স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৩১ এএম
আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৯, ০১:২৯ পিএম
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৩১ এএম
স্বর্ণা চৌধুরী
আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৯, ০১:২৯ পিএম
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি নিহতের খবরে অনেকেই খুশি হয়ে থাকতে পারেন।
তবে এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কার্যত খাদের কিনারায় পৌঁছে যাওয়া তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। আর তিনিও এ সুযোগ দু’হাতে লুফে নিয়েছেন।
বাগদাদি নিহতের ঘোষণা দেয়ার পরপরই ট্রাম্পের সমর্থকরা তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিশংসন শুনানিকে ‘দেশপ্রেমহীন’ বলে প্রচার চালানো শুরু করে। তাদের মতে, এটা এমন এক নেতার বিরুদ্ধে আক্রমণ, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন!
গত ২৭ অক্টোবর টেলিভিশনে ট্রাম্প আইএসের প্রধান বাগদাদি নিহত হওয়ার ঘোষণা দেন। মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযান চলাকালে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিজেকে উড়িয়ে দেন বাগদাদি।
ট্রাম্প বলেন, ‘শনিবার (২৬ অক্টোবর) রাতে সিরিয়ার ইদলিবে নিখুঁত অভিযান চালানো হয়। ওই অভিযানে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে বাগদাদি (৪৮) রয়েছেন। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ বাহিনীর রাত্রিকালীন অভিযানটি ছিল বিপজ্জনক ও দুঃসাহসিক। তারা তাদের অভিযানটি দুর্দান্তভাবে সম্পন্ন করেছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আইএস নেতা শেষ পর্যন্ত সারা পথ কাঁদতে কাঁদতে একমুখ বন্ধ টানেলের মধ্যে ঢুকে মারা গেলেন। আত্মঘাতী বেল্ট পরে নিজেকে ও তার তিন শিশুকে হত্যা করলেন। কুকুরের মতো করে, ভীতুর মতো মারা গেলেন। এখন পৃথিবী আগের চেয়ে বেশি নিরাপদ।’
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বাগদাদিকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ২০১১ সালে ওয়াশিংটন সরকার ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা দেয়। পরে পুরস্কারের অঙ্ক বাড়িয়ে ২৫ মিলিয়ন ডলার করা হয। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন চালানোর সময় মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দিও হয়েছিলেন বাগদাদি।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজেকে সবসময় জাহির করতে অভ্যস্ত ট্রাম্প এ অভিযানেও নিজেকেই কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। এটা যেন তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য!
তিনি বলেন, ‘আমি বরাবরই জিজ্ঞেস করেছি, আল-বাগদাদি কোথায়? তিন বছর ধরে আমি তার খোঁজ করে চলেছি।’ কয়েকদিন আগে তিনি তার সরকারের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিসের সমালোচনা করে বলেন, ‘আমি আইএসকে বন্দি করেছি। ম্যাটিস বলেছিলেন, এটা করতে দুই বছর লাগবে। আমি তাদের এক মাসেই বন্দি করেছি।’
ওই ঘোষণার পরপরই অনলাইনে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়, যেখানে দেখা যায়- একটি রুমে বসে পুরো অভিযান পর্যবেক্ষণ করছেন ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীরা। ছবিটি আরেক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেন নিধনের সময়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটি ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে এবারের ছবিতে পরিষ্কারভাবে ট্রাম্পকেই ‘মধ্যমণি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ট্রাম্পের মাথায়ও নিশ্চিতভাবেই ছিল লাদেন হত্যার স্মৃতি। এ কারণে তিনি নিজেই লাদেন ও বাগদাদির তুলনা তুলে ধরেছেন- কে বড় সন্ত্রাসী!
ট্রাম্প বলেন, ‘ওসামা বিন লাদেন অবশ্যই বড় সন্ত্রাসী ছিলেন। তবে তিনি বড় সন্ত্রাসী হয়েছেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা চালিয়ে। তবে এই ব্যক্তি (বাগদাদি) একটা গোটা দেশ, খেলাফত গড়ে তুলেছিলেন।’
ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আগে থেকেই দাবি করে এসেছেন যে, আইএসকে পরাস্ত করার জন্য বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনই একটি জোট গঠন করে। অথচ এ জোট গঠিত ও কার্যকর হয়েছিল ওবামা প্রশাসনের সময়েই।
ট্রাম্প তাঁর ভাষণে রাশিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। অথচ এ অভিযান সম্পর্কে অবগতই নয় তারা। এমনকি সিরিয়া সরকারকেও ধন্যবাদ জানান ট্রাম্প, যে সিরিয়া সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই অভিযান পরিচালনাকারী অঞ্চল ইদলিবে। ট্রাম্প সিরীয় কুর্দিদের সম্পর্কে বিরূপ অবস্থানও ব্যক্ত করেছেন। তারা নাকি সবার শেষে এ অভিযানের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে!
মার্কিন মদদপুষ্ট সিরীয় কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) কমান্ডার মাজলুম কোবানি টুইটার বার্তায় জানিয়েছেন, বাগদাদিকে ধরার জন্য পাঁচ মাস ধরে মার্কিন-এসডিএফ যৌথ গোয়েন্দা তৎপরতা চলছিল।
ট্রাম্প এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে, সিরিয়ায় আগ্রাসনে তাঁর মূল লক্ষ্য পূর্বের তেল ক্ষেত্রের দখল নিশ্চিত করা। মার্কিন বাহিনী ইতোমধ্যে আইএসকে সরিয়ে দিয়ে সিরিয়ার দেইর ইজ্জর অঞ্চলের তেল ক্ষেত্র নিজেদের দখলে নিচ্ছে।
ট্রাম্প বলেছেন, ‘তেল খুবই মূল্যবান। আমি এক্সনমোবিল বা আমাদের অন্য কোনো বড় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে আগ্রহী, যেন তারা সেখানে গিয়ে সঠিক উপায়ে তেল আহরণ করতে পারে।’
কার্যত ট্রাম্প ওই ভাষণে যা বলেছেন, এর সবই তার নির্বাচনী প্রচারের অংশ। বাগদাদিকে হত্যার বিষয়টি ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব প্রচারে বলা হয়- তিনি একাই আইএসকে নিরঙ্কুশভাবে পরাজিত করেছেন। তা অর্জন করতে মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। শুধু মার্কিন অর্থনৈতিক আগ্রহ আছে যেসব ক্ষেত্রে, সেখানে সেনা উপস্থিতি থাকবে। রুশ ও তুর্কি নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের সুসম্পর্ক থাকার ফল ভোগ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
এটা পরিষ্কার ছিল যে, ওই ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সমর্থকরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সব কাজের মূল্যায়ন বাদ দিয়ে প্রশংসার ফুলঝুরি গাঁথবে। তবে বাগদাদি ও তার সন্ত্রাসী সংগঠনের গণনিপীড়নের কারণেই এবারের স্তুতি বাক্যে যে কাউকে বিভ্রান্ত করাটা অনেক সহজ বলে মনে করা হচ্ছে।
মার্কিন পার্লামেন্টের ইন্টেলিজেন্স কমিটির প্রধান ডেমোক্র্যাট নেতা অ্যাডাম শিফ দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করেছেন। ট্রাম্পকে অনৈতিকভাবে ক্ষমতা চর্চার জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তাকে অভিসংশনের আবেদন জানানো হয়েছে। ট্রাম্পের সমর্থক ফক্স নিউজের সাংবাদিক জিনাইন পিরো বলেছেন, ‘আবু বকর আল-বাগদাদিকে হত্যা করায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য আমি অসম্ভব গর্বিত। ইন্টেলিজেন্স কমিটির অ্যাডাম শিফের উচিত এখন তাদের স্বার্থপর রাজনৈতিক এজেন্ডা বাদ দিয়ে আমেরিকার শত্রুদের দিকে মনোযোগ দেওয়া।’
এভাবেই ট্রাম্প সমর্থকরা তার পক্ষে জোরালো প্রচার চালাচ্ছে। কয়েকদিন আগে যেখানে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন, সেখানে এবার তাদের অনেক স্বতঃস্ফূর্ত দেখাচ্ছে। আগের চেয়েও অনেক বেশি দৃঢ় ও শক্তিশালী হিসেবে ট্রাম্প তার পপুলিস্ট রাজনীতিকে তুলে আনতে পেরেছেন। অভিসংশন শুনানিকে সামনে রেখে কার্যত বাগদাদির মৃত্যু ট্রাম্পের রাজনীতিকে যেন নতুন জীবন দান করেছে!
বিশ্লেষকদের মতে, আইএসের মতো সংগঠনগুলো মূলত একটা আদর্শকে সামনে রেখেই পরিচালিত হয়। আর তাই বাগদাদি নিহত হলেও আইএস বিলুপ্ত হয়নি। ট্রাম্প বাগদাদির মৃত্যুকে ঘিরে নিজের নির্বাচনী প্রচার কার্যকর করলেও আইএসের আতঙ্ক মিলিয়ে যায়নি। আইএস টুকরো টুকরো হলেও তারা একেবারেই মৃত নয়। অথচ আইএসের পরাজয় হয়েছে বলে উল্লেখ করে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ধারণা আইএসের মাত্র ৭০০ সশস্ত্র সদস্য রয়েছে।
তবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল জোসেফ ভোটেলের মতে, তাদের ১০ হাজার সশস্ত্র সদস্য রয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ার কয়েক হাজার যোদ্ধা ছাড়াও আইএসের হাতে রয়েছে ফিলিপাইন ও পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশের কিছু অঞ্চল। এছাড়া আফগানিস্তানেও তারা শক্তি সঞ্চয় করছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বাগদাদির হয়ত মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু আইএস আতঙ্কের মৃত্যু যে এখনি ঘটছে না, সেটা নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যায়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh