নিজের লেখাপড়া, শিল্পী হিসেবে বিদেশ সফর বা অনুষ্ঠান একঘেয়েমি আসতে না দেওয়ার ভাবনা থেকে ফেরদৌসীর সানন্দ সম্মতিতে আজাদ রহমান, কলিম শরাফী, খান আতাউর রহমান এবং ফিরোজা বেগমও গান শিখিয়েছেন এ অনুষ্ঠানে। সেই পরিবর্তন অনেক আগের এবং খুবই কম সময়ের জন্য। ওই অতি সাময়িক পরিবর্তনগুলো বাদ দিলে ‘এসো গান শিখি’ আর ফেরদৌসী রহমান অবিচ্ছেদ্য ছিলেন এবং সবাইকে অবাক করে এখনো আছেন!

এসব কাজের মাঝে তিনি বেশ কয়েকটি ফিচার ফিল্মের জন্য প্লে-ব্যাক করেন, প্রথমটি ‘আসিয়া’। যদিও এই ছবিটি পরে মুক্তি পায়। তার গান নিয়ে মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি ‘এ দেশ তোমার আমার’। আব্বাসউদ্দিন সবসময় চেয়েছিলেন তার মেয়ে সিনেমায় গান করুক। ১৯৫৯ সালে খান আতাউর রহমান আব্বাসউদ্দিনের কাছে এসে বলেছিলেন তিনি চান তার মেয়ে তার ছবিতে গান করুক। আব্বাসউদ্দীন খুশিতে রাজি হন। গান করেন ‘এ দেশ তোমার আমার’ নামক চলচ্চিত্রে। আসিয়ার আগে মুক্তি পায় এই ছবি। তবে আসিয়াকে তৎকালীন পাকিস্তানে নির্মিত সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করেছিল।

এসব বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের প্রযোজকরা সকল বাঙালি শিল্পী ও প্রযুক্তিবিদকে নিয়ে উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রথম মুক্তি পায় ‘চান্দা’ নামের একটি চলচ্চিত্র, যা দুই পাকিস্তানেই তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া ফেলে। এই ছবির বেশিরভাগ গানই ছিল নিখুঁত উর্দুতে ফেরদৌসীর গাওয়া, যা তাকে সারাদেশে সুপরিচিত করে দেয়। একই সঙ্গে তৎকালীন দুই পাকিস্তানের সিনেমার জন্য গাইতে থাকেন এবং প্রায় ২০০টি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৭ সালে প্রথম লং প্লে অ্যালবাম ‘বেস্ট অব ফেরদৌসী’ এইচএমভি থেকে রেকর্ড হয়। তার প্লে-ব্যাক করা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৫০-এর কাছাকাছি। ৩টি লং প্লেসহ প্রায় ৫০০টি ডিস্ক রেকর্ড এবং দেড় ডজনের বেশি গানের ক্যাসেট বের হয়েছে তার। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার গানের রেকর্ড হয়েছে। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যেসব গান করেছেন তার সব আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। তার সময়ের গানগুলোর আবেদন কোনোদিনও ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে-‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, ‘মনে যে লাগে এত রঙ’, ‘নিশি জাগা চাঁদ’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’, ‘ঝরা বকুলের সাথি আমি’, ‘হাড় কালা করলাম রে’, ‘গহিন গাঙের নাইয়া’ ও ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝে সই’, ‘কথা বলো না বলো ওগো বন্ধু’, ‘ও কি বন্ধু কাজল ভ্রমরা’, ‘যার ছায়া পড়েছে মনের আয়নাতে’। 

বাংলা গানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম বলা হয় তাকে। বাংলা গানের বিভিন্ন ধারার অনেক কিছুর শুরু তার হাতে। পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক এবং প্লে-ব্যাক সব ধরনের গানই তিনি করেছেন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী চিরসবুজ এই কণ্ঠশিল্পী।

ফেরদৌসী রহমান বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। তার মধ্যে ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইরাক, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, গ্রিস, মরিশাস, যুগোস্লাভিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। যখন যেখানে গিয়েছেন, সে জায়গার ভাষায় গান শিখেছেন এবং সেই দেশের শ্রোতাদের মন জয় করেছেন। উর্দু, পাঞ্জাবি, পুশতু, ফার্সি, আরবি, চীনা, রাশিয়ান, জাপানি, যুগোস্লাভ, জার্মান, গ্রিক, আফগান, থাই, মালয়েশিয়ান, তুর্কি এবং ইংরেজিসহ অনেক বিদেশি ভাষায় গান গেয়েছেন। বাংলাদেশি শিল্পীদের মধ্যে এই কৃতিত্ব খুবই বিরল।

১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর হোটেল শাহবাগে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রকৌশলী রেজাউর রহমানের সঙ্গে সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। স্বামী ও দুই পুত্র রুবাইয়াত ও রাজিনকে নিয়ে ফেরদৌসী রহমানের সুখের সংসার। ব্যক্তিজীবনে প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে রুবাইয়াত রহমান ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে এমবিএ এবং টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি থেকে এমআইএস সম্পন্ন করে বর্তমানে ডালাসে থাকেন। ফেসবুকে কর্মরত আছেন। রুবাইয়াতের তিন ছেলেমেয়ে। আর ছোট ছেলে রাজিন রহমান, লন্ডনে থাকেন তিনিও ওখানকার একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। রাজিনের দুই মেয়ে। ফেরদৌসী রহমানের স্বামী রেজাউর রহমান এখন অবসরজীবন যাপন করছেন। তিনি ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ফিল্টার তৈরির একটা কারখানা ছিল তার, যা দেশের একমাত্র ফিল্টার তৈরির প্রতিষ্ঠান ছিল। ছেলেরা বাইরে চলে যাওয়ার পর ফ্যাক্টরিও বিক্রি করে দেওয়া হয়। 

সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পদক। ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য সম্মাননায়। জাতীয় পর্যায়ে নানাভাবে সম্মানিত হয়েছেন। তার অর্জিত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩), প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৬৫), টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৫), জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক (১৯৭৭), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৬), একুশে পদক (১৯৭৭)। এ ছাড়াও তিনি নাসিরউদ্দীন গোল্ড মেডেল পুরস্কার, মাহবুবুল্লাহ গোল্ড মেডেল, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন গোল্ড মেডেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডস আয়োজন হতে পরম্পরা পরিবার পদক, মেরিল প্রথম আলো লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, সিটি ব্যাংক এনএ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ইউওডিএ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে অসংখ্য সম্মানসূচক ক্রেস্ট ও পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। 

বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো ফেরদৌসী রহমান একাধারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক, চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির জাতীয় জুরি বোর্ডের সম্মানিত সদস্য, নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //